বাচ্চাদের সঙ্গে নবনীতা দেবসেন। ফাইল চিত্র
বড় হওয়া খুব কঠিন। কিন্তু তার থেকেও কঠিন, বড় হয়েও ছোট হতে পারা। বাংলা সাহিত্যে ছোটদের জন্য যাঁরা লেখেন, তাঁদের অনেকেই এই দ্বিতীয় কাজে, অনেক সময়ে, পারঙ্গম হন না। মুষ্টিমেয় যে ক’জন সেটা পেরেছিলেন তাঁদেরই এক জন, নবনীতা দেবসেন চলে গেলেন এই সে দিন। তাঁর অভাবটা আরও এক বার যেন অনুভব করাল এ বারের শিশুদিবস।
ছোটদের জন্য খুব বেশি লেখেননি নবনীতা। কিন্তু যা লিখেছিলেন সেটা একেবারেই ছোটদের জন্য। তাদের কথা তাদেরই ভাষায় বলতে চেয়ে। বুঝতে পেরেছিলেন, সময় এখন পাল্টে গিয়েছে। পাল্টে গিয়েছে শিশু মনস্তত্ত্বকে বোঝার ধরনও। সেই পাল্টানো সময়ে তিনি যা দিয়েছিলেন তা আধুনিক, চিরকালের হয়েও আধুনিক।
কথাটা একটু ভেবে দেখা দরকার। বাংলা সাহিত্যে ছোটদের জন্য লেখার শুরুটা হয়েছিল উপদেশ ও নীতিশিক্ষা দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে। বাংলা শিশুসাহিত্যের সেই আরম্ভ পর্বে ধরা যাক গোলোকনাথ শর্মার কথাই। তাঁর জন্মসাল ঠিক ভাবে জানা যায় না। মৃত্যু ১৮০৩-এ। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ছোটদের জন্য আলাদা করে কিছু লেখা হত না। কারণ, সেখানে সাহিত্যের প্রধান বিষয় ছিল মূলত ধর্ম। চর্যাগীতি, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, রোম্যান্টিক কাব্য ইত্যাদিতে ছোটদের কথা হয়তো এখানে-সেখানে আছে, কিন্তু তার লক্ষ্য কখনই ছোটরা নয়। ঊনবিংশ শতকে গদ্যসাহিত্যের যুগেই শিশুসাহিত্যের সূচনা বলা যায়।
তো সেই গোলোকনাথ শর্মা থেকে চণ্ডীচরণ মুন্সী, রামরাম বসু, উইলিয়ম কেরি, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, হরপ্রসাদ রায়, তারিণীচরণ মিত্র, তারাচাঁদ দত্ত, রামকমল সেন, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফেলিক্স কেরি, জন লসন ও ডব্লুএইচ পিয়ার্স, দ্বারকানাথ ঠাকুর, নীলমণি বসাক, কালীকৃষ্ণ দেব, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ, তারাশঙ্কর তর্করত্ন, অক্ষয়কুমার দত্ত থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ছোটদের জন্য কিছু না কিছু লিখেছেন সবাই। কিন্তু মোটের উপর সকলেরই উদ্দেশ্য ছিল হিতোপদেশ আর মূল্যবোধ শেখানো। আর তাঁরা যে কিছু শিক্ষা দেওয়ার জন্যই লিখছেন, সেটাও চাপা থাকত না তাঁদের লেখার ধরনে।
এই প্রবণতাকে আমূল বদলে দিয়েছিলেন সুকুমার রায়। নীতিশিক্ষার ধারকাছ দিয়েও যাননি তিনি। তৈরি করেছিলেন অসম্ভবের মজার এক জগৎ। উপেন্দ্রকিশোরের প্রতিষ্ঠিত ‘সন্দেশ’-এর মধ্যেও মজার বাইরে, উপকারের আর উপযোগিতার একটা স্পষ্ট ঘোষণা ছিল। সুকুমার-সত্যজিতে সেটা ছিল না। রায়বাড়ি আর ঠাকুরবাড়ি---বাংলা শিশুসাহিত্যে দুই-ই নিজের নিজের জায়গায় অনন্য, দু’রকম ভাবে।
নবনীতা দেবসেন এ দুই ধারার কোনওটিই অনুসরণ করেননি। বরং তাঁর নিজের এমন এক ভাষা ছিল, যা একেবারে সমকালীন। অনায়াসে সে বাংলায় ঢুকে পড়ত ইংরেজি শব্দ। তার যথেষ্ট ভাল বাংলা প্রতিশব্দ থাকলেও ব্যবহার করতেন না তিনি। বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছোটদের চেনাশোনা ভাষার জগৎটাও যে বদলে যাচ্ছে, সেটা বুঝতেন তিনি। নিজস্ব কোনও ভালমন্দের বোধ তাই চাপিয়ে দেননি ভাষার চলতি হাওয়ার ওপরে। যেমন, তাঁর ‘জীবে দয়া’ গল্প থেকেই পড়া যাক, ‘যা দিনকাল পড়েছে, একটু মায়ামমতা প্র্যাকটিস করুক। প্রাইভেট টিউশন ছাড়া কিছুই তো শেখে না ছেলেপুলেরা, পাখিদের যত্ন করতে করতে যদি জীবে দয়া শেখে। জীবে দয়া করে যদি ক-লাখ টাকা ঘরে আসে, তো আসুক না, ক্ষতি কি? জীবে দয়ার যে এতটা আর্নিং পোটেনশিয়ালস আছে তা কি আগে জানা ছিল? যেমন রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাবার পরে কবিতার আর্নিং ক্যাপাসিটি সম্পর্কে আমাদের ধারণা পাল্টে গেল, আর গাদা গাদা ইংরেজি কবিতা লেখা হতে লাগল।’
সমসময়কে যে ভাবে দেখেছেন নবনীতা, সে ভাবেই লিখেছেন। ছোটদের জন্য লেখা বলেই হাসির আড়ালের তীক্ষ্ণতাগুলোকে ভোঁতা করে দিতে চাননি। ছোটদের মন যে গত শতকের তুলনায় আজ অনেক পরিণত সেই সহজ সত্যটা বুঝেছিলেন। ছোটদের জন্য লেখায় তাই অকারণ জোর করে ছেলেমানুষি করেননি। কিন্তু এই পরিণত মনের সচেতন শিশুসাহিত্য সৃষ্টির ধারাটাও আজ শুকিয়ে এসেছে। ভূতের গল্প, গোয়েন্দা গল্প আর মানবিক মূল্যবোধের গল্প— এমন সব পূর্বনির্ধারিত ধারায় গল্প-উপন্যাসের সংখ্যায় আজও কমতি নেই ঠিকই, কিন্তু তার প্রায় সবই যেন লিখতে হয় তাই লেখা। আলাদা করে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে আজ আর কেউ নিজেকে চেনাতে পারছেন বলে তো মনে হয় না।
অথচ, এক সময়ে নবনীতা দেবসেনের মতো ব্যতিক্রমী লেখকেরা শিশুসাহিত্যেও নতুন নতুন নিরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। সমকালীন রূপকথা লেখার চেষ্টা করেছিলেন নবনীতা। রূপকথাকেও যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক হয়ে উঠতে হয়, বুঝেছিলেন সেটা। কিন্তু তেমন নিরীক্ষা আজ নেই। ছোটদের আনন্দের ভোজ তাই আজ বড় মলিন, পুনরাবৃত্তিময়। আজকের ছোটদের চলচ্চিত্র যে ভাবে বহু পুরনো গল্প-উপন্যাসের দ্বারস্থ হচ্ছে, তাতেও এই অভাবটা স্পষ্ট। সাম্প্রতিক বাংলা বইয়ের জগতেও শিশুসাহিত্য বলতে এখন কেবলই পুনর্মুদ্রণ।
এ বারের শিশুদিবসের কয়েক দিন আগে নবনীতা দেবসেনের চলে যাওয়া তাই আর এক রকম শূন্যতার জন্ম দিল।
লেখক উপ-পরিচালক, মুদ্রণ বিভাগ, বিশ্বভারতী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy