Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪
আরোগ্য সেতু অ্যাপের বিরুদ্ধে নাগরিক অধিকার ভঙ্গের অভিযোগ
Coronavirus Lockdown

নজরদারির পরের ধাপ

সংক্রমণ কী ভাবে ছড়াচ্ছে, তা নির্ধারণ করতে আরোগ্য সেতু অ্যাপ স্মার্টফোনের জিপিএস ও ব্লু টুথ প্রযুক্তির সাহায্য নেয়।

শমীক সেন ও অগ্নিদীপ্ত তরফদার
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০২০ ০১:১০
Share: Save:

সারা বিশ্ব অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কোভিড-১৯’এর প্রতিষেধক টিকার জন্য। প্রতিটি রাষ্ট্র ও সরকারের সামনে এখন এই অতিমারির সমাধানসূত্র খুঁজে বার করার বিরাট চ্যালেঞ্জ। কোভিড সংক্রান্ত তাৎক্ষণিক তথ্য (রিয়েল-টাইম ডেটা) সংগ্রহে এবং এই রোগের সংক্রমণ নির্ধারণে অভূতপূর্ব হারে প্রযুক্তিগত সমাধানের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। চিন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানে করোনার সম্ভাব্য বাহক ও উপসর্গযুক্ত মানুষের চলাফেরা ও অবস্থানের খোঁজ পেতে লোকেশন-ট্র্যাকিং অ্যাপ ব্যবহার করা হয়েছে। সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এই সব দেশের সরকার স্থানবিশেষে যাতায়াত ও সীমান্ত পেরিয়ে যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণে রাশ টানতে নীতি প্রণয়ন করেছে, কোয়রান্টিন চালু করেছে। দেশে দেশে এই সব অ্যাপের কার্যকারিতার তারতম্য আছে, সব দেশে সমান সাফল্য পাওয়া যায়নি। ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের ইলেকট্রনিক্স ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রক তৈরি করেছে অ্যাপ ‘আরোগ্য সেতু’। শুরু থেকেই এই অ্যাপের সঙ্গী বিতর্ক। এই অ্যাপে তথ্যের সুরক্ষা নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ সংশয় প্রকাশ করেছেন, এমনও বলেছেন— এই অ্যাপ আর কিছুই নয়, ভারতকে সারভেল্যান্স স্টেট বা নজরদারি রাষ্ট্র করে তোলার প্রথম ধাপ।

সংক্রমণ কী ভাবে ছড়াচ্ছে, তা নির্ধারণ করতে আরোগ্য সেতু অ্যাপ স্মার্টফোনের জিপিএস ও ব্লু টুথ প্রযুক্তির সাহায্য নেয়। কেউ কোভিড-আক্রান্ত কোনও মানুষের কাছাকাছি আছেন কি না, এই অ্যাপ তা নির্ধারণ করে ব্লু টুথের মাধ্যমে, ইতিমধ্যেই তৈরি-থাকা কোভিড-আক্রান্তদের একটি ডেটাবেস স্ক্যান করে। আর জিপিএস-লোকেশন সংক্রান্ত তথ্য ব্যবহার করে সে জানায়, অ্যাপ-ব্যবহারকারী কোনও সংক্রমিত এলাকায় আছেন কি না। অ্যাপ-ব্যবহারকারী স্বেচ্ছায় নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে কতটা ঠিক তথ্য দিচ্ছেন তার উপরে, এবং যথেষ্ট সংখ্যক মানুষের ব্যবহারের উপরেই এই অ্যাপের সাফল্য নির্ভরশীল। একটি ন্যূনতম সংখ্যক মানুষ এই অ্যাপ ব্যবহার না করলে অ্যাপের অনুমানক্ষমতার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। একই ভাবে, একটি ভৌগোলিক অঞ্চলে অ্যাপ-ব্যবহারকারীর সংখ্যা তুলনায় কম হলে, সেই অঞ্চলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার যে চিত্র এই অ্যাপ দেবে, তা ঠিক না-ও হতে পারে। সুতরাং অ্যাপের সংগৃহীত তথ্য আসলে কতটা নিখুঁত, প্রশ্ন আছে সেটা নিয়েই। মনে রাখা দরকার, অ্যাপের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তি আসলে ব্যক্তি মানুষের স্বীকারোক্তি, এবং সেই মানুষটি সামাজিক বহিষ্কার বা অসম্মানের ভয়ে, বা ভুলবশত নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ঠিক তথ্য না-ও দিতে পারেন। সংগৃহীত তথ্যে গলদ থাকলে বা তার যাথার্থ্য অনিশ্চিত হলে অ্যাপের ফলাফলেও যথাযথ তথ্য পাওয়া যাবে না। স্বাভাবিক ভাবেই, এই তথ্যের ভিত্তিতে গৃহীত স্বাস্থ্য নীতি বা কন্টেনমেন্ট সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত এই বিশাল ও ব্যয়বহুল প্রকল্পটির সামগ্রিক কার্যকারিতাকেই প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে।

আরোগ্য সেতু অ্যাপের বিরুদ্ধে ওঠা আঙুলগুলোর বেশির ভাগই নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার সংক্রান্ত। অভিযোগ উঠছে যে সরকারের আর কোনও স্পষ্ট ও সুষ্ঠু প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই, তাই তারা এই অ্যাপের ব্যাপক প্রচারে মন দিয়েছে, বিমান ও ট্রেন যাত্রায় তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে, এমনকি কিছু কিছু কর্মক্ষেত্রেও। এই অ্যাপ-ব্যবহারকারীদের দেওয়া তথ্যের ফলে সরকারের ঘরে নাগরিকের স্বাস্থ্য বিষয়ক এক বিরাট তথ্যভান্ডার তৈরি ও মজুত হবে, সরকার যা নানা উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে পারে, চাইলে তা দিয়ে নাগরিকের প্রোফাইলিং বা শ্রেণিবিন্যাস ও প্রেডিক্টিভ অ্যানালিসিস বা সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণও করতে পারে। সরকারের সব মন্ত্রক তো আর স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে না। কিন্তু সমস্ত মন্ত্রকে এই বিপুল তথ্যভাণ্ডার ছড়িয়ে যাওয়া বা ব্যবহার হওয়াটাও একটা চিন্তার বিষয়, গোপনীয়তার অধিকারের পক্ষাবলম্বীদের মত এমনই।

ভারতে এখনও নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় কোনও আইন নেই, সরকার ও অন্য বেসরকারি তথ্য সংগ্রহকারী সংস্থার হাত থেকে নিজের তথ্য বাঁচানোর রাস্তা নেই। সুপ্রিম কোর্ট বারংবার এমন একটি আইন তৈরির প্রয়োজনীয়তায় জোর দিলেও, গোপনীয়তার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও সরকারের তরফে এখনও পর্যন্ত এমন কোনও আইন প্রণয়নের আগ্রহ বা চেষ্টা দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে নাগরিকের তথ্যের অপব্যবহার রুখতে যথেষ্ট আইনি বন্দোবস্ত না করেই, নাগরিকের অন্যান্য স্বাধীনতাগুলিকে এই অ্যাপের অধীন করে তোলাটা এক আতঙ্ক ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করেছে।

এই সমালোচনার ঝড় রুখতে কেন্দ্রীয় ইলেকট্রনিক্স ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রকের গঠিত এক বিশেষজ্ঞ কমিটি ‘ডেটা অ্যাকসেস’ ও ‘নলেজ শেয়ারিং’ সংক্রান্ত একটি প্রোটোকল তৈরি করেছে। যে তথ্যের অপব্যবহার হতে পারে, সেগুলি কেমন করে সামলানো হবে, যাঁরা সেই তথ্য নিয়ে কাজ করছেন তাঁদের জন্য নিয়মকানুনই বা কী হবে, সেই সব বুঝতে ও বোঝাতে এই প্রোটোকলটিই একমাত্র নির্দেশিকা। তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে নিয়মগুলো সর্বত্র স্বীকৃত— যেমন, কী কারণে এই তথ্য নেওয়া বা চাওয়া হচ্ছে তা স্পষ্ট করা, সংগৃহীত তথ্যের কতটা আসলেই প্রয়োজন তা স্পষ্ট জানানো, যে কোনও পরিস্থিতিতে নাগরিক বা ব্যক্তির নাম-পরিচয় ইত্যাদি সম্পূর্ণ গোপন রাখা, একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর বাধ্যতামূলক ভাবে তথ্য মুছে দেওয়া— ইত্যাদি মেনে চলা এই প্রোটোকলের দায়িত্ব। তথ্য সংগ্রহ করতে হবে প্রয়োজন ও পরিমাণের গুরুত্ব বুঝে, অন্যথায় দণ্ডবিধানের নির্দেশও এই প্রোটোকলে আছে। নির্দেশিকাটি মোটের ওপর সুনির্মিত, আরোগ্য সেতু ব্যবহারের বিরুদ্ধে ওঠা বিতর্ক ও সংশয়ের নিরসনেও আগ্রহী।

কিছু প্রশ্ন তার পরেও থেকেই যায়। প্রথমত, এই অ্যাপ চালু করার পিছনে সহায়ক কোনও আইন নেই। বোঝাই যাচ্ছে, সরকার আবার সেই আধার-এর পথই নিয়েছে। আধার প্রকল্প প্রথম চালু হয়েছিল একটি প্রশাসনিক নির্দেশের মাধ্যমে, পরে রাজ্যসভাকে এড়িয়ে একটি অর্থ বিল হিসেবে। আইনের দিক থেকে এহেন প্রক্রিয়ার পরিণাম গুরুতর। কোনও সঙ্গত বা প্রয়োজনীয় কারণে হলেও মৌলিক অধিকার ভঙ্গ বা তাতে হস্তক্ষেপ একমাত্র আইনি পথেই করা যায়, অন্য কোনও ভাবে নয়। যদিও এই উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়নে সেই সময়ে সংসদের অধিবেশন ডাকা সম্ভব ছিল না, তা সত্ত্বেও সরকার কোনও অধ্যাদেশ জারি করতে পারত, কিন্তু অদ্ভুত ভাবে তা এড়িয়ে গেছে। এখনকার এই প্রোটোকলটি অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হলেও তা আইনের বিকল্প নয়। তাই সরকার যদি আইন বাঁচিয়ে কিছু করতে চায়, সে ক্ষেত্রে কোনও সংশোধনী আনতে তাকে সংসদীয় প্রক্রিয়ার জটিলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে না। এক প্রোটোকল পাল্টে অন্য একটা আনলেই যথেষ্ট।

এই প্রকল্পের আরও একটি অসুবিধে আছে। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করে যে মৌলিক অধিকার, তা দরকারে কাটছাঁট করতে হলেও করতে হবে প্রয়োজন ও পরিমাণের ভিত্তিতে। এর অর্থ এই যে, রাষ্ট্র এই অধিকারে রাশ টানতে যাওয়ার আগে তাকে এটা নাগরিককে বোঝাতে হবে— এই নিয়ন্ত্রণ ছিল অত্যন্ত জরুরি, অপরিহার্য। সে নাগরিককে এও বোঝাবে, এর চেয়ে কম নিয়ন্ত্রণের কোনও বিকল্প এই মুহূর্তে তার হাতে নেই। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, আরোগ্য সেতু এই দুই ক্ষেত্রেই ব্যর্থ। করোনার ছড়িয়ে পড়া রুখতে নাগরিক স্বাধীনতা খর্ব না করে, আইন মেনেই সরকারি নিয়মকানুন বা নির্দেশিকা চালুর উদাহরণ আছে, যেমন হয়েছে কেরলে। তাই কেউ এই কথা বলতেই পারেন যে লোকেশন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহই একমাত্র কার্যকরী পথ বলে দাবি করা আর কিছুই নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের নিজেদের সুবিধামতো কাজ সেরে ফেলা।

যে দেশে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য প্রকট, ডিজিটাল সাক্ষরতা নেই বললেই চলে, সেখানে প্রযুক্তিগত সমাধানের উপর এত বেশি নির্ভরতা বরং বেশি সমস্যা ডেকে আনতে পারে। সরকারকে বুঝতে হবে, অতিমারির মোকাবিলায় যে কোনও কার্যকর উদ্যোগই করতে হবে দেশের নাগরিকের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতার মাধ্যমে, স্রেফ চাপিয়ে দিয়ে নয়।

ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Lockdown Cyclone Amphan Cyclone
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy