ছোটবেলায় আমাদের গ্রামে পুতলনাচের দল আসত খুব। পুতুলনাচে সেই সময় পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক নানা পালা দেখতাম। এই সব পালার ভিতরে একটা পালা বেশ মনে ধরেছিল— ‘লালন ফকিরের ভিটে।’ আমার ছোট্ট শব্দভাণ্ডারে সে দিন একটা নতুন শব্দও সংযোজিত হয়েছিল— ‘ভিটে’। কিন্তু কাকে বলে ভিটে? তলিয়ে বোঝার বয়স সেটা নয়। শুধু এটুকু বুঝেছিলাম, ভিটে মানে বাসস্থানের বাড়তি একটা আবেগ। যে কারণে ভিটে ছাড়তে গেলে বুকে লাগে, মন মোচড় দেয়, ছলছল করে চোখ।
‘ভিটে’ শব্দটা কিন্তু মনে গেঁথে গিয়েছিল। তাই এ নিয়ে পরে অনেক ভেবেছি। ঘেঁটেছি অভিধান। অভিধানে ভিটের প্রথম অর্থ হিসাবে রয়েছে বাস্তুভূমি। কিন্তু ওইটুকুই বোধকরি সব নয়। তাই বন্ধনীর মধ্যে লেখা রয়েছে, বংশানুক্রমিক। একটু বড় হলে, বাবা যখন বাড়ির দলিল নিয়ে বসে বোঝালেন জমির নানা প্রকারভেদ, তখন বুঝলাম বংশানুক্রমিকের ধারণাটা ঠিক নয়। ভিটেজমি কোনও মাঠ বা বাগান-জমির ভূমি ও রাজস্ব দফতরের নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে করা অদলবদল ছাড়া আর কিছু নয়। এ দিকে ভিটের আগে ‘সাতপুরুষ’ শব্দটাকেও অনেকে বসিয়ে দেন। ভূমি ও রাজস্ব দফতরের দাক্ষিণ্যে ভিটের দেখলাম ‘একপুরুষ’ হওয়ারও অধিকার রয়েছে।
কিন্তু ভিটে মানেই কি নিজস্ব? মানে স্ব-মালিকানার একটা স্বাধীন-স্বাধীন সাবেকি ভাব? যে সব দখলদারির বাড়িঘর, উচ্ছেদের আশঙ্কা বুকে নিয়ে আজকাল গজিয়ে ওঠে রেললাইনের পাশে, বড় রাস্তার ধারে সেগুলো তা হলে কী? এই সব ঝুপসি বাড়ির কোনওটায় যখন সন্ধেয় প্রদীপ জ্বলে তুলসীতলায়, শাঁখ বাজে নিকোনো উঠোনে এবং কোনওটার বারান্দায় যখন ছোট্ট মাদুর পেতে চলে সকাল সাঁঝের নমাজের আয়োজন, তখন কী মনে হয়, দখল করা জমির উপর এই সব ঝুপসি বাড়িঘর ভিটের থেকে আলাদা কিছু?
কথা হল, দখল করা জমিতে যদি ভিটের আকুলতা গড়ে তোলা যায়, তা হলে ভাড়া বাড়িতেই বা তা যাবে না কেন? বাস্তুভূমিও তো এক অর্থে নিজস্ব নয়। সরকার এর জন্য কর নেয়। ভাড়া বাড়িতে দেয় ভাড়া করের থেকে হয়তো কিছু বেশি। তা হোক। ভাড়া বাড়িতে যখন আমরা ফেলে আসি শৈশবের অস্থিরতা কিংবা কৈশোরের স্বপ্ন অথবা যৌবনের রং তখন ভাড়া বাড়ি তো নিজস্ব বসতবাটির মতোই সমান ঔজ্জ্বল্যে মনের ক্যানভাসে রয়ে যায়!
বুদ্ধদেব বসুর কথাই ধরা যাক। তাঁর ‘কবিতা ভবন’ বলতে যে ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউকে বাংলা পাঠক চেনে তা তো ভাড়া বাড়িই। পঞ্চান্ন টাকায় ভাড়ায় ভাবানীপুর থেকে এই বাড়িতে ১৯৩৭ সালের ১ জুন উঠে এসে বুদ্ধদেব বসু কাটিয়ে দেন উনত্রিশ বছর। এই ভাড়া বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে কষ্টে রাত্রিতে তিনি জেগে উঠতেন অনেকদিন। ‘আর সেখানেই-অনেক সুখে ও দুঃখে, সংযোগে ও বিয়োগে, সম্প্রসারণে ও সংকোচনে, অনেক বৃক্ষ ও সৌন্দর্য ও বন্ধুতার মৃত্যু পেরিয়ে, অনেক আলো-অন্ধকারে ঘুরে ঘুরে, অনেক আরম্ভ ও অবসান অতিক্রম করে’, ‘প্রায় একটা জীবৎকাল’ পার করে দেওয়ার পরে তাঁর মনে হয় সেটা ‘একটি মুহূর্তের বেশি নয়।’
আর সত্যজিৎ রায়? তিনিও তো ভাড়া বাড়িতে কম দিন কাটাননি। তবে সবথেকে স্মরণীয় বোধহয় লেক অ্যাভিনিউ-এর বাড়ি। এই বাড়িতেই কাটে তাঁর বিবাহিত জীবনের শুরুর দশটা বছর। এই বাড়িতে থাকাকালীনই তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণ-পর্ব এবং বিশ্বখ্যাত হয়ে ওঠা। শুধু কি তাই? আর্থিক সঙ্কটে যখন আটকে পড়েছে ‘পথের পাঁচালী’র শুটিং, সেই সময়কার সেই অদ্ভুত ঘটনাটি মনে আছে? শোওয়ার ঘরের জানলায় একটা সাদা লক্ষ্মীপেঁচা এসে ঠাঁই বসেছিল দু’সপ্তাহ। আর ঘরে সত্যজিৎ রায় উপস্থিত থাকলে সে চেয়ে থাকত তাঁরই দিকে। এর পরেই ডাক এসেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে সত্যজিৎ রায়ের। মিলেছিল আর্থিক সাহায্য। এ বাড়িকে ভুলে যাওয়া কি সম্ভব? বিজয়া রায় সবিস্তারেই লিখে গিয়েছেন এই বাড়িতে তাঁদের যাপনকালের নানা ঘটনা। আর সত্যজিৎ রায় ‘অপুর পাঁচালী’তে উল্লেখ করেছেন, এ বাড়িতে ঘটা ওই অদ্ভুত ঘটনাটির। বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না।
ভাড়া বাড়ির এহেন চৌহদ্দিতে মেস হয়তো ঢুকবে না। কারণ মেস মানেই একটা অস্থায়ী ঠিকানা। অনেকটা যেন দূরপাল্লার ট্রেনের রিজার্ভেশনের সিট বা বার্থ। আবেগের সম্পর্ক তৈরি হতে না হতেই যা ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু ১৩৪ মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের সেই রসিক লেখক শিবরাম চক্রবর্তী মেসের যে একটি ঘরে পার করে দিয়ে গেলেন প্রায় অর্ধ শতাব্দীরও কিছু বেশি সময়, কী বলা যাবে তাকে? নিজের বাড়ির থেকে কম কিছু?
ভাড়া বাড়ি বা মেসে ক্ষেত্রবিশেষে কিছু অসুবিধা থাকে। কিছু পরাধীনতায় মাঝে মাঝে অসহায় বোধ করা, হাঁপিয়ে ওঠার ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। স্ব-মালিকানার ফ্ল্যাট সে দিক থেকে অনেকটাই নির্ভার ও নিশ্চিন্ত আবাস। স্ব-মালিকানার ফ্ল্যাটকে যতই ‘বড়লোকের বস্তি’ বলে কিছু মানুষ কটাক্ষ করুক, অনেকের কাছেই কিন্তু ফ্ল্যাট-বাস বেশ পছন্দের। ফ্ল্যাটকে বাড়ির গড়ন দিতে চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেন না কেউ কেউ। চিলতে বারান্দায় ফুল চাষ করেন টবে। চাষ করেন পছন্দের কিছু ফলও। ভিটে বাড়ি বিক্রি করতে বাধ্য হলে যে অন্তর্বেদনা মনের মধ্যে বেশিরভাগ সময়ে পাক দেয়, ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে অনুরূপ অবস্থায় কি তার থেকে আবেগ কিছু কম হয়? মনে তো হয় না।
সরকারি আবাসে থাকার অভিজ্ঞতা অনেকেরই হয়। সেখানেও তো কত মায়া দিয়ে মাঝে মাঝে দেওয়াল, দরজা ঝাড়পোঁছ চলে। চলে কোনও নতুন আসবাব এলে কোথায় ওটা রাখা যাবে তা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা। তার পরে হয়তো টবে ক্যাকটাস-অর্কিড বসিয়ে, ব্যালকনির রেলিং থেকে লতানে ফুলগাছ ঝুলিয়ে দিয়ে আবাসকে মনের মতো করে সাজানোর প্রয়াসও অনেক সময় থাকে। নিজের বাড়ি নয় বলে এ সবে কোথাও তো আটকায় না একটুও!
একই ভাষায় কথা বলা প্রতিবেশী দেশ থেকে একদা সব ছেড়ে চলে আসা মানুষজনের মুখে ফেলে আসা ভিটের গল্প, ভিটের জন্য হা-হুতাশ আমরা অনেকেই কম বেশি শুনেছি। হয় পরিবারে অথবা অন্য কোথাও। কিন্তু এর জন্য এ দেশের নীড়টির প্রতিও তাঁদের কম যত্ন কেউ দেখিনি। এ ভিটেও তাঁদের কাছে ধীরে ধীরে ভিটে হয়ে উঠেছে আপন অধিকারে। এবং তার পরে হয়তো একসময় ফিকে হয়ে গিয়েছে পুরোনো স্মৃতিও।
সব মিলিয়ে তাই মনে হয় মানুষ যেখানে বাস করে সেই বাসস্থানটি নিজের হোক বা পরের, তার ভিটে হতে বাধা নেই। বাসস্থানের বাড়তি আবেগ সব জায়গাতেই আসতে পারে। আসলে বসবাস মানে তো সুখদুঃখ, পূর্ণতা ও অপূর্ণতা নিয়ে বন্দি কিছুটা সময়। এই সময়কে উপভোগ করলে, পেরিয়ে যাওয়ার পরে স্বীকার করতে পারলে, কোথায় বাস করা হচ্ছে বা হয়েছে, এবং তা কত দিন ধরে, সে সব বোধহয় আর তত গুরুত্বপূর্ণ থাকে না।
(লেখক স্কুল শিক্ষক, তথ্যঋণ— ‘আমার যৌবন’/ বুদ্ধদেব বসু, ‘আমাদের কথা’/বিজয়া রায়)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy