Advertisement
E-Paper

সচেতন হয়েই বসতি আবার উঠবে জেগে

লকডাউনের পরেও যদি এভাবেই আমরা পরিবেশের প্রতি সদয় থাকতে পারি তাহলে হয়তো পরবর্তী প্রজন্মকে একটা সুস্থ-সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে পারব আমরা।ইতিহাসের ছাত্রী হবার দরুন জেনেছি আদিম যুগের মানুষ কীভাবে সম্পূর্ণ নতুন এক পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখেছিলো।

গোধূলিবেলায় তিলপাড়া জলাধার। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

গোধূলিবেলায় তিলপাড়া জলাধার। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

অমৃতা চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২০ ০১:৩৩
Share
Save

অন্যান্য বছর এই সময়ই গরমের ঠেলায় মানুষ ভুলতে বসে এটা বসন্ত নাকি গ্রীষ্ম। কিন্তু এবারের চৈত্রবেলা একটু যেন অন্যরকম। এখন আপাতত গোটা বিশ্ব জুড়ে মারণ ভাইরাস নিজের দাপট দেখিয়ে চলেছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব তথা দেশ তথা রাজ্য। তবে, কথাতে আছে “অন্ধকারের মধ্যেও আছে ক্ষীণ আলোর উপস্থিতি”। ঠিক তেমনই করোনাভাইরাস নামক মারণ রোগের প্রকোপে যখন আতঙ্ক আর ভয় প্রতিটা মানুষকে গ্রাস করেছে তখনই লকডাউনের প্রভাবে দেখা যাচ্ছে পরিবেশের অন্যদিক। মানুষের আনাগোনা কমায় নানান রকম ডাক সমৃদ্ধ পাখিদের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। আগে যেমন যানবাহনের হর্ণ, মানুষজনের চিৎকার চেঁচামেচিতে সকালের ঘুমটা ভেঙে যেতো, এখন পাখিদের কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে। বিকেল হলেই কোকিলরা তাদের কুহুডাকের প্রতিযোগিতা শুরু করে যা স্বভাবতই জানান দেয় বসন্তটা এখনও শেষ হয়নি।

ইতিহাসের ছাত্রী হবার দরুন জেনেছি আদিম যুগের মানুষ কীভাবে সম্পূর্ণ নতুন এক পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখেছিলো। তারা মুলত পরিবেশের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেছিলো খুব সহজভাবেই, যেখানে আধুনিক সভ্যতা থেকে কয়োক যোজন দূরে থাকা মানুষের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিলো পরিবেশই। পোশাক, বাসস্থান, খাদ্য, আত্মরক্ষার জন্য হাতিয়ার—সবকিছুই মানুষ পরিবেশ থেকে পেয়েছিল। দুটো পাথরের ঠোকাঠুকিতে তারা আগুন আবিষ্কার করেছিল, ধীরে ধীরে সভ্যতার বিকাশ ঘটতে থাকল। সভ্য হবার পরে মানুষ নিজের তাগিদে, প্রয়োজনে বৃক্ষছেদন করতে শুরু করল। পরিবেশের উপরে শুরু হল মানুষের ধ্বংসলীলা। ফলস্বরূপ একটা গোটা সভ্যতা ধ্বংসের মুখে পড়ল। ধীরে ধীরে আদিম যুগ থেকে মানুষ আধুনিক যুগে এসে পৌঁছল।

কথায় আছে না, “history repeat itself”, সেই তত্ত্ব মেনেই আধুনিক পর্যায়ে এসেও শুরু হলো পরিবেশের প্রতি অত্যাচার। আর জ্ঞানত বা অজ্ঞানত আমরা পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ক্ষতিও ক্রমাগত করে যেতে লাগলাম। বাড়ল যানবাহন, বাড়ল কলকারখানা থেকে নিষ্কৃত দূষণের পরিমাণ, বাড়ল প্লাস্টিকের ব্যবহার, বাড়ল গাছ কেটে কংক্রিটের তৈরি মাথা উঁচু করা আবাসনের সংখ্যা। হ্যাঁ ক্রমশ হাঁপিয়ে যাবার মতনই এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম আমরা, যেখানে, ‘বিশুদ্ধ আবহাওয়া’ শুধুমাত্র দুটি শব্দে সীমাবদ্ধ থেকে গেল। যার ফলস্বরূপ পৃথিবী উষ্ণ হল, তাপমাত্রার হেরফের ঘটল, বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন ঘটল, শরীরের মধ্যে রোগ অসুখ বাসা বাঁধতে লাগল। তবুও আমরা আর সচেতন হলাম কই? বছরের একটা দিনে আমরা সাড়ম্বরে পরিবেশ দিবস পালন করলেও আদৌও পরিবেশের জন্য কি আমরা কিছু করেছি? এই প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়।

পরিবেশ থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে জীবন ধারণ করার কথা ছিল আমাদের। কিন্তু আমরা পরিবেশকে লুট করেছি। অতি দ্রুত গতিতে পরিবেশ পরিবর্তিত হয়েছে। দূষিত হয়েছে। পরিবেশ হয়েছে জরাক্রান্ত। ধবংস হয়েছে জীব বৈচিত্র্য। ফলে দৌরাত্ম্য বেড়েছে রোগ জীবাণুদের। তাই আজ আমরা ঘরবন্দি হয়েছি। চলছে না যানবাহন। বন্ধ শিক্ষালয়, কলকারখানা। তবে সাম্প্রতিক এই লকডাউনের ফলে পরিবেশ ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এখন গাছের পাতা পড়ার শব্দও শোনা যাচ্ছে। আমাদের সর্বতোভাবে উচিত পরিবেশকে ভালো রাখা, সুস্থ রাখা কিন্তু বিভিন্ন কারণে নানাবিধ ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও কোথাও না কোথাও খামতি থেকেই যায়। এই ব্যপারে জনসাধারণেরও উচিত নিজেদের সতর্ক ও সচেতন করা এবং পরিবেশ সম্পর্কিত নানারকম নিয়ম বিধি মেনে চলার সঙ্গে সঙ্গে বৃক্ষরোপনের কাজে এগিয়ে আসা। এছাড়াও জীবাশ্ম জ্বালানীর বহুমাত্রিক ব্যবহারও কমাতে হবে, তবেই আমরা পরিবেশকে বাঁচাতে পারব।

এই সময় যখন জনজীবন অচল, চারিদিক স্তব্ধ, রাস্তাঘাট সুনসান, সেই ফাঁকে পরিবেশও নিজেকে সাজিয়ে তুলছে প্রতিনিয়ত। পরিসংখ্যান অনুসারে বিশ্বের প্রথম তিরিশটি দূষণযুক্ত দেশের তালিকার মধ্যে ভারত একুশ নম্বর স্থানে আছে। কিন্তু এই সময়ের গাঢ় নীল আকাশ দূষণমুক্ত ভারত গড়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। পরিবেশবিদদের মতে বিগত দশ বছরের মধ্যে এইরকম নীল আকাশ সচরাচর তাঁরা দেখতে পাননি। সুতরাং, বোঝা যাচ্ছে দূষণটা যেহেতু মানবসৃষ্ট তাই একমাত্র নাগরিকরাই পারে এই দূষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে পরিবেশকে স্নিগ্ধ ও দূষণমুক্ত করে তুলতে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রালয়ের অন্তর্গত কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ(CPCB)-এর রিপোর্ট অনুসারে দুই সপ্তাহ আগে পর্যন্ত বাতাসে দূষণের পরিমাণ যে হারে বেশি ছিলো এই লকডাউন পরিস্থিতিতে সেই পরিমাণ এখন অনেকাংশেই কম। কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি-সহ সমস্ত মেট্রো সিটিগুলোতে যেখানে দূষণের পরিমাণ সব থেকে বেশি থাকে সেই সব জায়গায় আকাশ আজ পরিষ্কার।

খুব ছোটবেলাতে বাবার হাত ধরে যখন প্রথম চিড়িয়াখানাতে বেড়াতে গিয়েছিলাম, খাঁচাতে থাকা পশুপাখিগুলোকে দেখে খুব মজা পেয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আবদ্ধ জীবন সম্পর্কে অবগত হলাম। এই লকডাউনের সময় মানুষজনের এই গৃহবন্দির সুযোগে দেশের বেশ কিছু জায়গার রাস্তাঘাটে দেখতে পাওয়া গেলো পশুদের অবাধ বিচরণ। মূলত জনবহুল এলাকায় মানুষের ভয়েই হোক বা যানবাহনের ভিড়ের কারণে তাদের রাস্তায় সেভাবে দেখা যায় না।

এই তো কয়েকদিন আগেই সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে দেখতে পেলাম দেহরাদুনের রাস্তায় হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে। এছাড়াও উত্তরাখণ্ডের রাস্তাতেও সম্বর হরিণের দেখা মিলেছে। নয়ডার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো নীলগাই থেকে শুরু করে মুম্বই-এর মেরিন বিচের সমুদ্রে ডলফিনের খেলা করা—পুরোটাই এক অন্যরকম ঘটনা। এর থেকেই বোঝা যায়, দুষণমুক্ত পরিবেশ কতটা প্রয়োজন। তাই লকডাউনের পরেও যদি এভাবেই আমরা পরিবেশের প্রতি সদয় থাকতে পারি তাহলে হয়তো বা এরূপ দৃশ্য আমরা পরবর্তীতেও দেখতে পাবো এবং পরের প্রজন্মকে একটা সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ উপহার দিতে সক্ষম হব। মনে রাখতে হবে এই পরিবেশ যতটা মানুষের ঠিক ততটাই সেই পশুপাখিদেরও।

“একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে। বসতি আবার উঠবে গড়ে, আকাশ আলোয় ফুটবে ভোরে”। এই আশা তো আমরা রাখতেই পারি। মারণভাইরাসকে আমরা হারাবই। সঙ্গে নিজেদেরকেও পরিবর্তন করব। সকলের জন্য সুস্থ পরিবেশ গড়তে পারলেই আমরাও বাঁচব।

লেখক বিএড পাঠরত, মতামত নিজস্ব

West Bengal Lockdown Nature

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।