ব্রিগেডের মাঠে মিঠুনের মুখে শোনা যায় চিত্তরঞ্জন বন্দনা।
‘‘আমি গর্বিত আমি বাঙালি। ভুলে যাবেন না, এ বছর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ১৫০তম জন্মবর্ষিকী পালন করছি আমরা। ভুলে যাবেন না রানি রাসমণিকে, বিদ্যাসাগরকে। এঁরাই আসল বাঙালি। এঁরা সকলে বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ করতেন।’’ ব্রিগেডের জনতার সামনে রবিবার বাঙালি আবেগে টগবগে মিঠুন চক্রবর্তীর মুখে এমনই বাছা বাছা শব্দ উঠে এসেছিল। সেখানেই খাতায়কলমে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা হিসেবে অভিষিক্ত হলেন তিনি। বিধানসভা নির্বাচনের একমাসেরও কম সময় বাকি থাকতে প্রাক স্বাধীনতা পর্বের বাঙালি মনীষীদের ব্রিগেডের মাঠে টেনে আনা বিজেপির রাজনৈতিক কৌশলেরই অঙ্গ।
বাংলার মাটিতে ‘বহিরাগত’ ভাবমূর্তি ঝেড়ে ফেলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিজেপি। তাই লাগাতার দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, রানি রাসমণি এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম আউড়ে যেতে হচ্ছে তাদের। ভোটের আগে টুসকি মেরে কী ভাবে বিজেপি-কে বাংলার মানুষের ‘ঘরের লোক’ করে তোলা যায়, তার জন্যই মিঠুন’দা এবং গেরুয়া শিবির বাঙালি স্বাভিমানের সঙ্গে দলকে জুড়ে দিতে চাইছেন। তাঁরা বুঝেছেন, বহিরাগত তকমা গায়ে সেঁটে থাকলে কানাগলি পেরনো সম্ভব হবে না তাঁদের পক্ষে। তাই নির্বাচনী প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়ার রাস্তা প্রশস্ত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু সংক্রান্ত সংরক্ষিত নথিপত্র প্রকাশের পর থেকেই এই ‘বহিরাগত’ এবং ‘ঘরের লোক’ বিতর্ক রাজনৈতিক চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল এবং বিজেপি কর্মীদের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ চলাকালীন বিদ্যাসাগর কলেজে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙচুরের পর থেকেই সেই বিতর্ক তীব্রতর হয়ে ওঠে। দুই দলই মূর্তি ভাঙার দায় একে অপরের ঘাড়ে ঠেলে দেয়। আর সেই থেকেই বাংলা এবং বাঙালির সংস্কৃতির আসল উত্তরসূরি কে, তা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে দড়ি টানাটানির সূত্রপাত, যা এখনও চলছে।
ব্রিগেডে মিঠুনের বক্তৃতায় সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগরের উল্লেখ তারই ফলশ্রুতি। একই ভাবে কংগ্রেসের আরও এক মনীষীকে যে বিজেপি কব্জা করতে চাইছে, ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে বারংবার দেশবন্ধুর উল্লেখ তারই ইঙ্গিত। বিজেপি-র এই উদ্যমের পিছনে আরও একটি কারণ লুকিয়ে রয়েছে। খুব বেশি মানুষ যে ব্যাপারে ওয়াকিবহাল নন। তা হল, দেশবন্ধুকে আসলে রাজনৈতিক গুরু মানতেন নেতাজি। বাংলা ভাগের বিরোধিতা হোক বা স্বদেশি আন্দোলনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, নেতাজি এবং তাঁর ভাই, দু’জনেই চিত্তরঞ্জনের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। অধ্যাপক ইএফ ওটেনের সঙ্গে ধস্তাধস্তি নিয়ে যখন পরিস্থিতি তেতে উঠেছে, যার জন্য পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে নেতাজিকে বহিষ্কারও করা হয়, সেই সময়ও অন্য পড়ুয়াদের নিয়ে বাড়িতে বয়ে এসে রাতে খাবার টেবিলে চিত্তরঞ্জনের কাছে পরামর্শ চান নেতাজি। পরবর্তীকালে নেতাজি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে গেলেও সময় যত এগিয়েছে ততই দেশবন্ধুর সঙ্গে তাঁর গুরু-শিষ্য সম্পর্কে মজবুত হয়েছে। এমনকি, দেশবন্ধুর উপদেশ এবং তাঁর দেশভক্তিতে অনুপ্রাণিত হয়েই নেতাজি ইংল্যান্ড ছেড়ে ভারতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন বলেও শোনা যায়।
বসু পরিবারকে নিয়ে শিশির বসুর (নেতাজির ভাতুষ্পুত্র) লেখাতেও গুরু-শিষ্যের এই অটুট বন্ধনের কথা জানা যায়। জানা যায়, ১৯২৫ সালে বর্মার (অধুনা মায়ানমার) জেলের কুঠুরিতে বসেই দেশবন্ধুর মৃত্যুর খবর পান নেতাজি। তাতে এতটাই ভেঙে পড়েন তিনি, যে বেশ কয়েক দিন কেউ তাঁর কান্না থামাতে পারেননি। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর বাসন্তীদেবীরও (দেশবন্ধুর স্ত্রী) স্নেহধন্য হয়ে ওঠেন নেতাজি। বাসন্তীদেবীকে শুধু মায়ের মতো শ্রদ্ধাই করতেন না নেতাজি, ‘মা’ বলে ডাকতেনও। দেশবন্ধুর সঙ্গে অধুনা বাংলাদেশের সংযোগও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশবন্ধুর জন্ম কলকাতায় হলেও তাঁর পরিবার এসেছিলেন বিক্রমপুর (এখন বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত) থেকে। ১৯০৫ সালে প্রথম বার বঙ্গভঙ্গের সময় এবং তার পরবর্তী কালে বাংলায় স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকনির্দেশে বিরাট ভূমিকা ছিল দেশবন্ধুর। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। শুধু এপার বাংলার বাঙালিদের কাছেই নয়, ওপার বাংলার বাঙালিদের কাছেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দেশবন্ধু সমাদৃত। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে সমস্ত মানুষ পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একটা বড় অংশের মানুষ মুসলিম ছিলেন। তাঁরাও শ্রদ্ধার সঙ্গে দেশবন্ধুকে স্মরণ করেন। তাই দেশবন্ধুর শরণাপন্ন হলে আখেরে তাদেরই ফায়দা, সে কথা বুঝে গিয়েছে বিজেপি। তাই অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে স্থান-কাল বুঝে দেশবন্ধুকে স্মরণ করছে তারা, যাতে ওপার বাংলা থেকে আসা ৩ কোটি মানুষকে নিজেদের ভোটব্যাঙ্কে পরিণত করতে পারে। যার মধ্যে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটও শামিল। সাম্প্রতিক রাজনীতিতে মতুয়ারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। এঁদের পাশে পেলে নির্বাচনে ২০ শতাংশ ভোটে এমনিতেই এগিয়ে থাকা পাকা।
হাল না ছাড়া মনোভাবের জন্যই রাজনৈতিক ভাবে সফল বিজেপি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই নেতাজির ঐতিহ্য কার্যত ‘ছিনতাই’ করে নিয়েছে তারা। তাই এখন দেশবন্ধুকেও তারা নতুন মোড়কে হাজির করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ দেশবন্ধু একদিকে যেমন নেতাজির পথপ্রদর্শক এবং রাজনৈতিক গুরু, অন্য দিকে একটা বড় অংশের বাঙালি ভোটারদের মধ্যে এখনও তাঁকে নিয়ে আবেগ রয়েছে। অবিভক্ত বাংলা এবং তার সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখায় দেশবন্ধুর অবদান এখনও মনে রেখেছেন তাঁরা। দেশবন্ধুর মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। জাতীয়তাবাদী এবং দেশপ্রেমী হিসেবেই ‘দেশবন্ধু’ উপাধি অর্জন করেছিলেন চিত্তরঞ্জন। স্বদেশি আন্দোলনে নিজের সম্পত্তির অধিকাংশই বিলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তার মধ্যে ভবানীপুরের বাড়িটিও রয়েছে। পরবর্তীকালে ওই বাড়িতেই ক্যানসার হাসপাতাল গড়ে তোলে সরকার। যা এখনও চালু রয়েছে।
এই জাতীয়তাবাদ কি অনুসরণ করা সম্ভব বিজেপি-র পক্ষে? মানসচক্ষে যে বাংলার কল্পনা করেছিলেন দেশবন্ধু, বাংলাকে নিয়ে ২০২১ সালে বিজেপি-র পরিকল্পনা সম্পূর্ণ ভাবে তার পরিপন্থী। কিন্তু অবস্থান বিপরীত হওয়া সত্ত্বেও জোরপূর্বক নিজেদের সমমনস্ক প্রতিপন্ন করা থেকে কবেই বা বিজেপি-কে প্রতিহত করা গিয়েছে!
(লেখক দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের প্রপৌত্র। পেশায় কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী। রাজনীতিতে উৎসাহী। মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy