প্রতীকী ছবি।
একটানা চার-পাঁচ দিন দেশব্যাপী সমস্ত সংবাদপত্রিকার শিরোনাম জুড়িয়া থাকিলেন তিনি— ভেন্টিলেটরে জীবনের সহিত জুঝিতে থাকা অচেতন উন্নাও-কন্যার নিকট হয়তো ইহাই বিরাট সাফল্য। মেয়েটি যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়া যাইতে বাধ্য হইলেন, যে চরম নির্যাতন ভোগ করিল তাঁহার গোটা পরিবার, সেই প্রেক্ষিতে হয়তো ইহাই বিরাট প্রাপ্তি! তির্যকতা ভিন্ন গতি নাই, কেননা, সত্য বলিতে, সুবিচার বলিতে যাহা সচরাচর বোঝানো হয়, উন্নাও ঘটনায় আদৌ সেই বিন্দুটিতে পৌঁছনোর আশা শূন্য। ঠিকই, সংবাদ শিরোনামের ধাক্কায় বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিংহ সেঙ্গার দল হইতে বিতাড়িত হইলেন। রাজধানী হইতে শীর্ষ আদালত প্রশ্ন তুলিল, এ সমস্ত কী চলিতেছে দেশে! মামলা দিল্লিতে সরাইয়া লওয়া হইল। আদালতের নির্দেশ ধ্বনিত হইল, প্রতি দিন শুনানি করিয়া দেড় মাসের মধ্যে মামলার রায় দেওয়া চাই। হত্যার তদন্ত সাত দিনের মধ্যে শেষ করিতে বলা হইল সিবিআইকে। নিগৃহীতা ও তাঁহার আইনজীবীর সুরক্ষায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের কথা শোনা গেল। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, এই সমস্ত কিছুই ঘটিল কন্যা ও তাঁহার পরিবার সুবিশাল মূল্য চুকাইবার পর। ইতিমধ্যে বিধায়ক কর্তৃক মেয়েটি ধর্ষিত হইয়াছেন, ধর্ষণের তদন্ত হইতেছে না বলিয়া অভিযোগ তোলায় তাঁহার পিতাকে ভুয়া কারণে বন্দি করা হইয়াছে, জেলের অন্দরে তিনি ‘অজ্ঞাত’ কারণে মারা গিয়াছেন, পিতৃব্য লাঞ্ছিত হইয়াছেন, অভিযোগ না তুলিয়া লইলে মৃত্যু অনিবার্য এই মর্মে হুমকি বাড়িতে পৌঁছাইয়াছে, শেষ পর্যন্ত চলন্ত গাড়িকে ট্রাক দিয়া পিষিবার চেষ্টা হইলে মেয়েটির আত্মীয়া নিহত হইয়াছেন। গাড়িতে বসা গুরুতর আহত মেয়েটি নিজে এখনও ভেন্টিলেটরে, তাঁহার আইনজীবীও গুরুতর আহত, দুই জনের কেহ শেষ পর্যন্ত বিপন্মুক্ত হইবেন কি না জানা নাই। ঘটনা এত দূর গড়াইবার পর বৃহস্পতিবার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মেয়েটির মায়ের হাতে তুলিয়া দিলেন পঁচিশ লক্ষ টাকার চেক— ক্ষতিপূরণ। কাহার কী ক্ষতি এতদ্দ্বারা পূরণ করা হইল, জনগণমনই জানেন।
সুতরাং, অপরাধী সেঙ্গারকে উত্তরপ্রদেশ রাজ্য বিজেপি বহিষ্কার করিয়াছে, ইহা কোনও বড় খবর নয়। গোটা সময়কাল জুড়িয়া অত্যাচারিত মেয়েটির বদলে অত্যাচারীর সুরক্ষায় নিযুক্ত থাকিয়াছে রাজ্যের প্রশাসন ব্যবস্থা। প্রশাসনের উচ্চতম স্তর হইতে যে উন্নাওয়ের অপরাধীদের ঢাকিয়া রাখিবার চেষ্টা হইয়াছে। উত্তরপ্রদেশে নারীসুরক্ষা বহু কালই একটি সঙ্কটময় বিষয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা, সামাজিক প্রতিপত্তি এবং অপরাধবৃত্তের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগেও সে রাজ্য অনেক দিন দেশে অগ্রগণ্য। তবু স্বীকার করিতে হইবে, যোগী আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে এই সংযোগ এক ভয়ঙ্কর চেহারায় পৌঁছাইয়াছে। আদৌ সেখানে কোনও আইনের শাসন আর আছে কি না, তাহাই এখন প্রশ্ন। অসাংবিধানিকতার উত্তুঙ্গতা দেখিয়াও দলগত ভাবে এবং কেন্দ্রীয় শাসক হিসাবে বিজেপি চুপ করিয়া থাকিয়াছে। অপরাধের সহিত প্রশাসনের এই সহজ প্রত্যক্ষযোগ্য আঁতাঁতের পরও প্রশাসন অনায়াসে পার পাইয়া যাইবে। সুতরাং, সুবিচার কথাটি অর্থহীন।
অর্থহীন, নাগরিক অধিকার নামক ধারণাটিও। কয়েক মাস যাবৎ অত্যাচারিত পরিবারটির পক্ষ হইতে সুরক্ষার জন্য বহু অনুরোধ, কাকুতিমিনতি করা হইয়াছে প্রশাসনের কাছে। চিঠি লেখা হইয়াছে সুপ্রিম কোর্টেও। বিচারকদের কাছে সেই চিঠি পৌঁছয় নাই। কেন পৌঁছয় নাই, মেয়েটি ও তাঁহার আইনজীবী মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছিলে এত দিনে তাহার তদন্ত শুরু হইয়াছে, হয়তো কিছু শাস্তিদানও ঘটিবে। সত্যকারের সংযোগরক্ষাকারীরা তাহাতে বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ হইবেন না। তবু এই দেশ এখনও নিজেকে গণতান্ত্রিক বলিবে। এক পক্ষকালের মধ্যে স্বাধীন দেশের বাহাত্তর বৎসর পূর্ণ হইবার কথা— সেই প্রস্তুতি চলিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy