নারী সুরক্ষা নিয়ে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্কুলে বক্তব্য রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সে রকমই এক বক্তৃতার জন্য উত্তর প্রদেশের বারবাঁকি জেলার আনন্দ ভবন স্কুলে গিয়েছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এস গৌতম। ছাত্রীদের প্রতিবাদী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিলেন তিনি।
সেই সময়েই মুনিয়া কিদোয়াই নামে একাদশ শ্রেণির ছাত্রী উন্নাওয়ের প্রসঙ্গ তুলে প্রশ্ন ছুড়ে দেন পুলিশ অফিসারের উদ্দেশ্যে— ‘‘আপনি বলছেন, আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে, আওয়াজ তুলতে হবে। আমরা জানি, এক জন বিজেপি বিধায়ক এক কিশোরীকে ধর্ষণ করেছেন। কোনও সাধারণ ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এক বিষয়, কিন্তু কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে কী হবে তখন? আমরা জানি এ ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করলেও কিছু হবে না। আর যদি কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তা-ও কোনও কাজে আসবে না। ওই মেয়েটি এখন আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে।... আমরা সবাই জানি এটা দুর্ঘটনা নয়। ট্রাকটির নাম্বার প্লেটে কালো রং করা ছিল। যদি আমরা প্রতিবাদ করি, ন্যায়বিচার দিতে পারবেন আপনি? কী ভাবে আমার জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করবেন আপনি? কিছু যে ঘটবে না, তার দায়িত্ব কে নেবে?’’
এ প্রশ্ন শুধু ওই মেয়েটির নয় , এ প্রশ্ন ভারত গণতন্ত্রের প্রতিটি নারীর, যে আজ জন্মেছে জন্মভূমি সম্পর্কে কিছু না জেনেই তারও একই প্রশ্ন আইনের রক্ষকদের কাছে— দিতে পারবেন তো নিশ্চিত নিরাপত্তা? ‘যেখানে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’ আর প্রতিবাদীর জীবন নরক করে দেওয়া হয় প্রবল ভাবে বারবার।
কারণ ভারত নামক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতি দিন ১০৬ জন নারী ধর্ষিত হন, যার ১০ জনের মধ্যে চার জন নাবালিকা। আর শিশু ধর্ষণের যে পরিসংখ্যান সামনে এসেছে তাতে শীর্ষে আছে উত্তর প্রদেশ। আর মজার ব্যাপার হল, ভারতে প্রতি চার জন অভিযুক্তের এক জন মাত্র সাজা পায় আর বাকিরা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আইনের ফাঁকফোকর গলে ক্ষমতার সুকৌশল ব্যবহারে ছাড়া পেয়ে যায়।
উন্নাওয়ের সতেরো বছরের মেয়েটির উপরে নারকীয় ঘটনা ঘটে জুন ৪, ২০১৭। প্রশাসনের উদাসীনতায় দীর্ঘ এক বছর কারও নজরই পড়েনি। যে সময়ে কাঠুয়া নিয়ে সারা দেশ তোলপাড়, সেই সময়ে ৮ই এপ্রিল, ২০১৮, উন্নাও ধর্ষণকাণ্ড প্রকাশ্যে আসে যখন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বাড়ির সামনে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন মূল নির্যাতিতা ও তাঁর পরিবার। নির্যাতিতার বাবা কয়েক দিন পরে বিচারবিভাগীয় হেফাজতে মারা যান। বাধ্য হয়ে সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার তুলে দেওয়া হয়। ১১ই জুলাই, ২০১৮ সিবিআই প্রথম চার্জশিট দেয় মূল অভিযুক্ত বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গার সহ অন্যদের বিরুদ্ধে। যদিও জ্ঞাতসারেই সমস্যার গুরুত্ব নিয়ে উদাসীনতা দেখিয়ে এসেছে উত্তর প্রদেশ প্রশাসন ।
কিন্তু কে এই কুলদীপ সিং সেঙ্গার! ইনি চার বারের বিধায়ক। উন্নাও কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত । নব্বই দশকের শেষে কংগ্রেস দিয়ে যাঁর রাজনীতির কেরিয়ার শুরু, বহুজন সমাজ পার্টি হয়ে সমাজবাদী পার্টি ঘুরে চাপের মুখে সদ্য ভারতীয় জনতা পার্টি থেকে বহিষ্কৃত এবং দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত উন্নাওয়ের বিধায়ক থাকবেন তিনি। আসলে এই-জাতীয় ব্যক্তি রাজনীতির অলিন্দে বসে ক্ষমতার সিংহাসনে আসীন থাকতে প্রশাসন বোড়ে সাজায়। এবং পুলিশ-প্রশাসন সমাজের রক্ষক না হয়ে ভক্ষকগণের অঙ্গুলিহেলনে কাজ করে, কারণ তাদেরও সন্তানসন্ততি আছে।
মূল ঘটনার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ হলিউড বা বলিউডের যে কোনও প্রতিহিংসাপরায়ণ ছবির চিত্রনাট্যকে হার মানায়। নাগরিক মনে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সব ঘটনা কি নিছক কাকতালীয় দুর্ঘটনা হতে পারে? কারণ আইনের প্রহসন ও অপব্যবহার উন্নাও কান্ডের প্রতি পদে। কয়েক দিন আগে পর্যন্ত মামলা কোনও অদৃশ্য কারণে এক পা-ও এগোয়নি। উন্নাও কাণ্ডের নির্যাতিতার হয়ে এবং নির্যাতিতার বাবার পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর প্রতিবাদে আওয়াজ ওঠানোর জন্য ইতিমধ্যে তাঁর কাকাকেও ১৯ বছরের পুরনো কেসে জেলে চালান করা হয়েছে।
সর্বশেষ ভয়ঙ্কর ঘটনা গত রবিবার ২৯জুলাই। রায়বরেলি যাওয়ার পথে ভয়াবহ পথ দুর্ঘটনায় আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি উন্নাও কাণ্ডের অভিযোগকারিণী। মৃত্যু হয়েছে তাঁর দুই আত্মীয়ার। গুরুতর আহত তাঁর আইনজীবীও।
এই দুর্ঘটনার আগে রাজ্য সরকারকে প্রায় ৩৬টি চিঠি লিখেছিল অভিযোগকারিণীর পরিবারের সদস্যরা। প্রশাসনের কাছ থেকে একটিরও উত্তর আসেনি। প্রত্যেকটি চিঠিতে বলা হয়েছিল যে নিজেদের জীবনের আশঙ্কা রয়েছে তাঁদের, নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছেন তাঁরা। সুরক্ষা ও সাহায্য চেয়ে সরকারি আধিকারিক, রাজনৈতিক ও একাধিক পুলিশ অফিসারকে চিঠি লিখেছিলেন তাঁরা, জানিয়েছেন নির্যাতিতার মামা । নির্যাতিতার আইনজীবীও ‘আমাকে যে কোনও মুহূর্তে হত্যা করা হতে পারে’, এই আশঙ্কা থেকে প্রশাসনের সুরক্ষা চেয়েছিলেন।
নির্যাতিতার পরিবারের অভিযোগ, এই দুর্ঘটনা আসলে অভিযুক্ত বিজেপি বিধায়কের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। বিধায়ক ও তাঁর নয় সঙ্গীর বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছে। উন্নাও গণধর্ষণ কাণ্ডের নির্যাতিতার সঙ্গে হওয়া ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর সমস্ত ঘটনার তদন্তে পুলিশের ভূমিকা ন্যায়সঙ্গত নয়। গত এক বছরে মামলা এক ইঞ্চিও গড়ায়নি। আইনের প্রহসন ও উদাসীনতার চরম ভয়াবহ রূপ। প্রধান বিচারপতি গত কাল নির্দেশ দিয়েছেন, দুর্ঘটনার তদন্ত সাত দিন, খুব বেশি হলে পনেরো দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। লখনউতে চলা পাঁচটি মামলাই দিল্লিতে স্থানান্তরিত হল। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট গঠন করে প্রতি দিন শুনানি চালু রেখে ৪৫ দিনের মধ্যে শুনানি শেষ করতে হবে। পরিবারকে ২৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে শুক্রবারের মধ্যে। এবং নির্যাতিতা ও আইনজীবীর পরিবারকে সিআরপিএফের সুরক্ষা দিতে হবে।
নারীর সামাজিক নিরাপত্তা বর্তমান ভারতে একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্নের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পরিসংখ্যা বলছে, দিনে দিনে ভারতে নারীর উপর ধর্ষণ নামক পৈশাচিক অত্যাচারের সংখ্যা বাড়ছে, পৃথিবীর অন্য দেশের মানুষ আর ভারতকে নিরাপদ ভূমি হিসেবে ভাবছে না।
গণতান্ত্রিক ভারতের প্রধানের কাছে তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করতে হয়, কেন কুলদীপ সেঙ্গারের মতো লোকেরা রাজনৈতিক ক্ষমতার রক্ষাকবচ পায়, আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে আর নির্যাতিতদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে আইনের দরজায় দরজায় মাথা কুটে প্রমাণ করতে হয় তাঁদের উপর এই ভয়ঙ্কর নারকীয় ঘটনা ঘটেছে। সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত জীবনের অধিকার সমভাবে পাওয়ার অধিকার আছে দেশের প্রতিটি বেটির। তাই ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ শুধু মাত্র একটি স্লোগান না হয়ে বাস্তব হওয়া জরুরি।
না হলেও ভ্রূণ হতেই যার নিপাত শুরু হয় সেই বেটি যখন জন্ম নেয় এ দেশের মাটিতে, জীবনে চলার পথে শিকার হয় আদিম লালসার, মাথার উপর থেকে হারিয়ে যায় সুরক্ষার নিরাপদ আকাশ। নারীর জন্য এ নমস্য ভূমি তখন হয় বধ্যভূমি।
লেখক শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy