জগদানন্দ রায়।
এ ই ঘটনার পরে জগদানন্দের উপলব্ধি হয়েছিল মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করলে অল্প প্রয়াসেই সুশিক্ষা দান করা সম্ভব।
এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্যই তিনি তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক বইগুলি যথা— ‘প্রকৃতি পরিচয়’ (১৩১৮), ‘বৈজ্ঞানিক’ (১৩২০), ‘প্রাকৃতিক’ (১৯১৪), ‘গ্রহ নক্ষত্র’ (১৯১৫), ‘পোকামাকড়’ (১৩২৬), ‘বিজ্ঞানের গল্প’(১৯২০), ‘গাছপালা’(১৯২১), ‘পাখী’ (১৩৩১), ‘শব্দ’ (১৩৩১), ‘চুম্বক’ (১৩৩৫), ‘নক্ষত্র চেনা’ (১৯৩১), ‘বাংলার পাখী’ (১৯২৪), ‘মাছ, ব্যাঙ, সাপ’ (১৯২৩) ইত্যাদি বিজ্ঞান বিষয়ক বইগুলি ছাড়াও তাঁর রচিত অন্য সকল গ্রন্থই মাতৃভাষায় রচনা করেছিলেন। জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহার মতো বাঙালি বিজ্ঞানীররা যখন তাঁদের বিজ্ঞানের মূল গ্রন্থগুলি ইংরাজি ভাষায় লিখেছিলেন (হয়তো বাংলা ভাষায় তখন সে সব বিষয় প্রকাশের উপযোগী হয়ে ওঠেনি বলে লিখেছিলেন), সেখানে জগদানন্দ রায়ের গ্রন্থগুলি হয়ে উঠেছিল বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার এক অপূর্ব নির্দশন। এই অনন্যতাই তাঁকে করে তুলেছিল অন্য সকলের চেয়ে আলাদা। তাই রবীন্দ্রনাথকেও শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতে হয়েছিল—‘‘জ্ঞানের ভোজে এদেশে তিনিই সর্বপ্রথমে কাঁচা বয়েসের পিপাসুদের কাছে বিজ্ঞানের সহজ পথ্য পরিবেশন করেছিলেন।’’
শিক্ষাব্যবস্থায় একটি প্রচলিত ধারণা সকলেরই মনে আসে— ইনি বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, সমাজবিজ্ঞান, দর্শনের শিক্ষক হন তা হলে তিনি হবেন শিক্ষক হিসাবে ব্যর্থ। কেননা, প্রকৃত শিক্ষক কোনও বিশেষ বিষয়ের শিক্ষক হন না, গোটা মানুষটাই হন শিক্ষক। অর্থাৎ, সেই শিক্ষকের অধ্যয়ন-অধ্যপনা, কথাবার্তা, রসিকতাবোধ, আচার-আচারণ, তাঁর মুদ্রাদোষ সমস্ত মিলিয়ে যে ব্যক্তিত্ব, সেটিই হল তার শিক্ষক চরিত্র। মূল কথা হল এক জন শিক্ষককে নানা গুণে গুণান্বিত হতে হয়। প্রথম যুগের শান্তিনিকেতনের সমস্ত শিক্ষকেরা এই রকম একাধিক গুণের অধিকারী ছিলেন। কেউ ছিলেন সুলেখক, কেউ সুগায়ক, কেউ কুশলী অভিনেতা, আবার কেউ বা কথাবার্তায় সুরসিক। শিক্ষকদের এই সকল গুণের জন্য তো তাঁরা ছাত্রদের কাছে নায়ক হয়ে থাকতেন। জগদানন্দ রায়ও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না।
তাই তো তিনি শান্তিনিকেতনে শুধুমাত্র অঙ্ক, বিজ্ঞান শেখাতেন না। ক্লাসের শেষে ছেলেদের নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় গল্পের আসর বসাতেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ‘‘সন্ধ্যার সময় ছাত্রদের নিয়ে তিনি গল্প বলতেন। মনোজ্ঞ করে গল্প বলার ক্ষমতা তাঁর ছিল। তিনি ছিলেন যথার্থ হাস্যরসিক হাসাতে জানতেন। তাঁর তর্জনের মধ্যেও লুকানো থাকতো হাসি।’’ তার পর রাতের অন্ধকারে টেলিস্কোপ দিয়ে নক্ষত্র, ধূমকেতু চেনাতেন। রাত্রে কখন কোন ছেলে খাওয়াদাওয়া করল আর কোন ছেলে খাওয়াদাওয়া করল না, তার খোঁজখবর নিতেন। এ ছাড়াও শান্তিনিকেতনের যখন কোনও নাটক অভিনীত হত, তখন ছেলেদের সঙ্গে চুটিয়ে অভিনয় করতেন। এই সমস্ত গুণের জন্যই তো ক্লাসে যে সব ছাত্র তাঁর ভয়ে নির্বাক হয়ে থাকত, তারাই নাট্যমঞ্চে ‘লক্ষীপেঁচা বেরিয়েছে’ বলে (শারোদৎসব নাটকে অভিনয়ের সময়ে) চিৎকার করত।
শুধুমাত্র পড়াশোনার তদারকিতে নয়, শান্তিনিকেতনের প্রশাসনিক কাজও জগদানন্দ দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেন। তিনি অনেক দিন ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ের সর্বাধ্যক্ষ ছিলেন। আবার, প্রতিষ্ঠানটি চালাতে গিয়ে তহবিলের ঘাটতি পড়ত যখন, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জগদানন্দের কাছ থেকে ব্যয় সঙ্কোচের পরামর্শ নিতেন। পরবর্তী কালে যখন বিশ্বভারতী গঠিত হয়, তখন বিশ্বভারতীর সমস্ত বিভাগ পরিচালনার জন্য শান্তিনিকেতনের সচিব পদ সৃষ্টি করা হলে, কিছু দিন তিনি সচিব পদও সামলেছেন। জীবনের অন্তিম পর্বে তিনি বোলপুর ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্য এবং বোলপুর ইউনিয়ন বেঞ্চ কোর্টের তদারকি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। শুধুমাত্র শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রীদের নয়, বোলপুর ও তার আশেপাশের মানুষ জীবনে চলার পথে নানা সমস্যায় সুপরামর্শের প্রত্যাশায় তাঁর কাছে এলে তিনি সে সব মানুষের সমস্যা সমাধানের যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন।
জগদানন্দ রায়কে প্রথম জীবনে যে অভাব-অনটনের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল, জীবনের শেষের দিকে তাঁর সেই আর্থিক অভাব না থাকলেও চির দিনই তিনি সহজ-সরল, আড়ম্বরহীন জীবনযাপন করেছেন। যৌবনে ম্যালেরিয়া হয়ে প্রায়শই তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে যেত, যা তিনি নিজেই নিজের স্মৃতিচারণ বলেছেন— ‘‘আমি তখন ম্যালেরিয়া রোগী, স্বাস্থ্য কাহাকে বলে জানিতাম না। বৎসরের মধ্যে দশমাস শয্যাগতই থাকিতাম। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠে আম কাঁঠাল খেয়ে একটু সুস্থ বোধ করিলে আষাঢ়ে ম্যালেরিয়া ধরিত এবং তাহার জের ফাল্গুন-চৈত্রের পূর্বে শেষ হতো না।’’
প্রথম জীবনের শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন তাঁর স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হলেও শেষ জীবনেও রোগে ও পারিবারিক দুঃচিন্তায় তাঁর স্বাস্থ্যের আবার অবনতি হয়েছিল। একটি সূত্রে জানা যায় যে, যে দিন তাঁর বড় নাতনির বিয়ে, সে দিন যাতে তাঁর রক্তচাপ বেড়ে না যায়, তাই তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল ডাক্তারের পরামর্শে। শারীরিক দিক থেকে দুর্বল হলেও দীর্ঘ দিন ধরে শান্তিনিকেতনে একটানা নিরলস পরিশ্রম করে গিয়েছেন শুধুমাত্র মানসিক জোরের দ্বারা। জগদানন্দকে কেউ কেউ অতি রক্ষণশীল বলেছেন। সেটা অনেকাংশে সত্য হলেও সর্বাঙ্গসত্য নয়। কেননা তাঁর মধ্যে রক্ষণশীলতা থাকলেও দেশ এবং সমাজের জন্য যা যা যুগোপযোগী, তা মেনে নিতে কখনও দ্বিধাবোধ করেননি। জীবনের শেষ লগ্নে দেশ তাঁর আজীবন কাজের স্বীকৃতির জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ বাংলাভাষার অন্যতম পরীক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ‘রায়সাহেব’ উপাধিতেও ভূষিত করেছিল। এ ছাড়াও ১৩৩০ সনে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের নৈহাটি অধিবেশনে বিজ্ঞান শাখার সভাপতি নিযুক্ত হন। জীবনের বাঁচার রসদ পেয়েছিলেন যেখানে সেই শান্তিনিকেতনেই ১৩৪০ সনে ১১ আষাঢ় (ইংরেজির ১৯৩৩ সালে ২৫ জুন) চৌষট্টি বছর বয়েসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এক জন প্রকৃত শিক্ষকের শিক্ষাদান করা ছাড়াও যে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হতে হয়, জগদানন্দ ছিলেন তাঁর সার্থক উদাহরণ। পঠনপাঠন কালে তাঁর রুক্ষ-কঠিন মেজাজ অনেকে দেখলেও তাঁর অন্তরে ছিল অফুরন্ত প্রেম, ভালবাসা। তাই জগদানন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন— ‘‘আমার প্রয়োজন ছিলো এমন সব লোক, যাঁরা সেবাধর্ম গ্রহণ করে এই কাজে নামতে পারবেন, ছাত্রদের আত্মীয়জ্ঞানে নিজেদের শ্রেষ্ঠ দান দিতে পারবেন। বলাবাহুল্য, এ রকম মানুষ সহজে মেলে না। জগদানন্দ ছিলেন সেই শ্রেণীর লোক।’’
(শেষ)
ঋণ: জগদানন্দ রায়: বিশ্বভারতী
উদ্ধৃতির ভিতরে বানান অপরিবর্তিত
শান্তিপুর হরিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy