জঙ্গল থেকে শালপাতা সংগ্রহ। নিজস্ব চিত্র
যে পরগনা ও মহালগুলি নিয়ে জঙ্গলমহল জেলা তৈরি করা হয়, তার কিছু এসেছিল বীরভূম থেকে, কিছু বর্ধমান থেকে আর বাকিটা মেদিনীপুর থেকে। বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার (বিশেষত মানভূমের) বিস্তীর্ণ অঞ্চল তখন অন্তর্গত ছিল মেদিনীপুরের মধ্যে। পরে প্রশাসনিক কাজের সুযোগ সুবিধার স্বার্থে এই অঞ্চলের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। তবে তাতে জঙ্গলভূমির কোনও পরিবর্তন হয়নি।
১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এলএসএস ওম্যালি সাহেবের গেজেটিয়ারে এই অঞ্চলের সে কালের বনভূমি সম্পর্কে তথ্য দেওয়া রয়েছে। তখন অরণ্যভূমির প্রধান বৃক্ষ ছিল শাল, পিয়াল, পিয়াশাল, শিমুল, শিশু, শিরিষ, পলাশ, তাল, খেজুর, বাবলা আকাশমণি প্রভৃতি। সঙ্গে ছিল মহুল, কেন্দ, সিদা, কুসুম, ভালাই, বহড়া। ছিল বন্য আমগাছ, ছোট ছোট পড়াশি, কুরচি, বনতুলসি, কালমেঘ এবং জংলা ঘাসের ঝোপ। ছিল ওষধি গাছ হরিতকি, বহেড়া, আমলকি প্রমুখ। ওম্যালির রিপোর্ট থেকে জানা যায়, একদা এই অরণ্যে বাস করত চিতাবাঘ, হরিণ, বন্য বরাহ, সজারু, খরগোশ, ভালুক, নেকড়ে, খেঁকশিয়াল, শিয়াল, বনবিড়াল, গন্ধগোকুল, বনরুই প্রভৃতি। এ ছাড়া, মাঝে মাঝে হানা দিত হাতির দল। পাখির মধ্যে তিতির, কোয়েল, পায়রা, টিয়া, চড়ুই, বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙা, পেঁচা, শকুন ইত্যাদি প্রধান ছিল। এই অঞ্চলের স্বাভাবিক সরীসৃপ হল বহুরূপী, ঢোড়া সাপ, শাখামুটি, গোসাপ প্রভৃতি।
১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আনুক্রমিক সেটেলমেন্ট জরিপগুলি থেকে জানা যায় যে, অনেক বনভূমি নষ্ট করে কৃষিজমিতে পরিণত করা হয়েছিল। ফলত, জঙ্গলের পরিমাণ অনেকাংশেই কমে গিয়েছিল। পরিমাণ কমে গেলেও বর্তমানে কিছু কিছু পরিবর্তন ছাড়া জঙ্গলের মূল প্রকৃতি একই রয়েছে।
১৯৫২ সালের জাতীয় বননীতি অনুযায়ী, সমতল অঞ্চলে অন্তত ২৫ শতাংশ ও পার্বত্য অঞ্চলে ৫০ শতাংশ বন থাকা বাঞ্ছনীয়। তবে বর্তমানে এই পরিমাণ বনভূমির অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। বনভূমি কমে যাওয়ার মূল কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জঙ্গল কেটে আবাসগৃহ নির্মাণের ফলে কমছে জঙ্গলের পরিমাণ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে জঙ্গলভূমির পরিবর্তন ঘটিয়ে কৃষি জমিতে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। ইংরেজ আমলে ট্রেন লাইন পাতার প্রয়োজনে নির্বিচারে কাটা হয়েছিল শাল গাছ। ফলে, কমে গিয়েছিল জঙ্গলের পরিমাণ। আসবাবপত্র তৈরির প্রয়োজনে বৃক্ষচ্ছেদন এখানকার জঙ্গল কমে যাওয়ার আর একটি কারণ। কিছু অসাধু কাঠ ব্যবসায়ী গ্রীষ্ম কালে জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে বনভূমি নষ্ট করেন, এমন অভিযোগও ওঠে না, তা নয়।
এখানকার আদিম অধিবাসী তথা সাঁওতাল, ভূমিজ, কোড়া, শবরদের সংস্কৃতি, জীবন ও জীবিকা নির্ভর করত এই জঙ্গলকে কেন্দ্র করে। এখানকার বনভূমির প্রধান উৎপন্ন দ্রব্য ৫-১৫ সেন্টিমিটার ব্যাস বিশিষ্ট শালের খুঁটি। স্থানীয় ভাবে শালের খুঁটি ঘর নির্মাণের উপাদান হিসেবে, পান বরজের খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাকাবাড়ির দরজা তৈরিতে এবং আসবাব নির্মাণে শাল, শিমুল, সেগুন প্রভৃতি গাছের চাহিদা থাকায় এই জঙ্গল থেকে সেগুলি রফতানি করা হয়, যা স্থানীয় অধিবাসীদের রোজগারের পথ।
এই অঞ্চলের অধিবাসীরা বনভূমি থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করেন। এখানকার বনভূমি থেকে কাগজ শিল্পের কাঁচামাল পাওয়া যায়। কাগজের জন্য শাল কাঠ, ইউক্যালিপ্টাস কাঠ, বাবুই ঘাস, বাঁশ প্রভৃতি সরবরাহ হয় এখান থেকে। মধু এখানকার একটি উল্লেখযোগ্য বনজ সম্পদ। অন্য উপাদানের মধ্যে নিম বীজ, শাল বীজ, কুসুম বীজ, শাল গাছের আঠা—প্রভৃতি অর্থকরী উপাদান এই জঙ্গলের অধিবাসীদের জীবিকার চাহিদা অনেকাংশে মেটায়। মহুয়ার ফুল থেকে দিশি পানীয় তৈরি হয়, ফলকে ‘কচড়া’ বলে, যা আনাজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বীজ থেকে তেল তৈরি হয়। কেন্দুগাছের পাতা বিড়ি তৈরিতে কাজে লাগে। ফল বিক্রি হয়। শালগাছের পাতা থেকে থালা তৈরি হয়। অর্থনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি, এর পরিবেশবান্ধব গুণটিও বিবেচ্য। শিমুল তুলো লেপ-তোষক তৈরির জন্য ব্যবহৃত হওয়ায় এর চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া, কালমেঘ ও অন্য ভেষজ দ্রব্যের ওষধি মূল্য থাকায়, সে সব চড়া দামে বিক্রি হয়।
জঙ্গলের সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীদের শুধু জীবিকার প্রশ্নই নয়, জড়িত রয়েছে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিষয়ও। খেরওয়াল ধর্মে শালগাছ ‘সারি সারজম্’ বা সত্য শাল নামে প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের দেবতা মারাংবুরুর থান প্রতিষ্ঠিত হয় এই শাল বৃক্ষের গোড়ায়। চৈত্র মাসে অনুষ্ঠিত শালুই পূজা অনুষ্ঠিত হয় শালগাছকে কেন্দ্র করে। ইঁদ পরব হল শাল সংস্কৃতির একটি রূপ। অস্ট্রিক শব্দ ‘ইঁদ’-এর অর্থ হল শালগাছের গুঁড়ি। আর্য সংস্কৃতিতেও বৃক্ষকে দেবতা জ্ঞানে বন্দনা করার কথা বলা হয়েছে। গৌতম বুদ্ধ শ্রমণদের বৃক্ষ প্রতিপালনের নির্দেশ দিয়েছেন। জৈন ধর্মেও বৃক্ষের গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। জৈন দেবী অম্বিকার চিহ্ন সফলা আম্রবৃক্ষ। আদিবাসী শিকার পরবের মূলে রয়েছে জঙ্গল।
নিজেদের জীবিকা-ধর্ম-সংস্কৃতি জঙ্গলকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে জঙ্গল সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে খেরওয়াল ধর্মে। কিন্তু নগর সভ্যতার চাপে তা সম্ভব হয়নি। ফলে, বৃক্ষ শূন্য হয়ে গিয়েছে বাঁকুড়া পুরুলিয়ার কোনও কোনও অংশ।
গাছ কমছে, অরণ্যভূমি কমে যাচ্ছে। ফলে, জীবিকা-সঙ্কটের মুখে পড়ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পাশাপাশি, অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বৃক্ষের সঙ্গে যুক্ত ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক আচরণ। বৃক্ষ রোপণই পারে প্রকৃতির ফুসফুস অরণ্যকে ফেরাতে। সেই সঙ্গে জঙ্গলভিত্তিক বাসিন্দাদের জীবন, জীবিকা, ধর্ম এবং সাংস্কৃতিক আচরণ ফিরিয়ে দিতে।
লেখক বাঁকুড়ার সাহিতকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy