চেন্নাইয়ের জল সঙ্কটের পরে-পরেই সব সংবাদমাধ্যম, সমাজমাধ্যম, রাজ্য ও কেন্দ্রের নেতা-মন্ত্রীরা জল সংরক্ষণের কথা বললেন। সেই সময় গ্রামের এক বাড়িতে গিয়ে দেখি, সেই বাড়ির এক মহিলা সরাসরি পাম্পের জল চালিয়ে বাসন মাজছেন। বেশিরভাগ জল অপচয় হচ্ছে। আমি জল অপচয় করতে নিষেধ করলাম। মেয়েটি হাসলেন। সেই হাসি যেন বলে দিল, এতে দোষের কী আছে!
চেন্নাই তথা সারা ভারতের জলসঙ্কট আমাদের বিপদ সঙ্কেত দিয়ে গিয়েছে। আমরা নিশ্চয়ই অনুভব করতে পেরেছি, কী অনিশ্চয়তায় আমাদের দিন কাটছে। যে কোনও সময় আমাদের অঞ্চলেই মাটির নীচের জল শেষ হয়ে যেতে পারে। জলসঙ্কটে ভুক্তভোগীরাই জানেন, জলের কী গুরুত্ব। আমরা জেলার গাঁ-গঞ্জের জল সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিলে দেখব যে, সত্তরের দশকের প্রথম দিকে গ্রামের প্রতিটি ডোবা ও পুকুরে জল থাকত। সেই জল গৃহস্থের বাসন মাজা-ধোয়া, গবাদি পশুর পানীয় ইত্যাদি নানা কাজে ব্যবহৃত হত। নির্দিষ্ট কয়েকটি পুকুরের জল রান্নার কাজ এমনকি পানীয় জলের চাহিদাও মেটাত।
ওই সময়ে দেখা গিয়েছে, চাষিরা মাঠে চাষ করার সময় জমির জলই পানীয় হিসাবে ব্যবহার করতেন। তখন ভৌম জলের ব্যবহার ছিল সীমিত গ্রামের সম্পন্ন কয়েকটি গৃহস্থের বাড়িতে। সেখানে এক ইঞ্চি পাইপের নলকূপ ছিল। আর পঞ্চায়েত পরিচালিত দু’-চারটি সরকারি নলকূপেই সারা গ্রামের জলের চাহিদা মিটে যেত।
সবুজ বিপ্লবের পর থেকে শুরু হল ভৌমজলের পরিকল্পনাহীন ব্যবহার, সেই সঙ্গে যথেষ্ট রাসায়নিক সার, কীটনাশক, আগাছানাশকের ব্যবহার। ফলে, নীচে নামতে থাকল ভৌম জলের স্তর। চাষে ব্যবহৃত কীটনাশকের দাপটে ভূ-উপরিস্থিত জলে দেখা দিল চূড়ান্ত দূষণ। তখন একই সঙ্গে আরও একটি ঘটনা ঘটেছিল। গ্রামের সব পুকুর, ডোবাগুলি আগে নিয়মিত সংস্কার করা হত। সেখান থেকে পাঁক তুলে গরুর গাড়ির সাহায্যে জমিতে ফেলা হত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ডোবাগুলির সংস্কার একেবারে বন্ধ হযে গেল। অত্যন্ত খেদের বিষয় এই যে, আমার মা-জেঠিমারা যে পুকুরের জল বাসন মাজার কাজে লাগাতেন সে জল এখন আলকাতরাবর্ণ, দুর্গন্ধময়। ডোবায় জন্ম নিয়েছে অর্ধনিমজ্জিত উদ্ভিদ আর প্লাস্টিকের আস্তরণে তা প্রায় আস্তাকুঁড়ের চেহারা নিয়েছে। এখন বাসন ধোওয়া-মাজার কাজে বহু পরিবার মোটরচালিত জল ব্যবহার করে। স্বাভাবিক ভাবেই ভৌম জলের উপর চাপ পড়ে।
এ জেলার কীর্তিপুর গ্রামের মোট ৬৬টি ডোবা-পুকুর পুষ্করিণীর আকার আয়তন, মালিকানা, দাগ নম্বর, আগে অবস্থা কেমন ছিল, এখন কেমন আছে, মাছ চাষ হয় কি না, আগে কী কী মাছ চাষ হত, এখন কী কী হয় এ সব নিয়ে সমীক্ষা করা হয়েছিল। দেখা গিয়েছে, ৬৬টি পুকুরের মধ্যে ৩০ শতাংশ পুকুরের সংস্কার হয়েছে বা অবস্থা ভাল, ৩০ শতাংশ পুকুরের অবস্থা মোটামুটি বা খুব ভাল নয় বরং খারাপের দিকে আর ৪০ শতাংশ পুকুরের অবস্থা খুব খারাপ। যত দূর জানি, শুধু কীর্তিপুর নয়, জেলার বহু গ্রামের পুকুর-চিত্রটা কমবেশি এমনই।
মুর্শিদাবাদের বিলগুলি নিয়েও একই কথা বলা যায়। ব্যারাকপুর কেন্দ্রীয় ফিশারির সমীক্ষা অনুসারে, এ জেলায় বিলের সংখ্যা ৪৫। যার মধ্যে ভাগীরথীর পূর্ব প্রান্তে ২০টি ও পশ্চিম প্রান্তের ২০টি মোট ৪০ বিলের সমীক্ষা করেছি। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সংস্কারের অভাবে প্রায় সবকটি বিলেরই আয়তন অর্ধেক বা তারও কম হয়েছে, অর্ধেক হয়েছে জলের গভীরতাও। জল ঢোকা ও বেরোনো বন্ধ বলে বিলগুলি দূষণে জর্জরিত। আগে বিলের জল ব্যবহার করে কাছাকাছি জমিগুলিতে ধান চাষ হত। এখন জলের অভাবে বিলের পাড়গুলি কৃষিজমিতে পরিণত হয়েছে। এখন সেখানে মাটির নীচের জল তুলে চাষ হচ্ছে। নিশ্চিত ভাবে জল পেতে পাইপের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ বেড়েই চলেছে। জলস্তর যতই নামছে পাইপের দৈর্ঘ্য-প্রস্থও বাড়ছে। ফলে সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে। জলে আর্সেনিকের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। মুর্শিদাবাদের কয়েকটি ব্লকে আর্সেনিকের অস্বাভাবিক উপস্থিতি মিলেছে। সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, বিল মফিয়াদের দৌরাত্ম্যও।
গোমানি নদীর অস্তিত্ব বিলুপ্তপ্রায়, শিয়ালমারি, কালমন-খড়খড়ি, কান্দির কান্দর নদীগুলির বর্তমান অবস্থা মৃতপ্রায়। নদীর উপর তৈরি হয়েছে রাস্তা, কৃষিজমি, ফিশারি। যে সব নদীর জল মানুষজন আগে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করত তা আজ আর ব্যবহার করা যায় না। জলসঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পেতে সবচেয়ে জরুরি ‘জল সাক্ষরতা’ ও ‘জল সংরক্ষণ’। জল সাক্ষরতা হল জলের গুরুত্ব উপলব্ধি করে, পরিমিত জলের ব্যবহার করা। আর সংরক্ষণ হল একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি, যার অর্থ জলের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ বিবেচনা করে ব্যবহার করা। জল সংরক্ষণ একান্ত প্রয়োজন। জল সংরক্ষণের ধাপগুলি এমন
হতে পারে— ১) গ্রামের প্রতিটি ডোবা, পুকুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তরফে ১০০ দিনের কাজের মাধ্যমে আশু সংস্কার করা হোক যাতে গৃহস্থের বাড়ির বাসন মাজা ইত্যাদি কাজগুলো পাম্পের জলে না করে পুকুর, ডোবায় করা যেতে পারে। এতে ভৌম জলের উপর চাপ অনেক কমবে। পরিবেশও নির্মল হবে। এক দিকে জলসংরক্ষণ, অন্য দিকে মাছচাষও হবে।
২) ব্লকে ব্লকে অবস্থিত বড় বড় খাল-বিলগুলিও ১০০ দিনের কাজের মাধ্যমে সংস্কার করা হোক। খাল-বিলের জল দিয়ে চাষ-আবাদ চলবে। ভৌম জলের চাপ অনেক কমবে।
৩) জেলার যে সব নদী-নালা অবলুপ্তির মুখে বা যাদের অবস্থা খুবই খারাপ সেগুলি সংস্কার হলে সে জলে চাষ-আবাদের কাজ চলবে।
জেলা জুড়ে তিনটি ধাপে যদি পুকুর-ডোবা, খাল-বিল, আর নদ-নদী সংস্কার করে জল সংরক্ষণ করা যায় তবেই পূর্ণ হবে মুখ্যমন্ত্রীর ‘জল ধরো, জল ভরো’ প্রকল্প বা প্রধানমন্ত্রীর জল সংরক্ষণের স্বপ্ন। এতে ভূ-উপরিস্থিত জলের ব্যবহার বাড়বে, কমবে ভৌম জলের ব্যবহার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy