মহাকাশচারী ক্রিস্টিনা কোখ এবং জেসিকা মেয়ার
মহাকাশে হাঁটিয়া ইতিহাস গড়িলেন নাসা-র দুই নারী মহাকাশচারী ক্রিস্টিনা কোখ এবং জেসিকা মেয়ার। ‘স্পেসওয়াক’-এ নারীর যোগদান এই প্রথম নহে। কিন্তু দুই মহাকাশচারী লইয়া গঠিত দলে দুই জনই নারী, মহাকাশে হাঁটিবার ইতিহাস গত পঞ্চাশ বৎসরেও ইহা দেখে নাই। দুই মহিলা নভশ্চর স্পেসওয়াকে যাইবেন, নাসা-র ঘোষণা ইস্তক অভিনন্দন-বার্তার বান ডাকিয়াছিল। কিন্তু কার্যকালে উদয় হইয়াছিল অদ্ভুত সমস্যা, মহিলা মহাকাশচারীর পোশাক কম পড়িয়াছিল। সমস্যার সমাধান হইয়াছে, মিশনও সাফল্যমণ্ডিত।
কিন্তু প্রশ্নেরও অবধি নাই। মহিলা নভশ্চরের পোশাক কম পড়িল কেন? পুরুষ হইলে কি এই সমস্যার সৃষ্টি হইত? মহাকাশে যাইবার ন্যায় মহা গুরুত্বপূর্ণ কার্যেও কি তাহা হইলে পুরুষের অগ্রাধিকার? নাসা কি প্রকারান্তরে লিঙ্গবৈষম্যকে মদত দিতেছে না? সংশয়কে ইন্ধন জোগাইতেছে তথ্যও। বিগত পাঁচ দশকে পৃথিবীর সাড়ে পাঁচশতরও বেশি নভশ্চর মহাকাশে গিয়াছেন, তন্মধ্যে মাত্র পঁয়ষট্টি জন নারী। দুই সফল নারী নভশ্চরকে অভিনন্দন জানাইয়া হিলারি ক্লিন্টন স্মৃতিচারণ করিয়াছেন, কৈশোরে মহাকাশচারী হইবার ইচ্ছা জানাইয়া নাসা-কে পত্র লিখিলে উত্তর আসিয়াছিল, নাসা এই কার্যে মেয়েদের বিবেচনা করে না। সময় বদলাইয়াছে, ক্রিস্টিনা-জেসিকারাই প্রমাণ। কিন্তু নারী মহাকাশচারীর সংখ্যাই বলিয়া দিতেছে, মহাকাশ বিজ্ঞানের প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অদ্যাবধি পুরুষেরই প্রাধান্য। পুরুষের কথা মাথায় রাখিয়া, তাহার গড় উচ্চতা, ওজন ও অপরাপর শারীরিক বৈশিষ্ট্যের নিরিখেই মহাকাশচারীর পোশাক ও বিবিধ সরঞ্জাম তৈরি হইয়া আসিয়াছে। পুরুষের শরীরের তাপমাত্রা ও ঘর্ম নিঃসরণ অধিক, তাই পুরুষ নভশ্চরের পোশাকে দেহ শীতল করিবার বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হইয়াছে। একই পোশাকে নারী নভশ্চরের অস্বস্তি বোধ হইতে পারে, কেহ মনে রাখেন নাই। নারীরও রহিয়াছে স্বতন্ত্র শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য; মহাকাশযানের ভিতর মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে ঋতুমতী নারীদের অসুবিধা হইবে কি না, হইলে তাহার সমাধান কী, খোঁজ পড়িয়াছে অতি বিলম্বে। ১৯৮৩ সালে প্রথম মার্কিন নারী নভশ্চর হিসাবে মহাকাশে যাইবার অব্যবহিত পূর্বে স্যালি রাইডকে পুরুষ ব্যবস্থাপকগণ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, এক সপ্তাহের জন্য তাঁহার কতগুলি ট্যাম্পন (ঋতুস্রাব শোষক যন্ত্রবিশেষ) লাগিতে পারে?
ক্রিস্টিনা-জেসিকার সাফল্যে গর্ব করিবার পাশাপাশি তাই বিজ্ঞানক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্রের প্রাবল্যের দিকেও নজর ফিরাইতে হইবে। মহাকাশবিজ্ঞানে নারীর পর্যাপ্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ না পাইবার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নাই। বরং বিজ্ঞানই বলিতেছে, পুরুষ অপেক্ষা নারী নানান দিক দিয়া মহাকাশ ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত। শুধু শারীরিক ভাবেই নহে, মহাকাশে সম্পূর্ণ পৃথক পরিস্থিতিতে মানসিক চাপের মোকাবিলায় নারী অধিকতর সক্ষম, ইহাও পরীক্ষিত সত্য। নাসা সব দেখিয়া-শুনিয়া ভাবনায় বদল আনিয়াছে। নারী প্রযুক্তিবিদকে দিয়া তৈরি করাইয়াছে নূতন পোশাক। তাহা কেবল নারী নভশ্চরদেরই পরিধানযোগ্য নহে, বরং লিঙ্গনিরপেক্ষ। চন্দ্রভূমিতে পা রাখিয়া নিল আর্মস্ট্রং বলিয়াছিলেন, মানবের এই ক্ষুদ্র পদক্ষেপ বিরাট এক লম্ফের সমান। নভশ্চরদের অস্তিত্ব হইতে লিঙ্গপরিচয়টি মুছিয়া ফেলিবার পদক্ষেপটি করিলে মহাকাশবিজ্ঞানের ইতিহাস এক লম্ফে বহু দূর অগ্রসর হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy