—ফাইল চিত্র
গাছের ফোকর হইতে বুধো বোঁচকাসমেত মাটিতে হুড়মুড় করিয়া পড়িতেই উধোর সহিত তাহার ভয়ানক ঝটাপটি লাগিয়াছিল। কারণ, উধোর বোঝা হাতছাড়া করিতে বুধো নারাজ। ‘হ য ব র ল’ কাহিনির সেই কৌতুকময় দৃশ্য আজ বাস্তব। উন্নয়নের বিবিধ প্রকল্পের বৃহৎ পোঁটলাটি লইয়া কাড়াকাড়ি লাগিয়াছে কেন্দ্র ও রাজ্যে। রাজ্য নূতন প্রকল্প ঘোষণা করিবামাত্র দিল্লি দাবি করিতেছে, ইহা কেন্দ্রেরই প্রকল্প। কেন্দ্রই তাহার অধিকাংশ খরচ বহন করিয়াছে। রাজ্য কেবল নামটি বদলাইয়া গোটা প্রকল্পটি আত্মসাৎ করিতে চায়। অপর দিকে, কেন্দ্র বঙ্গবাসীকে কোনও প্রকল্পের সুবিধা দিবার অঙ্গীকার করিলেই রাজ্য নালিশ করিতেছে, বহু পূর্বেই তাহা পৌঁছাইয়াছে রাজ্য সরকার। কেন্দ্র শুধু ভোট পাইবার উদ্দেশ্যে নাম কিনিতে চায়। দুই পক্ষেরই শীর্ষ নেতারা আস্তিন গুটাইয়াছেন— এবং, তাঁহাদের কথায় যে জট পাকাইয়াছে, তাহা খুলিবার সাহস অধস্তন মন্ত্রী-আমলাদের নাই। তবু আন্দাজ হইতেছে, সব নূতন প্রকল্পেই অনেক পুরাতন ঢুকিয়া আছে। কখনও একই প্রকল্পের দুইটি নাম, কখনও যমজ প্রকল্প পাশাপাশি চলিতেছে। যেমন, কেন্দ্রের অন্ধত্ব নিবারণ প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও রাজ্য ‘চোখের আলো’ প্রকল্প ঘোষণা করিল। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা অর্ধেকই খরচ হয় নাই। তাহা হইলে রাজ্য তাহার নিজস্ব টাকা কেন বরাদ্দ করিল? ইহা কি অপচয়ের সময়?
তড়িঘড়ি উন্নয়ন ‘করিয়া দেখাইবার’ আগ্রহে দুই তরফেই বহু ভ্রান্তি ঘটিতেছে। কেন্দ্রের তথ্যেই প্রকাশ, ‘পিএম কেয়ার্স’-এর সুবিধা পাইয়াছেন বহু সম্পন্ন ব্যক্তি। একই অভিযোগ স্বীকার করিয়াছে এ রাজ্যের শাসকদল, আমপানের ক্ষতিপূরণ লইয়া জনরোষের পরে। ইহা ভ্রান্তি না কি দুর্নীতি, সেই বিবাদ চলিবে। কিন্তু সরকারি অর্থ খরচে অসতর্কতা ক্ষমার যোগ্য নহে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকিবে, ইহাই প্রত্যাশিত। এক সময়ে সেই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শিক্ষা, পুষ্টি, স্বাস্থ্যের মতো উন্নয়নের মৌলিক বিষয়গুলি দাখিল করিতে উৎসাহী হইয়াছিলেন নাগরিক সমাজের একটি অংশ। ভাবা হইয়াছিল, উভয় পক্ষ যদি প্রতিযোগিতা করিয়া উন্নয়ন করে, তাহাতে দেশের লাভ। আশি ও নব্বইয়ের দশক ধরিয়া উন্নয়ন মাপিবার বহুবিধ সূচক নির্মিত হইল। তাহার প্রয়োগে সারা বিশ্বে সরকারের সাফল্যের মূল্যায়ন হইল। স্কুলপড়ুয়াদের সাইকেল, বিনামূল্যে ঔষধ স্থান পাইল নির্বাচনী ঘোষণায়। বিরোধীরা প্রসূতিমৃত্যু কিংবা স্কুলছুটের পরিসংখ্যান লইয়া সরকারকে বিঁধিতে লাগিলেন। আশা ছিল, সূচকে উন্নতি আনিতে হইলে জনমুখী, তৎপর প্রশাসন আসিবে, উন্নয়ন হইবে। কার্যক্ষেত্রে ঠিক তেমনটি হয় নাই। উধোর হুঁকা এবং বুধোর পোঁটলা লইয়া যুদ্ধের ন্যায়, দুই পক্ষ আপন আপন পরিসংখ্যান লইয়া পরস্পরকে আক্রমণ করিতেছে।
উন্নয়নের হিসাব চাহিলে সরকারি কর্তারা প্রকল্পের বরাদ্দ ও ব্যয়ের হিসাব ধরাইয়া দেন। বাস্তবের সহিত তাহার মিল পাওয়া কঠিন। যেমন, রেশনে চালের বরাদ্দ বাড়িয়াছে— ক্ষুধা, অপুষ্টিও বাড়িয়াছে। রাজ্যে একশো দিনের কাজ বাড়িয়াছে, ভিন্ রাজ্যগামী শ্রমিকও বাড়িয়াছে। সেচসেবিত এলাকা বাড়িয়াছে, ভূগর্ভের জলের ব্যবহারও বাড়িয়াছে। রাজ্যবাসী অবশ্য হিসাব কষিয়া উন্নয়ন মাপিতে যান না— খাবারের থালি, সন্তানের মুখটি দেখিলেই তাহা বুঝিয়া যান। উন্নয়নের বোঁচকার মালিকানা লইয়া তাঁহাদের আগ্রহ নাই, কৌতূহল ভিতরের বস্তু লইয়া। তবে কি বিনা পয়সায় চশমা মিলিবে? বিমার কার্ড দেখাইয়া অপারেশন হইবে? দুঃস্থ পড়ুয়া বৃত্তি পাইবে, ভাতা পাইবেন বৃদ্ধরা? ‘কাটমানি’ কত দিতে হইতে পারে? উন্নয়নের পুঁটুলি যাহারই হউক, তাহা হইতে কানাকড়ি আদায় করিতে বহু মূল্য চুকাইতে হয় দরিদ্রকে। ভোট তাহার একটি মুদ্রা মাত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy