Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

খাল কেটে রাখলে কুমির আসবে

জনজাতি এলাকার এ-কাহিনি ভোটের আগের। ভোটের ফল ঘোষণার ঠিক পরের একটা গল্প বলি। এ-বারেরটা পুরোদস্তুর বাঙালি এলাকা।

সন্দীপন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৮ ০৬:১০
Share: Save:

বাজারের এক পাশে ঘুপচি কার্যালয়। ভোটের আগে সে-দিন ব্যস্ততা তুঙ্গে। তিনটে ফোন হাতে এবং কানে নিয়ে জেলার নানা প্রান্ত থেকে সমাবেশমুখী গাড়ির হিসাব রাখার আকুল চেষ্টা করে যাচ্ছে মধ্য-কুড়ির এক যুবক। ফোনে অনর্গল ককবরক সংলাপের ফাঁকে যুবক টুকরো টুকরো জবাব দিচ্ছিল আগন্তুক সাংবাদিককেও। কী দাবি তোমাদের? কেন, তিপ্রাল্যান্ড! কিন্তু এখানে তো বাঙালি আর জনজাতি মিলেমিশে থাকে। এর মধ্যে আলাদা রাজ্য বার করা হবে কী ভাবে? যুবকের জবাব, আমাদের মানচিত্র আছে তো তিপ্রাল্যান্ডের। দেখেননি? একটা দেব আপনাকে। আচ্ছা, আলাদা রাজ্য হলে কী উপকার হবে তোমাদের? এ বারের জবাব: আগরতলার কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছি। স্কুল শিক্ষকের চাকরির জন্য আবেদন করেছি। কিছু তো হয়নি এখনও। আইপিএফটি-তে কাজ করে কিছু টাকা পাচ্ছি। আলাদা রাজ্য হলে চাকরি তো পাব!

জনজাতি এলাকার এ-কাহিনি ভোটের আগের। ভোটের ফল ঘোষণার ঠিক পরের একটা গল্প বলি। এ-বারেরটা পুরোদস্তুর বাঙালি এলাকা। জমানা পালটে যাওয়ার পরে পুরনো শাসক দলের কার্যালয় ভাঙচুর ও দখল হচ্ছে, আক্রান্ত এলাকা ঘুরে দেখতে বেরিয়েছেন সিপিএমের রাজ্য নেতারা, সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির নেতৃত্বে। মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের এক বেদখল হওয়া কার্যালয়ের সামনে এক অটো-চালক রাস্তায় হঠাৎই প্রণাম ঠুকলেন সদ্য-প্রাক্তন মন্ত্রী মানিকলাল দে-কে। মনে আছে কাকু? চাকরির জন্য গিয়েছিলাম। কাটিয়ে দিয়েছিলেন! এখন অটো চালাই।

দুটো আপাত-তুচ্ছ কথোপকথন থেকেই ত্রিপুরার বৃহত্তর ছবিটা স্পষ্ট। জমি পেয়েছি, ঘর পেয়েছি, আলো পেয়েছি, স্কুল-কলেজ পেয়েছি, কিন্তু চাকরি? উত্তর খুঁজতে হন্যে ছোট্ট এই রাজ্যের সিংহভাগ তরুণতরুণী উলটে দিলেন ২৫ বছরের যত্নলালিত একটা সরকার! হিন্দি বলয়ের শক্ত ঘাঁটিতে পর পর ধাক্কা খেতে থাকা বিজেপির খুঁটি এক অপরিচিত তালুকে পোঁতা হয়ে গেল শক্ত করে।

চাকরির আকাল এক দিনে হয়নি নিশ্চয়ই। তা হলে ত্রিপুরায় গত কয়েক বছরের কোনও নির্বাচনে সেই ক্ষোভের প্রতিফলন লাল দুর্গের প্রাচীরে ফাটল ধরাল না কেন? বিধানসভা নির্বাচনে এসে কেন একেবারে উলটে পড়ল দুর্গ? উত্তর, বিজেপি! উষ্মা, ক্ষোভ, হাহাকার আগেও ছিল। কিন্তু আগেকার বিরোধী শক্তি কংগ্রেস বা তৃণমূল কখনও এই ব্যাধি উপশমের জন্য কোনও জাদু-মলমের বিজ্ঞাপন করেনি! বিজেপি এ বার এল এবং এসে ঘোষণা করল, ‘প্রতি ঘরে চাকরি’! কেন্দ্রের দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসক দল বলছে যখন, কিছু উপায় নিশ্চয়ই হবে, আর না হলেও বা কী— এত দিনও তো কিছু হয়নি, নতুন দলকে এক বার সুযোগ দেওয়া যাক! অকেজো হয়ে গেল বাকি সব হিসাবনিকাশ!

নির্বাচনের ফল ত্রিপুরায় এক দীর্ঘ জমানা এবং সেই সঙ্গে এক ঘরানার বদল ঘটিয়েছে ঠিকই। কিন্তু তাতে বামফ্রন্টের যাবতীয় কৃতিত্ব নস্যাৎ হয়ে যায় না। সত্যিই তো, সাক্ষরতার হারে দেশের মধ্যে শীর্ষে পৌঁছেছে ক্ষুদ্র এই রাজ্য। সত্যিই তো, দুর্গমতার অন্ধকার পেরিয়ে পাহাড়ি, জনজাতি এলাকায় গ্রামের সঙ্গে গ্রাম জুড়ে ফেলেছে রাস্তা। সত্যিই তো, ভূমিহীন কৃষকের হাতে উঠেছে জমির অধিকার। সত্যিই তো, পরিষেবার পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসনের অধিকারে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে জনজাতি এলাকাকে। সত্যিই তো, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মোকাবিলা করে বাঙালি-জনজাতির মধ্যে সৌহার্দ্য রেখে এই একটা রাজ্যই কেন্দ্রীয় সরকারকে বলতে পেরেছে, আমরা শান্তি এনেছি। আমাদের আর সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন (আফস্পা) চাই না। সংগ্রামের অনেক পথ পেরিয়ে আর্থ-সামাজিক সূচকে রাজ্যটা উপরের দিকে উঠেছে। কিন্তু তার পর?

জম্পইজলার বাজারের ওই জনজাতি যুবক বা রাধানগরের সেই অটো-চালক, তাঁরা তো জন্মেছেন শান্তির ত্রিপুরায়! গ্রামেও টিনের চাল দেওয়া পাকা বাড়ি, পাকা রাস্তা, স্কুল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র এঁরা তো বছরের পর বছর দেখছেন। অনিবার্য ভাবেই এ বার তাঁদের আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে। অশান্তির দিন যাঁরা দেখেননি, শান্তির আর বিশেষ কী তাৎপর্য আছে তাঁদের কাছে? তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, বামফ্রন্ট কী করেছে? তাঁদের কাছে ভাল থাকার সংজ্ঞা সময়ের সঙ্গে বদলেছে, বামফ্রন্টের প্রতি মানুষের কৃতজ্ঞতাও মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধের মতো অকেজো হয়েছে!

প্রাথমিক চাহিদা পূরণ করে মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার যে বাম দর্শন, তাতে এই চিরবর্ধমান বাসনা আসলে অধরা থেকে গিয়েছে স্থানকালপাত্র নির্বিশেষেই। বাংলায় যেমন ভূমি সংস্কার করে বর্গাদারকে অধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব বামফ্রন্টের। কিন্তু তার পর? হিরন্ময় নিদ্রা! সে নিদ্রা ভেঙে তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু সেখানেও এত তাড়াহু়ড়ো এবং এত অ-পরিকল্পনা যে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ঘটে গিয়ে গোটা জমানারই ইতি! মানিক সরকারের রাজ্যে কোনও সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ঘটেনি। কিন্তু বিজেপি নামক আগ্রাসন এসে তাঁর দুর্গ ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে!

যে রাজ্যের মোট বাজেটের আয়তন ১৬ হাজার কোটি টাকা, সেখানে ঘরে ঘরে চাকরি কী ভাবে সম্ভব— জানা নেই কারও। বেসরকারি বিনিয়োগ যেখানে নেই, সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সুদিন ফেরাতে কোনও চেষ্টা হবে কি না— জানা নেই কারও। তবু গণ-হতাশার সন্ধান পেয়ে প্রচারে সব ভাসিয়ে নিতে কার্পণ্য করেনি বিজেপি! ভোটের আগে সে রাজ্যের সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলে বিজ্ঞাপন আর সংবাদের ভাষ্য আলাদা করা যায়নি! বাসনাজর্জর জনমন কী চাইছে, দ্রুত বুঝে নিয়ে আশ্বাসের বন্যা বইয়ে দিয়েছে গেরুয়া শিবির!

এই অসম প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় কী করেছে বামফ্রন্ট? আমাদের মুখ্যমন্ত্রী সৎ, গরিব এবং ভদ্রলোক। অতএব, যা-ই ঘটে যাক, আমরা ঠিক জিতে যাব— এই মনোভাবে বামফ্রন্টকে বড্ড স্থবির মনে হত! টানা ২৫ বছরে প্রশাসনের নানা স্তরে ঢুকে যাওয়া দুর্নীতি, শাসক দলের নেতা-কর্মীদের কিছু অংশের ঔদ্ধত্য— এ সব ভূত তো একা সৎ মুখ্যমন্ত্রীর ভাবমূর্তি দিয়ে ছাড়ানো যেত না। গত বছর অসম-আগরতলা জাতীয় সড়ক যখন ১০ দিন ধরে অবরোধ করে রাখল আইপিএফটি, কড়া পদক্ষেপের দিকে যায়নি মানিকবাবুর সরকার। ভাবা হয়নি, এই অপেক্ষার কৌশল জনমানসে প্রশাসনিক দুর্বলতারই বার্তা দেয়। খাল তাই তৈরি হয়েই ছিল। যে খাল দিয়ে বিস্তর টাকার পুঁজি নিয়ে গেরুয়া কুমির এসে বামেদের জল-ছাড়া করেছে!

লক্ষণীয়, ইয়েচুরি-প্রকাশ কারাট-মানিকবাবুরা কেউ সত্য অস্বীকার করছেন না। বিপর্যয়ের মুহূর্তে দলের সাধারণ সম্পাদক এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রাস্তায় বেরিয়ে আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ভোটে হেরে গেলাম মানে সবই তো শেষ, এই মতিভ্রমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েননি! ত্রিপুরার নতুন শাসকেরা যে পাহাড়প্রমাণ প্রতিশ্রুতি বিলিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন, পথে নেমে বাস্তবে তার হিসাব মিলিয়ে নেওয়াই তাঁদের এখন কাজ। আগে তাঁরা কুমির-ভয় জয় করুন, তার পরে না হয় ভবিষ্যতের জন্য খালটা বোজাবেন!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy