সম্প্রতি প্রকাশিত হল চতুর্থ হ্যান্ডলুম সেন্সাস রিপোর্ট। রিপোর্টটি এক দিকে তৈরি করেছে জটিল ধাঁধা, অন্য দিকে উস্কে দিয়েছে বেশ কিছু বেয়াড়া প্রশ্ন। জানা যাচ্ছে, ২০১০ সালের পরে ভারতে প্রায় ৪ লক্ষ তাঁতি পরিবার বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন তেমন পরিবারের সংখ্যা ৩১.৫ লক্ষ। এবং, আজও শতকরা ৬৬ ভাগ তাঁতির মাসিক আয় ৫০০০ টাকারও কম। কেন গ্রামীণ ভারতের মানুষ গত দশ বছরে এমন এক জীবিকা বেছে নিচ্ছেন যাতে আয় নিতান্তই কম, এমনকি আইনানুগ ন্যূনতম মজুরির চেয়েও কম? রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, গত দশ বছরে তাঁতিদের এই সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের যথাযথ রূপায়ণের ফলে। এবং, ২০০৯-১০ সালের সেন্সাসের তুলনায় এই বার দেখা যাচ্ছে, মাসিক ৫০০০ টাকার বেশি আয় করছেন, এমন তাঁতির সংখ্যা বেড়েছে। ২০০৯-১০-এর ৫০০০ টাকার সঙ্গে অবশ্য ২০১৯-এর ৫০০০ টাকার তুলনা চলে না।
প্রশ্ন অনেক। প্রথমত, ২০০৯-১০ সালে প্রকাশিত হ্যান্ডলুম সেন্সাস রিপোর্ট জানিয়েছিল, ১৯৯৫-২০১০ সালের মধ্যে প্রায় ৩ লক্ষ তাঁতি পরিবারের সংখ্যা কমেছে। বলা হয়েছিল, তাঁতি পরিবারের পরের প্রজন্মের মধ্যে তাঁতশিল্পে আসার ইচ্ছা খুবই কম। তা হলে, ২০১০ সালের পর থেকে এমন কী ঘটল, যাতে প্রায় চার লক্ষ পরিবার তাঁত শিল্পে ঢুকল? দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রকের ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষের বাৎসরিক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০১৩-১৪ সালে গোটা দেশে হ্যান্ডলুম বা হস্তচালিত তাঁতে তৈরি মোট কাপড়ের পরিমাণ ছিল ৭১০৪ মিলিয়ন বর্গ মিটার। ২০১৭-১৮ সালে তা কমে হয়েছে ৫১৩৪ মিলিয়ন বর্গ মিটার। ২০১০ সালের পর হ্যান্ডলুমের উৎপাদন কখনও এতটা কম হয়নি। তাঁতির সংখ্যা সত্যিই বাড়লে উৎপাদন কমে যাচ্ছে কেন? তৃতীয়ত, হ্যান্ডলুম ক্ষেত্রের জন্যে বাজেট বরাদ্দ কমছে। ২০১৪-১৫ সালে যেখানে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৬২১.৫১ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ সালে তা কমে হয়েছে মাত্র ৩৮৬.০৯ কোটি। এক দিকে তাঁতির সংখ্যার বৃদ্ধি; অন্য দিকে তাঁতশিল্পে কম রোজগার, উৎপাদন হ্রাস পাওয়া আর বাজেট বরাদ্দ কাটছাঁট— বেশ জটিল ধাঁধাই বটে।
তাঁতিদের সংখ্যা বাড়লে সেটা কি গ্রামীণ অর্থনীতির পক্ষে সুসংবাদ? তাঁত শিল্পে দক্ষতার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। কাপড় বোনার শিক্ষালাভ মূলত হয়ে থাকে বংশানুক্রমিক ভাবে, বাড়ি থেকেই। অন্য পেশা থেকে হঠাৎ করে এই পেশায় এসে দক্ষতা লাভ করা এবং যথেষ্ট পরিমাণে রোজগার করতে পারা এক প্রকার অসম্ভব। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শিল্পী’ গল্পে মদন তাঁতি গামছা বুনতে অস্বীকার করেছিল, কারণ তাতে মজুরি অত্যন্ত কম। আবার বহু গবেষণায় প্রমাণিত, এক জন তাঁতশিল্পীর পক্ষে দক্ষ হয়ে উঠে দামি কাপড় বুনতে না পারলে রোজগার বাড়ানো অসম্ভব। গবেষণায় এটাও দেখা যাচ্ছে যে মাঝারি মানের কাপড় বুনেও কোনও তাঁতির পক্ষে ন্যূনতম মজুরির চেয়ে বেশি আয় করা বেশ কঠিন কাজ। উচ্চ বা অতি উচ্চ মানের ও দামি কাপড় বোনার সঙ্গে যুক্ত অত্যন্ত দক্ষ তাঁতিদের পক্ষেই শুধুমাত্র ন্যূনতম মজুরির গণ্ডি ডিঙোনো সম্ভব।
২০১০ সালের পরের দশকে তিনটি নীতির ধাক্কা অসংগঠিত শিল্পের গায়ে প্রবল ভাবে লেগেছে— নোট বাতিল, জিএসটি, এবং এনআরসি। সেন্সাস রিপোর্ট অনুসারে তাঁতিদের সংখ্যার নিরিখে ভারতে শীর্ষস্থানে রয়েছে অসম। সেখানে এনআরসি-র প্রভাবের কথা এই রিপোর্টেও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। নোট বাতিল বা জিএসটির ফলে প্রবল অসুবিধা তাঁতিদেরও পোহাতে হয়েছে। হস্তচালিত তাঁতে উৎপাদন কমে যাওয়া কি এই নীতিগুলির কারণেই? নিঃসংশয়ে বলার জন্য বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন, কিন্তু সম্ভাবনাটি লক্ষণীয়
তাঁতশিল্পে মহিলা তাঁতির সংখ্যা নেহাত কম নয়। বিশেষত, তাঁতে বুনন শুরুর আগে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রারম্ভিক কাজ বাড়ির মহিলারাই করে থাকেন। রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে এই ধরনের কাজ করার মাধ্যমেই তাঁতশিল্পে সংযুক্ত মহিলাদের ক্ষমতায়ন সম্ভব হচ্ছে। বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলে। এই কাজগুলি মহিলারা করে থাকেন বিনা পারিশ্রমিকে, বা নামমাত্র পারিশ্রমিকে। গবেষণায় ও ক্ষেত্র সমীক্ষায় দেখা যায় যে, পরিবারের সব দায়দায়িত্ব পালন করার পর কার্যত বিনা পারিশ্রমিকে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে তাঁতের কাজে সাহায্য করলেও পরিবারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মহিলাদের অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয় না। তাঁতশিল্পেও মহিলাদের শ্রম অনেক ক্ষেত্রেই ‘কাজ’ হিসেবে মর্যাদা পায় না। পারিশ্রমিক পেলেও হয়তো তা বাড়ির পুরুষ তাঁতির মজুরির মধ্যেই ধরা থাকে। মহিলারা হাতে সে টাকা পান না। ফলত এক ধরনের শোষণ চলতেই থাকে, যাকে ক্ষমতায়ন হিসেবে দেখালে ভাবের ঘরে ডাকাতি করা হয়।
সেন্সাস রিপোর্ট থেকে একটা কথা স্পষ্ট— তাঁতিরা অবস্থায় নেই। পরিসংখ্যানের গোলকধাঁধা তৈরি না করে সরকার এই শিল্পের প্রতি একটু যত্নশীল হলে উপকার হয়।
লেখক রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy