আসা লাগে আবু, আসা বাগে কেরাইতেবু উজু কেনে/ ওয়া লাগে, ওয়া বাগে, কেরাইতেবু উজু কেনে— নদীর ধারের এক ইটভাটাতে কাজ করতে করতে নিজের মনেই দু’লাইন বলে উঠলেন ঝাড়খণ্ড থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় আসা শ্রমিক। প্রায় প্রতি মিনিটে কাঠের ছাঁচে তৈরি হচ্ছে এক-একটি কাঁচা ইট। স্বামী-স্ত্রী আর মেয়ে হাত লাগিয়েছেন ইট বানানোর কাজে।
কী অর্থ ওই দুই লাইনের? যুবক বোঝালেন, মাটির জন্য মাটি ছাড়া/ ঘরের জন্য ঘর ছাড়া। ঘর তৈরির ইট তৈরি করার জন্য এই শ্রমিকরা ছেড়ে আসেন তাঁদের ঘর। বছরের প্রায় সাত-আট মাস তাঁরা এ রাজ্যের নানা ইটভাটায় থেকে কাজ করেন। এ দেশের প্রায় পঞ্চাশ কোটি মানুষ পরিযায়ী শ্রমিক। এঁরা তাঁদের দলে। তথ্য বলছে, সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
কাজের খোঁজে মানুষ চিরকালই ভিন রাজ্যে, ভিন দেশে পাড়ি দিয়েছে। অনেকে মনে করেন, এ তো ভালই। কর্মী তাঁর দক্ষতার, পরিশ্রমের যোগ্য মূল্য যেখানে পাবেন, সেখানেই যাবেন। ঠিকই, কিন্তু তাঁরা কি স্বেচ্ছায়, উন্নত জীবনের আশায় ঘর ছাড়ছেন? না কি, দুটো ভাতের আশায় ঘর ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন? এই দরিদ্র মানুষেরা হাড়ভাঙা খাটুনির চক্রে বাঁধা। কাজ কোনও উন্নতি আনতে পারে না, বরং পরের প্রজন্মকে ফের টেনে আনে ইটভাটায়।
বিহার, ঝাড়খণ্ড আর ওড়িশা থেকে আসা এই শ্রমিকরা তাঁদের কাজের সময়, মজুরি, বসবাসের স্বাচ্ছন্দ্য কিছুই নির্ধারণ করতে পারেন না। নির্ভর করেন শ্রমিক ঠিকাদার ‘সর্দার’-এর উপর। সর্দাররা নানা রকম লোভ দেখিয়ে শ্রমিকদের সপরিবারে ইটভাটায় আসতে বাধ্য করেন। কারণ শ্রমিক-পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বোঝাপড়া ভাল, একসঙ্গে কাজ করলে উৎপাদন হয় বেশি। দু’চার টাকা বেশি পাওয়ার ইচ্ছা শ্রমিকদের সপরিবারে কাজ করতে অভ্যস্ত করে তোলে। প্রতি ইটভাটায় তাই কাজ করে শিশুরা। ছোট্ট ছোট্ট হাতে একটা একটা করে ইট উল্টে যায় লাইন দিয়ে।
মালদহ জেলার এক ইটভাটাতে কাজ করে এগারো বছরের পূজা। জানাল, আসার আগের দু’এক দিন আর আসার পর কয়েক দিন বেশ ভাল লাগে। তার পর ভাল লাগে না কেন? সারা দিন কাজ করতে হয়, খেলা হয় না ওর, স্কুলে যাওয়া হয় না, তার ওপর আবার রান্নাও করতে হয়। আর রাতে খুব ভয় করে। বাবা-মা দু’জনেই মদ খেয়ে ঘুমোয়, ডাকলে ওঠে না। রাতে ঘরে লম্ফও জ্বলে না। বড় হয়ে কী হতে চায় পূজা? ইটভাটার সর্দার হবে সে। সবাইকে খুব বকবে, মেরে কাজ করাবে। খুব কম পয়সা দেবে আর সব সময় ভাল পান খাবে।
মালদহ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, হাওড়া ও উত্তর ২৪ পরগনার ইটভাটাগুলির সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার পরিযায়ী শিশু। এ যে কত বড় সমস্যা, তার আন্দাজ দেওয়াই মুশকিল। সরকারি কিছু উদ্যোগ, কিছু আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কয়েকটি গ্রামে এই শিশুদের নিয়ে কিছু কাজ করে। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে এদের নিয়ে কাজ করার কেউ নেই। কত জন শিশু পরিবারের সঙ্গে রাজ্যের ইটভাটাগুলিতে কাজ করছে, সব অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে বসবাস করছে চরম নিরাপত্তাহীনতায়, তার হিসেবও নেই। তথ্য নেই প্রেরক রাজ্যগুলোর কাছেও।
এই শিশুরা হিন্দি বা নানা আদিবাসী ভাষায় কথা বলে। ফলে যদি-বা কোনও সংস্থার সহায়তায় স্কুলে ভর্তি হয়, বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা বোঝে না। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এসে এপ্রিল-মে মাসে ফিরে যায় নিজের রাজ্যে। আবার ফিরে এলে ফের পুরনো বিদ্যালয়ে পুরনো শ্রেণিতে পুনরায় ভর্তি হওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু এই কি শিক্ষার অধিকারের সুরক্ষা? বহু শিশু নথির অভাবে স্কুলে ভর্তিই হয় না। একই কারণে উন্নয়নমূলক প্রকল্পে নাম ওঠে না তাদের। ইটভাটাগুলি গ্রাম থেকে অনেকটাই দূরে, তাই গ্রাম পঞ্চায়েতের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা থেকেও এই পরিযায়ী শিশুরা বঞ্চিত। বিভিন্ন দফতরের বার্ষিক পরিকল্পনায় এই শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, অর্থ বরাদ্দও থাকে না।
এক রাজ্যের কোন অঞ্চল থেকে কত মানুষ অন্য রাজ্যে কাজ করতে যাচ্ছেন, সে তথ্য কারও কাছেই থাকছে না। আরও একটি সমস্যা, পরিযায়ী পরিবারগুলি প্রতি বছর একই ইটভাটায় কাজে আসবে, এমনও নয়। তারা কোথায় কাজ করবে তা নির্ভর করে সর্দারের ওপর। ফলে এক অঞ্চলে ব্যবস্থা করেও লাভ নেই। এক বছরে দু’দু’বার ‘স্কুলছুট’ তকমা জোটে শিশুদের।
ইটভাটাগুলিকে পরিবেশ আইন মানতে হবে, সম্প্রতি নির্দেশ দিয়েছে পরিবেশ আদালত। কিন্তু শ্রম আইন মানার বিষয়টি আড়ালে থেকে যাচ্ছে। শিশুশ্রম প্রতিরোধের আইন ইটভাটায় কাজ করছে না। শহরের সদর দফতরগুলি থেকে অনেক দূরে এই পরিযায়ী শিশুশ্রমিক এবং তাদের শ্রমজীবী মা-বাবার উপর নজরদারি কই? হয়তো জাতীয় বা রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন এই চিত্র বদলাতে পারে। কিন্তু আজও এই শিশুরা এক আপাত-অদৃশ্য জগতের বাসিন্দা। যেখানে ধীরে ধীরে শিশুশ্রমিক পূর্ণ শ্রমিকে পরিণত হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy