ফাইল চিত্র
আর এ কথা কে না জানে যে, একটা জাতির সাংস্কৃতিক মেরুদণ্ড ভেঙে গেলে সে আর উঠে দাঁড়াতে পারে না? ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয় আন্দোলনের সিংহভাগে যেহেতু বাঙালি, তাই বাঙালির সাংস্কৃতিক মেরুদণ্ড ভাঙতে হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে পুঁজি করে বঙ্গভঙ্গের চক্রান্ত।
আবার, স্বাধীনোত্তর ভারতে বাঙালি-অধ্যুষিত কিছু অংশ অসমে, কিছুটা তৎকালীন বিহারে (অধুনা ঝাড়খণ্ড), আবার কিছু অংশ ওড়িশাতে ঢুকিয়ে দিয়ে এক কিম্ভুতকিমাকার মানচিত্রকে পশ্চিমবঙ্গ নাম দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হল। পরে অবশ্য মানভূমের ভাষা আন্দোলনের চাপে ১৯৫৬ সালে মানভূমকে (অধুনা পুরুলিয়া) এ বঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল। অর্থাৎ বাংলার উপর ছুরিকাঁচি চালানোর প্রবণতাটা থেকেই গেল।
বর্তমানে যেটুকু রয়েছে সেটুকুরও যা হাল, তাতে আগামীতে সেটুটুকুও অক্ষত থাকে কিনা সন্দেহ। পাহাড়ে গোর্খা, কোচবিহার দিনাজপুরে রাজবংশী, কামতপুরী তো আছেই। এ দিকে আসানসোল, দুর্গাপুর ও কলকাতার কিছু এলাকা বাংলা বর্ণমালা—শূন্য। প্লাটফর্মে স্টেশনের নাম, শপিংমলের সাইনবোর্ড কিংবা কর্তব্যরত কর্মীর মুখের ভাষা, এমনকী কলেজের অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা— সর্বত্র। এককথায়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের জায়গা নিয়েছে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ।
অথচ, আশ্চর্য! পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা যে ভাষা আন্দোলনের পিঠে চেপে তৈরি করল উর্দু সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আস্ত একটা স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জন্ম দিল অধুনা বাংলাদেশ, তেমন ভাষা আন্দোলনের ছিটেফোঁটাও এ বঙ্গের বাঙালির মধ্যে এই হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দেখা যায় না। এমনকী, এতটা ভাষা-সন্ত্রাসের শিকার না হয়েও দক্ষিণের রাজ্যগুলি হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যে সক্রিয়তা দেখায়, তার লেশমাত্রও এখানে নেই। বরং দেখা যায়— “বাংলাটা আমার ঠিক আসে না”—মার্কা আদিখ্যেতা। বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজের মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে হিন্দিভাষীর সঙ্গে নিদেনপক্ষে অশুদ্ধ হিন্দিতে কথা বলে কৃতার্থ হওয়ার আত্মধ্বংসী নজির ভূ-ভারতের আর কোথাও আছে বলে জানা নেই। সেই সঙ্গে নিজের ভাষা-সংস্কৃতির স্বার্থ বলি দিয়ে নেহরু জমানা থেকে শুরু করে এই মোদী জমানা পর্যন্ত রাজনৈতিক তাবেদারির কদর্য ট্র্যাডিশন তো আছেই। সম্প্রতি প্রস্তাবিত এনআরসি নিয়েও বাঙালি দ্বিধাবিভক্ত। সেখানে সে ভাষা ও সংস্কৃতিগত সেন্টিমেন্ট ভুলে মেতে আছে হিন্দু-মুসলমান নিয়ে।
দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে শাসক-বিরোধী নির্বিশেষে আপন ভাষা ও সংস্কৃতিকে বন্ধক রেখে কেন্দ্রের তাবেদারির এই ঘৃণ্য রাজনৈতিক ট্র্যাডিশনের নজির নেই। এ বঙ্গের বাঙালির ভাষাপ্রীতি শুধু ১৯ মে, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১লা বৈশাখ, ২৫ বৈশাখে উথলে ওঠে। অবশ্যই প্রতীকী উদ্যাপনে। ভাষা-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোনও লাগাতার সক্রিয়তা এ বঙ্গের ডিএনএ খুঁজলে মিলবে না। সাধ করে আর দ্বিজেন্দ্রলাল তাকে নিয়ে সেই ঔপনিবেশিক ভারতে বসে তীব্র শ্লেষে ‘বিলেত ফেরতা’ লিখেছিলেন? দক্ষিণ ভারত কি বাঙালির চেয়ে কম ইংরেজি চর্চা করে? তার জন্য কি তাকে নিজের ভাষাকে উপেক্ষা করতে হয়েছে? এমনকী, ঊনবিংশ শতকে বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের পুরোধারা কি এ প্রজন্মের বাঙালির চেয়ে কম ইংরেজি জানতেন? কিন্তু তাঁদের নিয়ে উৎপল দত্তের মতো কি কাউকে আক্ষেপ করতে হয়েছে— ‘‘এরা ইংরেজিটাও শিকল না, বাংলাটাও ভুলে গেল”? পরেরটা না শিখে নিজেরটা ভুলে যাওয়ার হরেক নজির প্রস্তুত। রেডিয়োয় শুনুন এফএম চ্যানেল, বাংলা শুনলে চমকে যাবেন। বেসরকারি বাংলা টিভি চ্যানেলগুলি তো নামেই বাংলা। যেমন তার হিন্দিয়ানি প্রযোজনা, তেমনই উপস্থাপনা। এদের খিচুড়ি বাংলা আপনার নিজের বাংলাকে ভুলিয়ে দেবে।
এমনকী, তথাকথিত কোনও তারকার সাক্ষাৎকারেও তাঁকে এক মিনিট নিরবচ্ছিন্ন বাংলা বলতে দেখবেন না। হিন্দি-ইংরেজি মেশানো হিংলিশ-বেংলিশ না বললে বাঙালি তারকা জাতে ওঠেন না। নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে এমন উদাসীন, আত্মবিস্মৃত, আত্মঘাতী হওয়ার ভবিতব্য শেষ পর্যন্ত বাঙালিকে কোথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবে, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।
কতিপয় সংগঠন মাঝে মাঝে বাংলা ভাষা বাঁচাতে পথে নামলেও তাদের মধ্যে যোগাযোগ, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সংহতির অভাব প্রকট। এমনকী, সেখানেও মাঝে মাঝে রাজনীতির ভূত এসে পথ আগলায়। দলমত-নির্বিশেষে তা আজও আপামর বাঙালির ভাষা আন্দোলনের চেহারা পেল না। এ বড় আক্ষেপের কথা। ব্যক্তিগত পরিসরে কথা বলে দেখেছি, তাঁদের অনেকেই যথেষ্ট আন্তরিক। কিন্তু শুধু আন্তরিকতা দিয়ে তো একটা আন্দোলন হয় না। তার সঙ্গে দরকার সঙ্কীর্ণতা মুক্ত সাংগঠনিক উদ্যোগ ও উপযুক্ত কৌশল। যা একটা ভাষাগত আবেগকে ঠিক দিশা দেখাতে পারে। কতটা বিপন্ন হলে তবে একটা জাতি ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপাতে পারে? দেওয়ালে পিঠ ঠেকতে কি তোমার আর বাকি আছে বাঙালি?
১৯৯৭-এর ১৭ নভেম্বর খোদ ইউনেস্কোর স্বীকৃতি নিয়ে অমর একুশে’র আত্মবলিদান (২১ ফেব্রুয়ারি) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি নিয়ে জ্বলজ্বল করলেও ভাষা-সন্ত্রাস মরেনি। নেহাত সংখ্যাধিক্যের জোরে অন্য ভাষাকে অপর ভেবে তার উপর সংখ্যাগুরুর ভাষা চাপানোর স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী প্রবণতা চলছে তো চলছেই।
সংখ্যাধিক্যর কথাও যদি ধরি, তা হলেও বলব, এখনও ভারতের প্রতি দশ জনের ছ’জনই অহিন্দিভাষী। ২০১১-র গণনা বলছে, হিন্দিতে কথা বলেন ৪৩.৬৩ শতাংশ ভারতীয়। হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা বলে মানতে নারাজ ৫৬.৩৭শতাংশ। তা হলে সংখ্যাধিক্যর যুক্তিও হিসেবমাফিক খাটছে না।
তা হলে যুক্তিটা কি? যুক্তি না বলে তাকে স্বেচ্ছাচারী অপযুক্তি বলাই ভাল। সেটা কী? না, একক ভাবে ভারতে হিন্দিভাষী মানুষ অন্য ভাষার চেয়ে বেশি। এ যুক্তি কোনও গণতান্ত্রিক বোধ ও প্রগতিকে সামনে আনে? সত্যি সেলুকাস….!
উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল, রাজস্থান, হরিয়ানা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি, চণ্ডীগড়, দাদরা ও নগর হাভেলি— যেখানে সব চেয়ে প্রচলিত ভাষা হিন্দি সেখানেও অসংখ্য মানুষ স্থানীয় ভোজপুরি, মৈথিলি, ছত্তীসগঢ়ি ইত্যাদি ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু হিন্দির লিপি ও উচ্চারণ রীতির কাছাকাছি হওয়ায় তাঁদেরকেও হিন্দিভাষী বলে চালিয়ে দিয়ে হিন্দিভাষীর সংখ্যা দেখানো হয় মোট ভারতীয়র ৪৩.৬৩ শতাংশ।
শুধু তাই নয়, সরকারি প্রশ্রয়ে ও অসংখ্য বেসরকারি টিভি চ্যানেলের বদান্যতায় হিন্দিকে সুচতুর ভাবে প্রচার এবং সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় হিন্দিকে আবশ্যক করা ইত্যাদি কারণে গত ৪০ বছরে হিন্দিভাষীর সংখ্যা বেড়েছে ৬.৬৪ শতাংশ। উল্টো দিকে, ততটাই কমেছে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা মানুষের হার।
আর যদি একক ভাবে অন্য ভারতীয় ভাষার চেয়ে সংখ্যায় বেশিও হয়, তা হলেও কি এই চাপিয়ে দেওয়া ফ্যাসিবাদী প্রবণতা কোনও গণতান্ত্রিক সুস্থতাকে সামনে আনে?
যদি তাই হত, তা হলে বাংলা (৮.০৩ শতাংশ ভারতীয়ের ভাষা), মারাঠি (৬.৮৬ শতাংশ), তেলুগু (৬.৭ শতাংশ), তামিল (৫.৭ শতাংশ), কন্নড় (প্রায় ৪ শতাংশ), মালায়ালাম (প্রায় ৩ শতাংশ), অসমীয়া (৩.১ শতাংশ), ওড়িয়া (প্রায় ৩ শতাংশ) ইত্যাদি মোট ২২টি ভারতীয় ভাষাকে সংবিধানের অষ্টম তফসিলে স্বীকৃতি দিয়ে ভারতের বহুত্ববাদী ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে কুর্নিশ করা হত না। এমনকী, তফসিলভুক্ত ভাষার বাইরেও যে বিপুল সংখ্যক মানুষ (৩.২৯ শতাংশ) অন্য ভারতীয় ভাষায় কথা বলেন, তাঁদের প্রতিও ভারতীয় সংবিধান সমান শ্রদ্ধাশীল।
তা হলে কি সাংবিধানিক রক্ষাকবচও আর কোনও রক্ষাকবচ নয়? সত্যি বলতে কী, গত কয়েক বছরে যে ভাবে এক দেশ এক নায়কের আস্ফালন এ ভারত দেখছে, তাতে তো সংবিধান নিজেই বিপন্ন। সে আর ভারতের বহুত্ববাদকে রক্ষা করবে কী করে! বাবাসাহেব অম্বে়ডকর কি অলক্ষে কাঁদছেন?
শক্তিনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy