বাঁ দিক থেকে বীরেন জে শাহ, গোপালকৃষ্ণ গাঁধী, জগদীপ ধনখড় ও কেশরীনাথ ত্রিপাঠী
পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকারের সঙ্গে রাজ্যপালের বিরোধ নতুন কোনও ঘটনা নয়। গত শতকে ছয়ের দশকের শেষ পর্বে যুক্তফ্রন্ট আমলে ধরমবীরের সঙ্গে বিরোধ তো একটি উচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছিল। কিন্তু তার সঙ্গে এখনকার অবস্থার কোনও মিল নেই। আটের দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে তৎকালীন রাজ্যপাল এপি শর্মার সঙ্গে মূল শাসক দল সিপিএম-এর বিরোধও উল্লেখযোগ্য। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও বামফ্রন্টের অন্যান্য শরিকদল সরাসরি রাজ্যপালের অবস্থানকে প্রশ্নচিহ্নের মধ্যে আনেননি। বরঞ্চ জ্ঞাতিশত্রুতা জনিত কারণে সিপিএম-কে কিছুটা বিব্রত হতে দেখে তাঁদের হয়তো হালকা আনন্দই হয়েছিল।
অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য অতীতে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু ছাত্র সংগঠনের নেতা ছিলেন এবং সেই সুবাদে সিপিএম বহির্ভূত অন্যান্য বামপন্থী দলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ভালই ছিল। আজ উপাচার্যদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিয়ে সবাই ব্যতিব্যস্ত। কিন্তু মনে পড়ে আটের দশকের শেষ পর্বে আমরা যখন একটি অতিবাম ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে ছাত্র আন্দোলনের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত বিষয়ে সেমিনার করেছিলাম, সেখানে নকশাল আন্দোলনের অবিসংবাদী ছাত্রনেতা অসীম চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একই মঞ্চে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সন্তোষবাবু। পরের দিন কাগজে বেরিয়েছিল ‘নকশালদের সভায় উপাচার্য’। অর্থাৎ তিনি তৎকালীন বিরোধী দল কংগ্রেসের লোক ছিলেন না। সিপিএমের পছন্দের প্রার্থীকে উপাচার্য না করে তৎকালীন আচার্যও ভুল কিছু করেননি। তবে সে সব দিনকাল ছিল অন্য রকম। ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি, আচরণ, পছন্দ-অপছন্দ তখন এত প্রাধান্য পেত না। ব্যক্তির সাথে সংগঠনের লড়াই ছিল, কিন্তু তার রাজনৈতিক মাত্রাও ছিল।
নয়ের দশকের গোড়ায় এ রাজ্যে রাজ্যপাল হিসেবে এসেছিলেন ইতিহাসবিদ নুরুল হাসান। সে সময়ে আমরা স্নাতকোত্তরের ছাত্র। একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে রাজভবনের অভ্যন্তরে গিয়েছিলাম। কী অপরিসীম স্নেহ আর সৌজন্য মানুষটির আচরণে। বিদগ্ধ এবং একই সঙ্গে যথার্থ ভদ্র মানুষ ছিলেন তিনি। তখন তো তৃণমূল জন্মায়নি। কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার। ইতিহাসবিদ হাসান কিন্তু এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যথেষ্ট ভাল সম্পর্ক রাখতেন। মনে আছে তিনি প্রয়াত হওয়ার পর দলমত নির্বিশেষে সবাই কী ভাবে বেদনাহত হয়েছিলেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, এ রাজ্যে এমন রাজ্যপাল আমাদের সম্পদ।
আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রী-রাজ্যপালের পত্রযুদ্ধের ব্যাপারে সংবিধান কী বলছে?
আরও পড়ুন: বিশ্রী ব্যর্থতা ঢাকার জন্যই আপনার এত কৌশল: ফের তীব্র আক্রমণে ধনখড়
আটের দশকের প্রথম দিকে জ্যোতি বসু, এমজি রামচন্দ্রন, এনটি রামা রাও, ফারুক আবদুল্লা ইত্যাদি অকংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রীদের উদ্যোগে বিজয়ওয়াড়া, কলকাতা এবং শ্রীনগরে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্গঠনে যে কনক্লেভ হয়, তাতেই কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮৪তে তাঁর প্রয়াণের কিছু কাল আগে সারকারিয়া কমিশন নিয়োগ করেন। এই কমিশন আটের দশকের শেষে তাদের রিপোর্টে স্পষ্ট করে এই কথা বলে যে— রাজ্যপাল নিয়োগ করার আগে কেন্দ্রীয় সরকার তথা রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে কথা বলে নেবেন। এই সুপারিশ কংগ্রেস বা বিজেপি নেতৃত্বাধীন কোন সরকারই মানেনি।
জ্যোতি বসুর সঙ্গে অটলবিহারী বাজপেয়ীর হৃদ্যতার কথা সবাই জানেন। রাজনৈতিক মতবিরোধের ঊর্ধ্বে ছিল সেই সম্পর্ক। কিন্তু বীরেন জে শাহ-কে রাজ্যপাল নিয়োগ করার সময় তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের সঙ্গে পরামর্শ করেছিল এমন কোনও তথ্য নেই। অবশ্য রাজ্যপাল হিসেবে শাহ নিজের এক্তিয়ার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। অযথা সাংবিধানিক মর্যাদার গণ্ডি অতিক্রম করতেন না। তিনি মাঝেমধ্যে জেলা সফর করতেন ঠিকই, কিন্তু তা রাজ্য সরকারের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়েই। দুমদাম, নিজের ইচ্ছামাফিক নয়।
২০০৪-এ এলেন গোপালকৃষ্ণ গাঁধী। তখন কেন্দ্রে প্রথম ইউপিএ সরকারকে সমর্থন জোগাচ্ছেন বামপন্থীরা। অতএব মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ইচ্ছাতেই পাঠানো হলো তাঁকে। নন্দীগ্রাম পর্ব নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়। গোপালকৃষ্ণ গাঁধী নাকি রাজ্যপালের পদকে ব্যবহার করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বার্থে। এটা নির্জলা মিথ্যে বললেও কম বলা হয়। হ্যাঁ, গুলি চালানোর পর, কৃষক রমণীদের লাশ দেখার পর রাজ্যপাল গাঁধী তাঁর খারাপ লাগা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু এমন কোনও নথি কেউ দেখাতে পারবেন না, যেখানে রাজ্যপাল ক্রমাগত প্রতিটি বিষয়ে রাজ্য সরকারের বিরোধিতা করছেন এবং প্রকাশ্যে গণমাধ্যমে মতামত ব্যক্ত করছেন। রাজভবনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর যে আলোচনায় রাজ্যপাল মধ্যস্থতা করেছিলেন, সে তো রাজ্য সরকার চেয়েছিল বলেই। এখন যতই অস্বীকার করার চেষ্টা হোক, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একান্ত অনুরোধেই ওই কাজ করেছিলেন রাজ্যপাল গাঁধী। এতে কার রাজনৈতিক সুবিধে হয়েছে, কারই বা কপাল পুড়ল তা তো অন্য আলোচনার বিষয়। গোপালকৃষ্ণ গাঁধী তো আর প্রকাশ কারাটকে বুদ্ধি দেননি যে কেন্দ্রে ইউপিএ থেকে ওয়ান-টু-থ্র-স্টার্ট বলে সমর্থন তুলে নাও!
রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর মধ্যস্থতায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলোচনা (২০০৮)। রয়েছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও।
এহ বাহ্য, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠোর অবস্থান ছিল বামফ্রন্টের প্রথম অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র মহাশয়ের। তিনিই প্রাক সারকারিয়া কমিশন কনক্লেভের মূল তাত্ত্বিক প্রণেতা। রাজ্যপালের পদ নিয়ে তিনি অত্যন্ত সন্দিহান ছিলেন। এক কালে অশোকবাবুর কাছাকাছি আসার সুযোগ আমার হয়েছিল। বহু আলোচনা করেছি তাঁর সঙ্গে। সেটা তাঁর জীবনের অন্তিম পর্ব। ‘আরেক রকম’ পত্রিকার সূত্রে আমাদের উৎপাত লেগেই থাকত তাঁর বাড়িতে। বুঝতাম তিনি নন্দীগ্রাম পর্বে যে ভাবে রাজ্যের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার কাজ করেছে, তাকে একদমই সমর্থন করতেন না। আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও চরম বিরোধী। কিন্তু গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর অভিন্নহৃদয় বন্ধু। পত্রিকার আজীবন সদস্যপদ নিয়েছিলেন গাঁধী। এ দুটিকে মেলাবেন কী ভাবে? রাজ্যপাল হিসেবে গোপালকৃষ্ণ গাঁধী কখনওই ব্যক্তি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি। নন্দীগ্রাম কান্ডে যে সঙ্গত প্রতিক্রিয়া তিনি ব্যক্ত করেছিলেন তা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু যখন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়া বা টিভি চ্যানেলে পা ছড়িয়ে বসে সাক্ষাৎকার দেওয়া— এ সব দেখনদারি তাঁর মধ্যে ছিল না। বস্তুত তিনি কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই আসেননি।
আসলে অনেকেই ভুলে যান যে, রাজ্যপালের পদটি আলঙ্কারিক। গণপরিষদে রাজ্যপালের পদটিকে নির্বাচিত করার জন্য একটি জোরালো মতামত গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মত ছিল এই যে— যদি রাজ্যপাল নির্বাচিত হন, তবে তাঁর সুযোগ জন্মাবে নির্বাচিত রাজ্য সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করার। অতএব যাতে তিনি সেই সুযোগ না পান, তার জন্য এই পদটিকে মনোনীত করে রাখা প্রয়োজন।
এই বিতর্ক যে কেউ সরাসরি পড়ে নিতে পারেন। রাজ্যপাল ধনখড়ও নিশ্চয়ই পড়েছেন। তা সত্ত্বেও তিনি নিয়মিত রাজ্য সরকারের কাজে অনুপ্রবেশ ঘটানোর চেষ্টা করেন কেন? ত্রিপুরার প্রাক্তন রাজ্যপাল তথাগত রায় তো তাঁর টুইট-এর জন্যই বেশি বিখ্যাত। কিন্তু বাম শাসিত ত্রিপুরায় রাজ্যপাল হিসেবে গিয়ে তিনি তো অচিরেই মানিক সরকারের সাথে তরজায় মেতে যাননি। শুনেছি যথেষ্ট হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল। বামেরা হেরে যাওয়ার পর মার্ক্স-লেনিন নিয়ে কিছু বিতর্কিত কথাবার্তা বলেছিলেন। সে সবও রাজ্য সরকারের পরিচালনা নিয়ে নয়। রাজ্য সরকারের তিনি তো প্রতিনিধি। সে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক। কিন্তু প্রকৃত প্রশাসনিক প্রধান হলেন মুখ্যমন্ত্রী যিনি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। কিছু বলার থাকলে রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে পারেন অথবা একান্তই অপারগ হলে রাষ্ট্রপতিকে নালিশ ঠুকতে পারেন। এর বেশি কিছু নয়। সরকারের নীতি নির্ধারণ তিনি করতে পারেন না, কারণ তিনি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নন অতএব সেই কাজ অগণতান্ত্রিক হবে। ভুল নীতির খেসারত জনগণকে দিতে হতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্রে আর কোনও শর্টকাট নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গভর্নর নির্বাচিত হন এবং তিনিই নীতি নির্ধারণ করেন। রাষ্ট্রপতি দ্বারা পরিচালিত ব্যবস্থা আর সংসদীয় ব্যবস্থার তফাৎ বুঝিয়ে বুঝিয়ে আমরা এখন ক্লান্ত। কখনও দেখিনি কোনও রাজ্যপাল নিজের সরকারের বিরুদ্ধে টিভিতে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন এবং সেটা দেখানোর আগে টুইট করছেন যে আজ আমাকে অমুক চ্যানেলে দেখা যাবে। এ সব আমরা করি, রাজ্যপালকে মানায়?
তবে এ রাজ্যে রাজ্যপাল পদের এই স্খলনের দায় শুধু তাঁর নয়। বরাবর দেখা গিয়েছে— বিরোধী দলগুলি যখন মানুষের পাশ থেকে সরে গিয়েছে, তারা রাজভবনে ভিড় করেছে। রাজভবনের সামনে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করাটা এ রাজ্যের বিরোধী রাজনীতিকদের একটা কায়দা। তাঁরা ভাবেন রাজভবনে নালিশ করলে তাঁদের দায় কিছুটা কমলো। জনগণের সঙ্গে কষ্টসাধ্য সংযোগে না গিয়ে, রাজনৈতিক সংলাপকে মানুষের জীবনের সাথে যুক্ত না করে একটু রাজভবনে মুখ দেখিয়েই কার্যসিদ্ধি করার পদ্ধতি কোনও গণতান্ত্রিক রাজনীতিই নয়। এতে রাজ্যপালকে তোল্লাই দেওয়া হল ঠিকই, কিন্তু রাজ্য সরকারের বিরোধিতা করার প্রকৃত মাঠটি থেকে সরে যাওয়াও হল। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জনসংযোগই শেষ কথা।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
(লেখক কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজের রাষ্ট্রবি়জ্ঞানের শিক্ষক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy