সত্যান্বেষণ: চন্দ্রকোনায় কারণ খোঁজার কাজ চলছে। নিজস্ব চিত্র
কিছুদিন হঠাৎ ‘ভূতের উপদ্রব’ হয়েছিল ঘাটাল মহকুমার চন্দ্রকোনায়। ভূত নয়, ব্রহ্মদৈত্য। সে নাকি রাগের চোটে যখনতখন আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। ঘটনায় নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। সেই ব্রহ্মদৈত্যকে তাড়ানো গিয়েছে। কী ভাবে? তা বলার আগে আরও কিছু ‘ভূতুড়ে কাণ্ডের’ কথা জানানো যাক।
সালটা ঠিক মনে নেই। স্থান পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া। বিশাল বাড়ি। বাসিন্দারা সকলে মুম্বই প্রবাসী। মাঝে মাঝে আসেন। পাঁশকুড়াতেই এক আত্মীয়ের কাছে চাবি রাখা থাকত। তাঁরা প্রয়োজন মতো ঘর ব্যবহার করেন। বিজ্ঞানমনস্ক বন্ধু আশরাফুল খবর দিল, ওই বাড়ির দোতলার বারান্দায় প্রতি রাতে হঠাৎ হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠছে। আর সঙ্গে হাসির শব্দ। পাড়া প্রতিবেশী ভূতের উপদ্রব বলে ভয় পেতে শুরু করল। বিজ্ঞানকর্মীরা ঠিক করলাম, রাত কাটানো হবে ওই বাড়িতে। আত্মীয়ের কাছে চাবি নিয়ে আমরা কয়েকজন দোতলাতেই একটা ঘরে আশ্রয় নিলাম। চারদিকের আলো জ্বেলে দেওয়া হল। না, ওই রাতে কোনও আগুন জ্বলেনি। হাসিও শোনা যায়নি।
শুরু হল আমাদের খোঁজখবর। বারান্দায় মিলল মোটা দড়ি, প্রচুর দেশলাই কাঠি, বিড়ি, সিগারেট এমনকি গাঁজার পুড়ে যাওয়া অংশ। বোঝা গেল, কোন প্রজাতির নেশাখোর ভূত এরা! আসলে পাঁশকুড়ার ওয়াগন ব্রেকাররা অথবা অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিছুজন একতলার জানলাতে মোটা দড়ি বেঁধে দোতালার বারান্দায় উঠত। ওখানে চলত ওদের মিটিং ও পরিকল্পনা। ফাঁকা বাড়ি। বিরক্ত করার কেউ নেই। মাঝে মাঝে নেশা করার জন্য আগুন জ্বালানো হত। হয়তো বা গা ছমছমে পরিবেশ সৃষ্টির জন্যই চলত হাসাহাসি। পুরোটাই ওদের কাজের সুবিধার জন্য। স্থানীয় মানুষ ভাবতেন, এসব ভূতেরই কাজ। পাড়ার লোকেদের বলে আসা হয়েছিল, কয়েকদিন পালা করে পাহারার ব্যবস্থা করতে পারলেই নেশাখোর ভূত ভেগে যাবে। পরে খবর পেয়েছিলাম, আর ভূত দেখা যায়নি। দেখা যাওয়ার কথা ও নয়।
সালটা ২০১২। হুগলির আরামবাগের কাছে একটি গ্রামের ঘটনা। সেই বাড়িতে কিছু জিনিসে হঠাৎ হঠাৎ আগুন লেগে যাচ্ছে। পোশাকে এমনকি বইপত্রেও। সকলের চোখের সামনেই নাকি এসব ঘটছে। অথচ কে করছে দেখা যাচ্ছে না। ভূতের ওঝা এসেছে ভূত তাড়াতে। যজ্ঞ হয়েছে। কিন্তু ভূত আর যাচ্ছে না। অগত্যা ভূত তাড়াতে বিজ্ঞানমনস্ক ‘ওঝা’র ডাক পড়ল।
আমরা মানে কয়েকজন বিজ্ঞানকর্মী। অর্থাৎ যা ঘটে তা বিজ্ঞানের সাহায্যে ব্যাখ্যা করি। ওই পরিবারের সকলের সঙ্গে আলাদা করে কথাও বললাম। ভূতে কী কী পুড়িয়েছে দেখা হল। আর ভূতকে ধরাও গেল। খুব চেনা পদ্ধতিতে আগুন লাগাচ্ছিল ভূত। যে জিনিসে আগুন লাগাতে চাইছিল, তার ওপর পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের গুঁড়ো রেখে দিচ্ছিল। আর পাশের দিকে একটু দূরে অনেকটা গ্লিসারিন ঢেলে ওই জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। গ্লিসারিন গড়িয়ে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের সঙ্গে মিশতেই বিক্রিয়া করে আগুন জ্বলে যাচ্ছিল। ভূত ধরে দুঃখই হল একটু। সে যে ওই বাড়িরই নবম শ্রেণিতে পড়া ছেলেটি। ওর বাবা মা পড়াশোনায় মাত্রাতিরিক্ত চাপ দিচ্ছিল। তাই বাবা মাকে জব্দ করতেই সে ‘আগুন ভূত’ আমদানি করে। ছেলেটি কথা দিয়েছিল, কখনও এরকম কাজ আর সে করবে না। দলের বিজ্ঞানকর্মীরা ওখানের মানুষকে কথা দিয়ে এসেছিলাম, আর ‘আগুন ভূত’ আসবে না। আসেওনি।
আরেক ভূতের কাণ্ড। ২০১৪-১৫ সাল হবে। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর থানার ঘটনা। একজনের বাড়ির একটি ঘরে, বিশেষ করে রাতের দিকে, একটা অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। আর পুরো ঘরে সাদা সাদা কীসের গুঁড়ো কে যেন ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ চলল। কী হচ্ছিল? স্টিলের যে ডান্ডায় দরজার পর্দা ঝোলানো ছিল, সেটির আস্তরণ কোনও কারণে সংকোচন-প্রসারণে ফাঁপা হয়ে গিয়েছিল। সেই সাদা আস্তরণটা শব্দ করে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ছিল। বাড়ির লোক বুঝতে না পেরে ভূতুড়ে কাণ্ড বলে ভেবেছিলেন। আর যেখানেই চিন্তাভাবনা বন্ধ, সেখানেই ভূত।
কিছুদিন আগে আবার ‘আগুন ভূত’এর আবির্ভাব। এবার পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা। প্রচণ্ড দরিদ্র চারটে পরিবার একসঙ্গে বাস করে। সেখানেই হঠাৎ হাজির আগুন ভূত। সেই ভূতে ওড়না পুড়িয়েছে। পুড়িয়েছে ক্যালেন্ডার, বইপত্র, চাবি দেওয়া বাক্সের মধ্যে থাকা মূল্যবান দলিল, খড়ের ছাউনি, এমনকি অন্যের খড়ের গাদাও। ভূত তাড়াতে দাড়িওয়ালা তান্ত্রিককে ডাকা হয়েছে। সে ‘গণনা’ করে বলেছে, এক ভয়ঙ্কর ব্রহ্মদৈত্য নাকি আগুন জ্বালাচ্ছে। ওই পরিবারের ঘুপচি ঘুপচি ঘরগুলো দিয়েই নাকি ব্রহ্মদৈত্যের যাওয়ার রাস্তা। বাধা পেয়ে রেগে গিয়ে ব্রহ্মদৈত্য আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। ব্রহ্মদৈত্যের রাগ থেকে রক্ষার উপায়? তান্ত্রিক নিদান দিলেন, মন্দির প্রতিষ্ঠা করে কী সব যজ্ঞ করতে হবে। মন্দির প্রতিষ্ঠা হল। শান্তি যজ্ঞ করা হল। কিন্তু ‘আগুন ভূত’ পালাল না! প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে যাওয়া হল। প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলা হল। পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্র পরীক্ষা করা হল। আমাদের পৌঁছনোর আগেই একটা বাচ্চার কাঁথা পুড়েছে। দেখা গেল, কাঁথাটা অদ্ভুত ভাবে এঁকেবেঁকে পুড়েছে। আর প্রত্যেকটা পুড়ে যাওয়া জিনিসে কেমন যেন একটা আঠার মতো স্তর পড়েছে। এদিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আগুনের শিখা কম, কিন্তু ধোঁয়া বেশি আর একটা উৎকট গন্ধ। বোঝা গেল, কী ভাবে আগুনটা লাগছে। একটি বন্ধ ঘরে প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের দেখিয়ে দেওয়া হল, সম্ভাব্য আগুন লাগানোর পদ্ধতি। কিন্তু আগুন লাগানো হচ্ছিল কেন? যে কোনও অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে প্রথমে বোঝার বা খোঁজার চেষ্টা করা হয়, কোন সহজপ্রাপ্য জিনিসের সাহায্যে অপরাধীরা অপরাধ করতে পারে। এক্ষেত্রে ওই বাড়ি থেকেই আমরা পেয়েছিলাম রাবার সলিউশন। যাঁরা জুতো সেলাইয়ের কাজ করেন তাঁদের কাছে চামড়া তালি দেওয়ার জন্য একটি কৌটোতে এই লাল রঙের রবার সলিউশন থাকে। অত্যন্ত দাহ্য বস্তু এটি। সম্ভবত, ওই বাড়ির একজন বা দু’জন যে জিনিসটা পোড়াতে চাইছে তাতে তরলটি লাগিয়ে দেশলাই দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। ব্রহ্মদৈত্যের ভয়ের চোটে বাড়ির লোক শৌচালয়টি ভেঙে ফেলেছিলেন। প্রশাসনের সাহায্যে ওই বাড়ির বাসিন্দাদের অন্য জায়গায় বসবাসের ব্যবস্থা করে দিয়ে এবং ৪৮ ঘণ্টার জন্য তিনটে ঘর পুরোপুরি সিল করে দিয়ে আমরা চ্যালেঞ্জ করেছিলাম আর আগুন ভূত আসবে না। বাস্তবিকই আসেনি আর। পরে সচেতনতামূলক প্রচারও করা হয়।
ওপরের প্রতিটা ঘটনায় অন্তত একটা জিনিস প্রমাণিত, এই পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছুই নেই। হতেও পারে না। শুধুই এই চারটে ঘটনাই নয়, আমরা বহু তথাকথিত অলৌকিক ঘটনা ফাঁস করেছি এবং প্রমাণ করে দিয়েছি তার পিছনে মানুষের কীর্তি। একটু খোঁজখবরেই দেখা যাবে, সব অলৌকিকের পিছনে কোনও লৌকিক কারণ রয়েছে।
লেখক বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক কর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy