বিআর অম্বেদকর।
তোমার ঘরে বসত করে কারা, ও মন জানো না তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।— লালন শাহ’র এ আত্ম-জিজ্ঞাসা যদি দেহতত্ত্বের সীমানা পেরিয়ে সমাজতত্ত্বের গভীরে আমাদের আকৃষ্ট করত, তা হলে অনেক বিতর্কের সূত্রপাতই হত না। এ উপমহাদেশে সামাজিক অনৈক্য ও সংঘাতের মূলে রয়েছে বহুধাবিস্তৃত অপরিচয়। চতুর্বর্ণের বর্ম ভেদ করে, মনুসংহিতার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সহস্র বছর ধরে সকলের কাছে সকলে পৌঁছতে পারেনি। প্রত্যাশা ছিল, স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক চেতনায় বর্ণব্যবস্থার ধ্বংসস্তূপের উপর গড়ে উঠবে নতুন ভারত। অথচ, প্রতিনিয়তই দেখি, পরস্পরকে না জানার, সহ-নাগরিককে স্বজন ভাবতে না পারার মূঢ়তা এবং যোগ্য মর্যাদায় গ্রহণ করতে না পারার অক্ষমতা, দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রকে পদে পদে ব্যর্থ ও বিপন্ন করে তুলছে। সম্প্রতি রাজ্য সরকার কর্তৃক পশ্চিমবঙ্গ দলিত সাহিত্য আকাদেমি গঠনের বিতর্ক দ্রুত সরে এসেছে দলিত সাহিত্য সৃষ্টির যৌক্তিকতায়। ‘তর্কপ্রিয় বাঙালি’ সামজমাধ্যমে সেই বিতর্কে পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে যাবতীয় সৌজন্যের সীমা লঙ্ঘন করতে কুণ্ঠিত হয়নি। প্রশ্নটা বিতর্ক নিয়ে নয়, সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়তে না চাওয়া অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে।
সাহিত্য কি দলিত হয়? সঙ্গত প্রশ্ন, সন্দেহ নেই। সাহিত্য পাঠক ও বিচারকমাত্রেই জানেন, শেষ বিচারে সাহিত্যকে রসোত্তীর্ণ হতে হয়। তবু বৈশিষ্ট্যগত কারণে তার উপবিভাগকে আমরা মান্যতা দিই। এমনকি যুগ ও দশক বিচারও আমরা শিরোধার্য করেছি। শাক্ত, বৈষ্ণব, মুসলিম, নারীবাদী, মার্ক্সীয়, শ্রুতি, হাংরি, আধুনিক, উত্তর-আধুনিক; সাহিত্যকে নানা ভাগে ভাগ করে দেখার প্রবণতা বিদ্যমান। সে আলোচনায় উপরোক্ত প্রশ্ন তীব্র হয়ে ওঠে না। কারণ, আমরা নিশ্চিত জানি, সাত রঙ মিলিয়েই রংধনু। রংগুলিকে আলাদা করে শনাক্ত করা যায় বটে, কিন্তু কোনও একটিকে বাদ দিয়ে রংধনু গড়ে ওঠে না। দলিত সাহিত্যকে স্বীকার করতে তবে অনীহা কেন? ইতিপূর্বে এই ধারাকে সাহিত্যের অপরিহার্য অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছে তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম, গুজরাতি, হিন্দি ইত্যাদি ভাষা। দলিত সাহিত্যের সূচনা হয়েছিল যে ভাষায়, সেই মরাঠিতে দলিত সাহিত্য মূলধারার সাহিত্য হিসেবেই গণ্য। একাধিক মরাঠি দলিত লেখক সাহিত্য অকাদেমির পুরস্কারে সম্মানিত। বলা চলে, অবশিষ্ট ভারতের কাছে দলিত সাহিত্য অনাদৃত নয়, সমাদৃত। দয়া পওয়ার ফ্রাঙ্কফুর্টের সাহিত্যসভায় (১৯৮৪) ভারতের প্রতিনিধি হয়ে দলিত সাহিত্য বিষয়ে আলোকপাত করেন। পরে লেখক হিসেবে তিনি পদ্মশ্রী পান।
ভারতের বুকে নবজাগরণের আলো জ্বেলেছিল যে বাংলা, সে কি তবে ব্যতিক্রম? ত্রিশ বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে বাংলায় দলিত সাহিত্য আন্দোলন গড়ে উঠলেও এখানে তেমন ভাবে তার সমাদর জোটেনি। বরং, নবজাগরণগর্বী বাঙালির স্বাভিমানকেই তা যেন আহত ও ক্ষুণ্ণ করেছে। পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনে নিজেদের জাত পরিচয় হাট করে মেলে ধরা বাঙালি বাকি দেশকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছে, বাংলা জাতপাত-মুক্ত। সগর্বে ঘোষণা করেছে, এখানে কেউ দলিত নয়। তাই হয়তো জাতপাত জাগিয়ে তোলার অপচেষ্টা, এই অপবাদ দিয়ে দলিত সাহিত্য সৃষ্টির চেষ্টাকে অঙ্কুরেই কেউ কেউ বিনষ্ট করতে চেয়েছেন।
বাঙালি সমাজ বর্ণবাদী সংস্কার কতটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে, সে বিচারের দায়িত্ব সমাজবিজ্ঞানীদের। আমরা দেখতে পারি, যে দলিত লেখকরা জাত-পীড়নের কথা বলেন, তাঁরা কি সে ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চান, না তা থেকে মুক্তির উপায় খোঁজেন? পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে, জাতব্যবস্থা ও তার মূল্যবোধের আমূল বিনাশই দলিত সাহিত্য আন্দোলনের লক্ষ্য। ‘দলিত’ একটি সমষ্টিবাচক শব্দ, যা একটি ধারণাকে প্রকাশ করে। হয়ে ওঠে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের প্রতীক। সে বিদ্রোহ ব্রাহ্মণ্য তথা মনুতন্ত্রের শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার দৃপ্ত উচ্চারণে উজ্জ্বল। দলিত সাহিত্য অবশ্যই যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করে, কিন্তু সেখানেই সে থামে না। তার প্রতিবাদ অচলায়তনকে ভেঙে তার ভগ্নস্তূপের উপরে সাম্যের স্বপ্নের ভিত্তি স্থাপনের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। অর্থাৎ, যুগপৎ ধ্বংসে ও বিনির্মাণে সে বিশ্বাসী।
এ কথা সর্বজনবিদিত যে, বাবাসাহেব অম্বেডকরই (ছবিতে) দলিত সাহিত্যের প্রেরণা। সংবিধান সভায় প্রদত্ত শেষ ভাষণে তিনি বলেছিলেন, আমরা রাজনৈতিক গণতন্ত্র পেলাম বটে, কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা না গেলে সব ব্যর্থ হতে বাধ্য। বিগত সাত দশকে আর্থিক ব্যবস্থা পরিবর্তনে সহস্র আন্দোলন সংগঠিত হলেও সামাজিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রায় কোনও আন্দোলনই গড়ে ওঠেনি। আত্মিক দাসত্বমোচনের জন্য যে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়োজন, শিবরাম চক্রবর্তীর ভাষায়, “মনুর সত্ত্ব লোপ না পেলে এদেশে মনুষ্যত্বের বিকাশ হওয়া অসম্ভব”— তা কোথায়?
অন্যদের নিশ্চেষ্ট দেখে দলিতরাই সে কাজে অগ্রসর হলেন। দলিত সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা হল। লেখক-দার্শনিক অনিলরঞ্জন বিশ্বাস এর যথার্থ সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন— দলিত মুক্তির সাহিত্য। মনুবাদী মূল্যবোধে বিশ্বাসী বা শোষণে প্রতিবাদহীন কোনও রচনা যতই শিল্পগুণসম্পন্ন হোক, তা দলিত সাহিত্য অভিধার যোগ্য নয়। আন্দোলনে সক্রিয়তা দলিত লেখকের অবশ্যকর্তব্য। যে কেউ এ আন্দোলনে শামিল হতে পারেন।
সমাজমুক্তির এই আন্দোলনে দলিতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন অনেক অ-দলিতও। তাঁরা প্রকাশ করছেন বাংলা পত্রিকা, ইংরেজি জার্নাল। ১৯৯২ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দলিত সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নিয়েছেন তাঁরাও। সুতরাং, অচলায়তনপন্থীদের প্রতিক্রিয়া দেখে হতাশ হলেও, বাংলার পরিবর্তনকামী শুভশক্তির উপরে বিশ্বাস হারাবার কারণ নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy