এত দিনে স্পষ্ট, অর্থমন্ত্রী যে অর্থনৈতিক প্যাকেজটি ঘোষণা করলেন, তার চোদ্দো আনাই ভাঁওতা। কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার বেশি ঘোষণার মধ্যে দেখা যাচ্ছে, খুব জোর আড়াই লক্ষ কোটি টাকা প্রকৃত বরাদ্দ। ভাঁওতাতেও অর্থনীতির চিঁড়ে ভিজবে না, এই সামান্য টাকাতেও নয়। প্রকৃত খরচের অঙ্কটি জাতীয় আয়ের পাঁচ শতাংশ, অর্থাৎ দশ লক্ষ কোটি টাকাতে নিয়ে যেতে পারলে তবেই বাঁচতে পারে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা। সেই টাকা কী ভাবে খরচ করা যেতে পারে, এই লেখায় তার কিছু পথের কথা বলব।
প্রধানমন্ত্রী জন ধন যোজনায় এখনও পর্যন্ত প্রায় ২৯ কোটি ৪৮ লক্ষ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। উপভোক্তার সংখ্যা দেশের জনসংখ্যার ২৮.৩ শতাংশের কাছাকাছি। যদি প্রতিটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে সরাসরি ৫,০০০ টাকা করে তিন মাস লাগাতার ভাবে পাঠানো যায়, তবে আগামী তিন মাসে মোট খরচ দাঁড়াবে ৫.৭৬ লক্ষ কোটি টাকা।
আরও একটি সহজ পথ একশো দিনের কাজ প্রকল্প। এই মুহূর্তে প্রায় ৬ কোটি মানুষ এই প্রকল্পে কাজের মাধ্যমে টাকা পাচ্ছেন। প্রকল্পে মজুরির হার গড়ে দিনে ২০০ টাকার মতো। অঙ্কটিকে দ্বিগুণ করা যায়। সে ক্ষেত্রে সরকারের বাজেট বরাদ্দের থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি প্রয়োজন হবে।
অন্য দিকে, কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী দেশে এই মুহূর্তে এমন ৬৫ লক্ষ স্বনির্ভর দল আছে, যাদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে, এবং যারা ব্যাঙ্ক থেকে গোষ্ঠী-ঋণ পেয়েছেন। প্রায় সাত কোটি মহিলা সংযুক্ত আছেন, প্রধানত গ্রামের। এই গোষ্ঠীগুলির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এক লক্ষ টাকা করে পাঠানো হলে সদস্যরা নিজেদের মধ্যে সেই টাকা ভাগ করে নিয়ে ব্যবসা করতে পারেন। সরকারের বাড়তি খরচ হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
পিএম কিসান প্রকল্পের সাড়ে আট কোটি উপভোক্তাকে ছ’মাসে অতিরিক্ত দুটি কিস্তি, অর্থাৎ মোট চার হাজার টাকা করে দেওয়া যেতে পারে। খরচ হবে ৩৪ হাজার কোটি টাকা। কৃষিতে সহায়তার অন্য পথ হতে পারে সারের উপর ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানো। বর্তমান অর্থবর্ষে সারের উপর ভর্তুকির পরিমাণ বরাদ্দ হয়েছে যে ৮০,০০০ কোটি টাকা, তাকে বাড়িয়ে ১ লক্ষ কোটি টাকা করা যায়।
২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, ও মাঝারি উদ্যোগে, প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনায় এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩ লক্ষ ২৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। পেয়েছেন প্রায় ছ’কোটি মানুষ। কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে দু’বছরের জন্য এই ঋণের ওপর সুদ মকুব করে দেওয়া যায়। প্রকল্পের শর্ত অনুসারে ৭ শতাংশ হারে সুদ দিলে বছরে মোট সুদের পরিমাণ দাঁড়ায় ২২,৬৫০ কোটি টাকা। সুতরাং, দু’বছরে ৪৫,৩০০ কোটি টাকার সুদ মকুব করে সরকার এই টাকা নির্দিষ্ট ব্যাঙ্কগুলিকে দিতে পারে।
তবে, এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়বৃদ্ধি। সাম্প্রতিক অতীতে ভারতে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জিডিপি-র এক থেকে সওয়া এক শতাংশের মধ্যে থাকছে, যা ভারতের সঙ্গে তুলনীয় অন্যান্য দরিদ্র দেশগুলির চেয়েও কম। বর্তমান অর্থবর্ষে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো হোক জাতীয় আয়ের আরও এক শতাংশ। এতে আরও দু’লক্ষ পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। এই অতিরিক্ত বরাদ্দে স্বাস্থ্যখাতে প্রভূত উন্নয়ন সম্ভব। কোভিড-১৯ অতিমারির সময়ে যাঁদের অবদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাঁরা হলেন ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী। ইতিমধ্যেই দেশে অনেক ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন, মারাও গেছেন। এঁদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যবিমা খাতে ও আপদকালীন সময়ে এককালীন বরাদ্দ করা যায় ৩ হাজার কোটি টাকা।
এই অতিমারি আমাদের শিক্ষা দিল যে গবেষণা পরিমাণ ও গুণগত মানবৃদ্ধি ভিন্ন বাঁচার পথ নেই। সেই গবেষণা যেমন চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হবে, তেমনই অতিমারির ধাক্কাকে আরও কতটা সুনির্দিষ্ট ভাবে রোখা যায়, তা বোঝার জন্য সমাজবিজ্ঞানও জরুরি। বর্তমান আর্থিক বর্ষেই কোভিড-১৯ গবেষণা তহবিল গড়ে তাতে জাতীয় আয়ের ০.১ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা যায়।
এত টাকা আসবে কোথা থেকে? সরকারের তো ভাঁড়ে মা ভবানী। টাকা জোগাড়ের একাধিক পথ রয়েছে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে সরকার মোটা টাকা ঋণ নিতে পারে। এই মুহূর্তে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তহবিলে প্রায় চল্লিশ লক্ষ কোটি টাকা মূল্যের বিদেশি মুদ্রা গচ্ছিত আছে। তার একটা অংশ আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করা যায়। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির খাতায় অনাদায়ী ঋণের পাহাড়— তা উদ্ধারে সরকার যুদ্ধকালীন তৎপরতায় অগ্রসর হতে পারে। দেশের সরকারি ব্যাঙ্কগুলিতে প্রায় সাড়ে দশ লক্ষ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণের একটা অংশও যদি দ্রুত উদ্ধার করা যায়, তবে টাকার বন্দোবস্ত হবে। তৃতীয় বিকল্প হতে পারে আগামী দুটি অর্থবর্ষে কোভিড-১৯ সেস চালু করা এবং বিত্ত কর বসানো। এ সবই হতে পারে। কিন্তু হবে কি?
অর্থনীতি বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারিক, ইংল্যান্ড
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy