মানবাধিকার সুরক্ষা আইন (দ্য প্রোটেকশন অব হিউম্যান রাইটস অ্যাক্ট ১৯৯৩) সংশোধন করল সংসদ। এর আগে ২০০৬ সালে এক বার সংশোধন হয়েছিল। তার পরও ফের সংশোধনের দাবি উঠছিল। নানা দাবির মধ্যে প্রধান ছিল, মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ মানা বাধ্যতামূলক করা। বর্তমানে কমিশন সুপারিশকারী সংগঠন মাত্র। সরকার সুপারিশ না মানলে কমিশনের কিছু করার নেই। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পঁচিশ বছরের ইতিহাসে সব চেয়ারম্যান দাবি করেছেন, সুপারিশ না মানলে শাস্তি দেওয়ার অধিকার দিতে হবে কমিশনকে। এ ব্যাপারে কিন্তু নীরব সংশোধনও। অর্থাৎ কমিশনের ক্ষমতা বাড়ছে না। শুধুই সুপারিশকারী সংগঠন হয়ে থাকছে।
কী পাওয়া গেল সংশোধনে? সদস্য নিয়োগের শর্ত ঢিলে হল। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, আর হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হতে পারেন। সংশোধিত আইন বলছে, সুপ্রিম কোর্টের যে কোনও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, এবং হাইকোর্টের যে কোনও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হতে পারবেন। চেয়ারম্যান পদের মেয়াদ পাঁচ বছরের বদলে তিন বছর করা হল। জাতীয় কমিশনে মানবাধিকার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সদস্য সংখ্যা দুই থেকে বাড়িয়ে তিন করা হল, যাঁদের এক জন হবেন মহিলা।
এই প্রথম জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে অন্তত এক জন মহিলা সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ভাল প্রস্তাব। কিন্তু রাজ্য মানবাধিকার কমিশনগুলিতে মহিলা সদস্য রাখা আবশ্যক করা হল না কেন? জাতীয় কমিশনে আজ পর্যন্ত কোনও মহিলাকে চেয়ারম্যান করা হয়নি। গত পঁচিশ বছরে জাতীয় কমিশনের সদস্য হয়েছেন মাত্র তিন জন মহিলা। মানবাধিকার সংগঠনগুলির দাবি ছিল, অন্তত অর্ধেক সদস্য মহিলাদের থেকে নিয়োগ করার। সে দাবি মানা হল না।
বর্তমানে সংখ্যালঘু কমিশন, মহিলা কমিশন, তফসিলি জাতি কমিশন, জনজাতি কমিশনের সদস্যরা পদাধিকার বলে কমিশনের সদস্য হন। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেলে নয়া আইনে ওবিসি কমিশন, শিশু অধিকার কমিশন এবং প্রতিবন্ধী কমিশনের চেয়ারম্যানরাও কমিশনের সদস্য হবেন। প্রধান প্রশাসক হিসাবে কমিশনের সেক্রেটারি জেনারেল-এর (সাধারণত কোনও আইএস অফিসার এই পদে থাকেন) ক্ষমতাও অনেকটা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কমিশনের ক্ষমতা বাড়ল কোথায়? বর্তমান আইন অনুযায়ী, সেনাবাহিনী বা আধা-সামরিক বাহিনীর দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ বিচার করার অধিকার মানবাধিকার কমিশনের নেই। কমিশনের জন্মলগ্ন থেকেই দাবি উঠেছে, সেনা-আধাসেনার দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনকেও কমিশনের আওতায় আনতে হবে। কোনও সরকারই তাতে উদ্যোগী হয়নি। এ বারও এই দাবি উপেক্ষা করা হল। এটা খুবই হতাশাজনক।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এখন একটিই মাত্র দফতর, নয়াদিল্লিতে। দেশের চার অঞ্চলে চারটি অফিস করে কমিশনের কাজকে বিকেন্দ্রিত করার দাবিও দীর্ঘ দিনের। সরকার তা অগ্রাহ্য করল। জাতীয় কমিশনকে বছরে অন্তত এক লক্ষ অভিযোগের বিচার করতে হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা দেশ জুড়ে যে ভাবে বাড়ছে, তাতে এক জন সদস্য বাড়ানো কখনওই যথেষ্ট নয়। জাতীয় কমিশনের আরও চারটি দফতর খোলার দাবি বাতিল করার মতো ছিল না।
সংশোধিত আইন মানবাধিকার কর্মীদের আশান্বিত করতে পারেনি, বরং বিক্ষুব্ধই করেছে। ক্ষোভের অন্যতম কারণ, সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সংগঠন, বা নাগরিক সমাজের কোনও মতামত নেয়নি সরকার। অথচ গণতন্ত্রে আইন পরিবর্তনের নির্ধারিত প্রক্রিয়াই হল, জনসাধারণের কাছে মতামত চাইতে হবে।
দ্বিতীয় আপত্তি মানবাধিকার কমিশনের কাজে সরকারি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। আন্তর্জাতিক কনভেনশনে গৃহীত নীতি (‘প্যারিস প্রিন্সিপলস’) অনুসারে মানবাধিকার কমিশনকে হতে হবে স্বাধীন, স্বতন্ত্র। চেয়ারম্যান পদে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নিয়োগ যদি আবশ্যক না হয়, যদি যে কোনও বিচারপতিকে নিয়োগের সুযোগ থাকে, তা হলে সরকারের হাতে কমিশনের গঠন প্রভাবিত করার অনেক বেশি ক্ষমতা আসে। কিসের ভিত্তিতে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদের জন্য কোনও বিচারপতি ‘যোগ্য’ বলে বিবেচিত হবেন, সে বিষয়ে যথেষ্ট অস্পষ্টতা রয়েছে সংশোধিত আইনে। চেয়ারম্যান বা সদস্যদের কার্যকাল কমিয়ে আনার ফলেও, পুনর্নিয়োগের সম্ভাবনাকে সামনে রেখে সদস্যদের উপর সরকার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে— এই উদ্বেগ দেখা দিতে বাধ্য।
স্বাধীন, স্বতন্ত্র, শক্তিশালী মানবাধিকার কমিশন পাওয়ার আশা মেটাতে পারল না সংশোধিত মানবাধিকার রক্ষা আইন।
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy