বিপন্ন: বাঁদিকে ‘সাদা পিঠ’ শকুন। মাঝে ‘হিমালয়ান গ্রিফন’। ডানদিকে ভারতীয় শকুন। ছবিটি হাজারিবাগের ছারওয়া ড্যামে তোলা। ছবি: লেখক
ঝাড়গ্রামের রঘুনাথপুরে বাড়ির পাশে একটা ডোবা ছিল। লোকে বলত ইটভাটার পুকুর। কোনও একসময়ে কেউ ইট কাটিয়েছিল। তারই চিহ্ন রয়ে গিয়েছিল ডোবা হয়ে। ডোবার পাশে ছিল একটা খোলা জায়গা। সেখানে দলে দলে শকুন আসত। এখন তো গোটা রাজ্যেই শকুন প্রায় বিরল হয়ে গিয়েছে। দেখা পাওয়াই ভার। দলে দলে কথাটা প্রাচীন যুগের শোনাবে। অথচ মাত্র ৩০-৪০ বছর আগের কথা।
অথচ এক সময়ে ভারতে শকুনের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। কিন্তু বর্তমানে সারা ভারতে মাত্র কয়েক হাজার শকুন বেঁচে আছে। ২০১৫ সালের এক গণনা অনুসারে, ভারতে ‘সাদা-পিঠ’ (হোয়াইট রাম্পড) শকুন ৬০০০টি, ভারতীয় শকুন ১২ হাজার এবং সরু-ঠোঁট শকুন (স্লেন্ডার-বিলড ভালচার) মাত্র ১০০০টি বেঁচে আছে। যা কিনা বাস্তুতন্ত্র বজায় রাখার জরুরি সংখ্যার থেকে অনেকটাই কম। এই তথ্য মিলেছে বম্বে ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটির (বিএনএইচএস) অন্যতম শকুন বিশেষজ্ঞ বিভু প্রকাশের সংগ্রহ করা তথ্য থেকে। বিভু প্রকাশ দেশের অন্যতম শকুন বিশেষজ্ঞ।
দেশে শকুন কমছে। এই তথ্যটি ধরা পড়ে পার্সি সম্প্রদায়ের একটি রীতি থেকে। পার্সিরা মৃতদেহ সৎকার করেন না। তা জীবসেবায় উৎসর্গ করা হয়। তাঁরা মৃতদেহ উঁচু একটি মিনারের উপরে রেখে আসেন। মিনারকে বলা হয় ‘টাওয়ার অব সাইলেন্স’। যাতে করে মৃতদেহ শকুনেরা খেয়ে নিতে পারে। কারণ পার্সিরা জল, বায়ু এবং মাটি, তিনটিকেই পবিত্র বলে মনে করেন। তাই তাঁরা মৃতদেহ সৎকার করে দূষিত করতে চান না। সালটা ১৯৮০। হঠাৎ পার্সিরা খেয়াল করলেন, ‘টাওয়ার অব সাইলেন্স’এ মৃতদেহ অনেকদিন ধরে পড়ে রয়েছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে তাঁরা বুঝতে পারেন শকুনের দল আসছে না। শুরু হল খোঁজ। ধীরে ধীরে জানা গেল, এ শুধু ভারতের সমস্যা নয়, সারা পৃথিবীতেই কমেছে শকুন। এর কারণ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল অনেক দেশ। ভারতও। বিএনএইচএস-এর তত্ত্বাবধানে গঠিত হল দল। খোঁজ করতে করতে পাওয়া গেল, যে সব শকুন অকালে মারা গিয়েছে তারা প্রায় সকলেই কিডনির রোগে ভুগেছে। কিডনির রোগের কারণ ডাইক্লোফেনেক নামে এক ওষুধ। এই ওষুধ গবাদি পশুর রোগ উপশমে ব্যবহার করা হত। মৃত গবাদি পশুর শরীরে থাকা ডাইক্লোফেনেক চলে যেত শকুনের শরীরে। ফল হল মারাত্মক। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভারতের প্রায় ৯৯ শতাংশ শকুন মারা যায়। এই ওষুধে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ‘সাদা-পিঠ শকুন’ ও ‘ভারতীয় শকুন’। কারণ এই দুই প্রজাতিই মানুষের খুব কাছাকাছি থাকত। ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া গবাদি পশু খেয়ে সুনিপুণ ভাবে খেয়ে সাফ করে দিত। পরিবেশ দূষণের হাত থেকে বাঁচত। তখনও ওই নিরীহ পক্ষীকুল বুঝে উঠতে পারেনি, পরিবেশের উপকারের দাম নিজেদের জীবন দিয়ে দিতে হবে।
ভারতে মোট নয় প্রজাতির শকুন দেখা যায়। তাদের মধ্যে চার প্রজাতির সংখ্যা খুব কমে গিয়েছে। তাই তাদের অতি বিপন্ন প্রজাতির মধ্যে রাখা হয়েছে। আর বাকি প্রজাতিদের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বেশি হলেও, তারাও বিপদ সীমার থেকে বেশি দূরে নেই। শকুনদের মধ্যে আকারে সব থেকে ছোট হল ‘গিধনি শকুন’ (ইজিপশিয়ান ভালচার)। আকারে গৃহপালিত মুরগির থেকে একটু বড়। গায়ের পালক সাদা আর ডানার ডগায় কালোর সীমা। মাথা ও ঠোঁট হলদে রঙের। আর সবথেকে বড় পাহাড়ি শকুন (হিমালয়ান গ্রিফন)। এদের মাথা ও গলার পালক হালকা খয়েরি ও গায়ের পালক গাঢ় খয়েরি। এদের বাসস্থান হিমালয়ে, শীত পড়লে নেমে আসে সমতলে। আর আছে আরও সাত প্রজাতি। সেগুলি হল, ‘দাড়িওয়ালা শকুন’ (বিয়ার্ড ভালচার), ‘সাধু শকুন’ (সিনেরিয়াস ভালচার), ভারতীয় শকুন (ইন্ডিয়ান ভালচার), ‘সরু-চঞ্চু শকুন (স্লেন্ডার-বিলড ভালচার), ‘সাদা-পিঠ শকুন’, ‘গ্রিফন শকুন’ এবং ‘রাজ শকুন’ (রেড হেডেড ভালচার)।
প্রকৃতিকে রোগমুক্ত রাখতে শকুন অদ্বিতীয়। এরা শুধু যে পরিত্যক্ত গবাদি পশুর মৃতদেহ খেয়ে মানবসমাজ তথা জীব-জগতকে বাঁচায় না, জীববৈচিত্র বাঁচিয়ে রাখতে এরা অনেক বড় ভূমিকা নেয়। কারণ শকুন না থাকলে পরিবেশকে রোগমুক্ত রাখার দায়িত্ব গিয়ে পড়ত কুকুর, শিয়াল, কাক বা চিলের উপরে। কিন্তু এই কাজ শকুনের মতো অত সুনিপুণ ভাবে করতে পারবে না এই প্রাণীগুলো। অথবা খাবারের জোগান বাড়লে পথের কুকুরের সংখ্যা প্রচুর বেড়ে যাবে। যার ফলে র্যাবিস রোগের প্রকোপ বাড়ার সম্ভাবনা।
শকুন বাঁচাতে তৎপর আর্ন্তজাতিক মহল। তারা সদা তৎপর। ভারতও এই বিষয়ে পিছিয়ে নেই। ভারতে ডাইক্লোফেনেক ওষুধ উৎপাদন এবং ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে। শকুনের সংখ্যা বাড়ানোর জন্যে দেশের চার রাজ্যে কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র খোলা হয়েছে। হরিয়ানার পিঞ্জোর, অসমের রানি, পশ্চিমবঙ্গের বক্সা এবং মধ্যপ্রদেশের ভোপালে। এ ছাড়াও ‘সেন্ট্রাল জু অথরিটি’ পরিচালিত চারটি কেন্দ্র জুনাগড় (গুজরাত), নন্দনকানন (ওড়িশা), হায়দরাবাদ (তেলঙ্গানা) তৈরি করা হয়েছে। পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডের মুটায় হয়েছে এমন কেন্দ্র।
বিশ্ব জুড়ে শকুন বাঁচানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ‘এনডেঞ্জার্ড ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট’ এবং ইংল্যান্ডের ‘হক কনজারভেন্সি ট্রাস্ট’ একযোগে শকুন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছিল। এখন তো সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার পৃ্থিবী জুড়ে ‘আন্তর্জাতিক শকুন সচেনতা দিবস’ পালন করা হয়। যার প্রধান উদ্দেশ্য হল, বেঁচে থাকা শকুনগুলোকে চিরতরে যাতে না হারাতে হয়। একটা অসুবিধেও রয়েছে। শকুন বছরে মাত্র একটা ডিম পাড়ে। এই ধীর বংশবৃদ্ধির গতিতে কোনও দিনই এদের সংখ্যা আগের মতো করা যাবে না। কিন্তু সকলে মিলে চেষ্টা করে এদের চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতেই পারি। প্রকৃতির পরম বন্ধু শকুন। পরিবেশের পরিস্থিতি মোটেও ভাল নয়। নানা দূষণে জেরবার দুনিয়া। এই অবস্থায় প্রাকৃতিক স্বচ্ছতা কর্মীদের সংখ্যা বৃদ্ধি খুবই জরুরি।
ভেবে দেখার সময় হয়েছে, খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে।
লেখক শিক্ষক এবং পক্ষীবিদ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy