সাংবাদিক স্বাধীন, যত ক্ষণ সে শাসকের পক্ষে। বিপরীতে যাইলেই গলা টিপিতে আসে সরকার। গোদের উপর বিষফোড়া, সরকারি কর্তাদের ‘উত্তম সাংবাদিকতা’ লইয়া লেকচার। সম্প্রতি দুইটি মালয়ালি সংবাদ চ্যানেলের উপর আটচল্লিশ ঘণ্টা নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছিল তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক। শোরগোল বাধিতে তড়িঘড়ি মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর সাজা মকুব করিয়া, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি নরেন্দ্র মোদী সরকারের ‘দায়বদ্ধতা’-র কথা স্মরণ করাইয়াছেন। মন্ত্রীর হয়তো স্মরণ নাই, নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী আন্দোলন এবং দিল্লির দাঙ্গা সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করিতে গিয়া তিন মাসে অন্তত বত্রিশ জন সাংবাদিক আক্রান্ত হইয়াছেন। তাঁহাদের ক্যামেরা ভাঙিয়া, গাড়ি পুড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে, পুলিশ সহায়তা করে নাই। দাঙ্গার সংবাদে ব্রিটিশ সংবাদসংস্থা ‘বিবিসি’-র ‘পক্ষপাতিত্ব’ দর্শাইয়া চিঠি দিয়াছেন প্রসার ভারতীর শীর্ষকর্তা। তাহাদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে যান নাই। সরকারি ‘দায়বদ্ধতা’-র সর্বশেষ পরিচয়, দুইটি সংবাদ চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করিবার হুমকি। তাহাদের কী কী দোষ দেখিয়াছে মন্ত্রক? এক, তাহাদের সংবাদ পক্ষপাতদুষ্ট, কারণ তাহাতে সিএএ সমর্থকদের দুষ্কার্য কিছু অধিক দেখা গিয়াছে। দুই, সংবাদগুলি দিল্লি পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা লইয়া প্রশ্ন তুলিয়াছে। তিন, সংবাদে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সমালোচনা করা হইয়াছে। চার, সংবাদে একটি সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণের ঘটনা অধিক দেখা গিয়াছে। যদি মন্ত্রকের গুরুমহাশয়রা বুঝাইয়া দিতেন এইগুলির মধ্যে কোনটি সাংবাদিকতার রীতিনীতি লঙ্ঘন করিল, তাহা হইলে বড়ই সুবিধা হইত। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা লইয়া প্রশ্ন সাংবাদিক না করিলে আর কে করিবে? কেনই বা সংবাদমাধ্যমে আরএসএস-এর সমালোচনা দোষাবহ?
জাভড়েকর বলিয়াছেন, সাংবাদিকদের দায়িত্বশীল হইতে হইবে। সকল পক্ষের প্রতি সুবিচার করিয়াও নিজের বিচার অনুসারে সংবাদ নির্মাণ করা— ইহাই সাংবাদিকের দায়িত্ব। একটি সংবাদ চ্যানেল সকল পক্ষকে সমান সময় দিয়া দেখাইবে, এমন কোনও দায় তাহার নাই। দিল্লির দাঙ্গায় যে সকল অপরাধ ঘটিয়াছে, কোনও সংবাদ চ্যানেল যদি তাহার জন্য কোনও এক পক্ষকে অধিক দোষী বলিয়া মনে করে, কোনও জনগোষ্ঠীকে অধিক বিপন্ন বলিয়া তাহার বোধ হয়, সে তেমনই দেখাইবে। গণতন্ত্রে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে কণ্ঠস্বরের বহুত্ব। নানা চ্যানেল-কাগজে নানা স্বর উঠিয়া আসিতে পারে বলিয়াই সকল পক্ষের স্বার্থ রক্ষিত হয়। এই কারণেই সকল সাংবাদিকের সুরক্ষা সরকারের কর্তব্য। বিরুদ্ধ স্বরকে স্তব্ধ করিলে তাহাতে কেবল সাংবাদিকের স্বাধীনতা খর্ব হয় না, সত্য বিকৃত হয়। ইহাই পক্ষপাতিত্ব। অতএব সাংবাদিককে নিরপেক্ষ থাকিবার উপদেশ না দিয়া, তাঁহাদের নিরাপত্তা দিবার প্রশাসনিক দায়িত্বটি সরকার পালন করুক। গত পাঁচ বৎসরে সাংবাদিকদের উপরে ১৯৮টি গুরুতর আক্রমণ হইয়াছে, প্রাণ হারাইয়াছেন চল্লিশ জন সাংবাদিক। সংবাদের স্বাধীনতার প্রতি মোদী সরকারের দায়বদ্ধতার এই কি নমুনা?
ক্ষমতার সম্মুখে সত্যভাষণের পুরস্কার প্রহার অথবা বহিষ্কার, ইহাই প্রত্যাশিত। কিন্তু সাংবাদিকতার পাঠ পড়াইতে গিয়া তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক এবং প্রসার ভারতী যে ভাবে দিল্লি পুলিশ এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের পক্ষ লইয়া সওয়াল করিল, তাহা অপ্রত্যাশিত। দিল্লি পুলিশের অসামান্য কৃতিত্ব কেন দেখায়নি বিবিসি, প্রশ্ন করিয়াছেন প্রসার ভারতীর কর্তা। এই স্বতন্ত্র, স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানটির এমন নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ দেখিয়া দেশবাসীরই লজ্জা করিতেছে। ইহার কি প্রয়োজন ছিল? আধিকারিকদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, বারবার নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখাইয়া লোক হাসাইবেন না। যাহারা লুব্ধ কিংবা ভীত, তাহারা বহু পূর্বেই আনত হইয়াছে। যাহারা নির্ভয়, তাহাদের সম্মান করিতে শিখুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy