Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি হওয়ার মতো লগ্নি কোথায়

ড্রাগন আর হাতির তফাত

সাম্প্রতিক ইতিহাসে দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধি একাধিক দেশে দেখা গিয়েছে। চিন বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় লম্বা সময় ধরে টানা ১০% থেকে ১১% বৃদ্ধির হার দেখা গিয়েছে। কাজেই, কাজটা অসম্ভব নয়।

পরিবর্তন: বেসরকারি পুঁজির ওপর নির্ভর করেই ভারত এগোবে, এ বারের বাজেটে সে কথাই জানালেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। ছবি: পিটিআই

পরিবর্তন: বেসরকারি পুঁজির ওপর নির্ভর করেই ভারত এগোবে, এ বারের বাজেটে সে কথাই জানালেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। ছবি: পিটিআই

দেবর্ষি দাস
শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার কতখানি? নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছেন ২০২৪ নাগাদ ভারতের জাতীয় আয়কে এই অঙ্কে পৌঁছে দেওয়াই লক্ষ্য। বাজেট পেশ করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনও বেশ কয়েক বার পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার জপলেন। একের পেছনে ১২খানা শূন্য লাগালে হয় এক ট্রিলিয়ন। মানে, এক লক্ষ কোটি। ভারত এখন যেখানে আছে, সেখান থেকে পাঁচ বছরে পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছতে হলে ফি বছর ৮% থেকে ৯% হারে আয় বাড়াতে হবে (ধরে নিচ্ছি বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির হার চার শতাংশের কাছাকাছি থাকবে)।

এই বৃদ্ধি কি সম্ভব? সাম্প্রতিক ইতিহাসে দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধি একাধিক দেশে দেখা গিয়েছে। চিন বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় লম্বা সময় ধরে টানা ১০% থেকে ১১% বৃদ্ধির হার দেখা গিয়েছে। কাজেই, কাজটা অসম্ভব নয়।

প্রশ্ন হল, কী ভাবে হবে? চিনের নাম বার বার আলোচনাতে আসছে। সঙ্গত কারণেই। ভারত দক্ষিণ কোরিয়ার মতো কম জনসংখ্যার ছোট দেশ নয়। একটা প্রকাণ্ড অর্থনীতিকে দ্রুত চালিয়ে নিয়ে যেতে যা কৌশল প্রয়োজন, হয়তো চিনের উদাহরণ থেকেই তা ভাল শেখা যায়। ঘোড়সওয়ারের থেকে হাতির মাহুত তেমন কিছু শিখতে পারে না, যতখানি পারে অতিকায় ড্রাগনের সওয়ারের থেকে। উপরন্তু, চিন শিল্পে চোখধাঁধানো উন্নতি করেছে, ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির চালিকাশক্তি পরিষেবা। কলকারখানা যত লোককে কর্মসংস্থান দিতে পারে, ব্যাঙ্ক বা হোটেল পারে না। ভারত জনবহুল দেশ, শ্রম উদ্বৃত্ত। ভারত শিল্পে উন্নতি করুক, বেকাররা উপযুক্ত কাজ পান, আর্থিক বৃদ্ধি হোক, এ রকমটাই হওয়া উচিত।

অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে বেসরকারি লগ্নিই আর্থিক বৃদ্ধিকে টেনে নিয়ে যাবে। লগ্নি হবে, কলকারখানা গড়ে উঠবে, তাতে মজদুর, ইঞ্জিনিয়ার কাজ পাবেন, তাঁরা খরচ করবেন, ফলে বাজারে পণ্যের আরও চাহিদা তৈরি হবে, তাল মিলিয়ে উৎপাদন বাড়বে, আরও কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এই ভাবে একটি ‘শুভচক্র’ সৃষ্টি হবে, যার দৌলতে দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধি হবে, চাকরি হবে, ‘সবকা বিকাশ’ হবে।

কিন্তু, লগ্নি আসবে কোথা থেকে? কোনও অর্থনীতিতে লগ্নির মূলত তিনটি উৎস থাকতে পারে। এক, দেশের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়। আমাদের জমানো টাকা ব্যাঙ্কে, ডাকঘরে গচ্ছিত থাকে, সেই টাকা নানা আর্থিক সংস্থার হাত হয়ে পুঁজিপতিদের কাছে ঋণ হিসেবে যায়। পুঁজিপতিরা লগ্নি করেন। সরকারও এই সঞ্চয় ব্যবহার করে লগ্নি করে। দ্বিতীয় উৎস, কর রাজস্ব। সরকার সে টাকা লগ্নি করতে পারে। তৃতীয় পথ বিদেশি লগ্নি। গোটা দুনিয়া জুড়ে বিপুল পুঁজি ঘুরছে। কোথায় বেশি লাভ, সে খোঁজে। এই পুঁজির প্রকারভেদ আছে। কিছু পুঁজি লগ্নি হয় সরাসরি উৎপাদনে। যেমন, কোনও বিদেশি সংস্থা ভারতে গাড়ি তৈরির কারখানা করল। এটাই ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) বা প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি। আবার, অনেক পুঁজি আসে শেয়ার বাজারে। এ পুঁজি চরিত্রে চঞ্চল, স্বল্পমেয়াদি। বাজারে অস্থিরতা তৈরি হলেই এই পুঁজি গায়েব হতে পারে।

এর মধ্যে কোন পথে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছনোর জন্য লগ্নি আসবে? গত পাঁচ বছরের গড় হিসেব অনুযায়ী ভারতে লগ্নি জাতীয় আয়ের প্রায় ৩৩% ছিল। অর্থনীতিবিদ নাগরাজ হিসেব কষে দেখেছেন, ফি বছর ৯% হারে আর্থিক বৃদ্ধির জন্য লগ্নিকে জাতীয় আয়ের প্রায় ৪১% হতে হবে। কিন্তু সঞ্চয়ের গতিক ভাল নয়। দেশের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় জাতীয় আয়ের ৩১%। কাজেই, যদি অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের ওপর ভর করেই লগ্নি বাড়াতে হয়, সঞ্চয় বাড়াতে হবে অনেকখানি। এ বড় সহজ কাজ নয়। প্রথমত, গত কয়েক বছরে সঞ্চয়ের হার বাড়ছে না, ২০০৮-এর পর থেকে ক্রমান্বয়ে কমছে। লগ্নির গতিও নীচের দিকে। দ্বিতীয়ত, আয়ের ৪০% সঞ্চয় করার মানে ভোগব্যয়কে ৬০% থেকে নেমে ৫০%-এর কাছাকাছি পৌঁছতে হবে।

চিনে সম্ভব হলে ভারতে কেন নয়? চিনে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সঞ্চয়ের হার ৪০%-এ পৌঁছে গিয়েছিল। তার পর থেকে ক্রমে বেড়েছে। তাল মিলিয়ে বেড়েছে লগ্নির হার ও জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার। কিন্তু সেখানেই হাতি আর ড্রাগনের তফাত। অতিকায় হলেও বস্তু দুটো এক নয়। চিন একদলীয় সর্বাধিপত্যবাদী শাসনে যা করতে পারে, ভারতে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেটা অসম্ভব।

দ্বিতীয় উপায়, কর বাড়িয়ে সরকারি লগ্নি বাড়ানো। এ বছর কর্পোরেট করের বোঝা কমানো হয়েছে। অতি ধনাঢ্যদের আয়করের ওপর সারচার্জ জোড়া হয়েছে বটে, তাতে খুব বেশি রাজস্ব আসার কথা নয়। সম্পদের ওপর কর, উত্তরাধিকারে পাওয়া সম্পত্তির ওপর কর বসালে সরকারের ঘরে আরও কিছু টাকা আসত। কিন্তু তা-ও হল না। উপরন্তু সীতারামন জানালেন, রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ ৩.৪% থেকে কমিয়ে ৩.৩% করা হবে। মানে, ঘাটতি বাড়িয়ে লগ্নি করা হবে, সে আশাও নেই।

অতএব, হাতে রইল বিদেশি লগ্নি। আভাস পাওয়া যাচ্ছে, বিদেশি পুঁজি দিয়েই আর্থিক বৃদ্ধির পথে হাঁটতে চাইছে কেন্দ্র। মিডিয়া, বিমান পরিবহণ, বিমা, সিঙ্গল ব্র্যান্ড রিটেল, ভিডিয়ো গেমস, কমিক্‌স ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজিকে আকর্ষণ করার জন্য সরকারি নিয়ম শিথিল করার কথা বলা হয়েছে। সিঙ্গল ব্র্যান্ড রিটেলে ভারত থেকেই জিনিস কিনতে হবে, এই আইনকে শিথিল করা হবে। বিমা ব্যবসার ইন্টারমিডিয়ারিতে ১০০% বিদেশি লগ্নি অনুমোদন দেওয়া হবে। অর্থাৎ, বিদেশি পুঁজিকে টানার উদ্দেশ্যে এই ক্ষেত্রগুলিতে নীতিগত পরিবর্তন হচ্ছে।

সীতারামন বড় গলায় দাবি করেছেন, গত বছর প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি ৬% হারে বেড়েছে। গোটা দুনিয়ায় ভারত নাকি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। সত্যি কথা হল, ভারতে বিদেশি লগ্নি নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর— জাতীয় আয়ের মাত্র দেড় শতাংশ। ২০০৮-০৯’এ তা ছিল ২.৭%। অর্থাৎ, জাতীয় আয়ের অনুপাতে বিদেশি লগ্নির পরিমাণ কমছে। অথচ বছরে ৯% আর্থিক বৃদ্ধির জন্য বিদেশি প্রত্যক্ষ লগ্নিকে জাতীয় আয়ের অন্তত ১২% হতে হবে। এ প্রায় অসম্ভব, কারণ চিনের মতো দেশেও বিদেশি পুঁজি কখনও পাঁচ-ছয় শতাংশের বেশি হয়নি। বিদেশি লগ্নি টানার চক্করে হয়তো স্বনির্ভরতাও যাবে, পুঁজিও জুটবে না।

তার চেয়েও বড় বিপদ হল, পুঁজি যদি বা আসে, সঙ্গে আসবে বিপুল অনিশ্চয়তা। এই বাজেটেই অর্থমন্ত্রী লগ্নিসংক্রান্ত বেশ কিছু নিয়ম শিথিল করেছেন। স্টার্ট আপের ক্ষেত্রেই যেমন। বিদেশি পুঁজির ওপর শিথিল নিয়ন্ত্রণ ভারতকে কোন বিপদের পথে ঠেলতে পারে, এখন তা শুধু অনুমানই করা যায়। সেই অনিশ্চয়তাকে মাথায় করে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল কি? বিদেশি পুঁজির মনরক্ষায় দেশের অর্থনৈতিক নীতি এবং রাজনীতিতেও কোথায় কতখানি দিক পাল্টাতে হবে, সেটাও দেখার।

আসলে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের মরীচিকা দেখিয়ে বাজেট বানানো কতটা কাজের কথা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা দরকার। আর্থিক বৃদ্ধি দরকার। কিন্তু কিসের উদ্দেশ্যে বৃদ্ধি? এই বাজেটে কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গ নেই, সমবণ্টনের কথা নেই, সামাজিক ন্যায়ের উল্লেখ নেই। ট্রিক্‌ল ডাউন অর্থনীতি অসাম্য বাড়াবে, তা প্রশ্নাতীত। নির্মলা সীতারামন জানিয়েছেন, গত কয়েক দশক আমরা অধিকার ভোগ করেছি, এখন কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার হাসিল করার কর্তব্য ঘাড়ে চাপিয়ে অর্থনীতিকে আরও কেন্দ্রীভূত, আরও অগণতান্ত্রিক করে তোলা হবে না তো?

আইআইটি, গুয়াহাটি-তে অর্থনীতির শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

Nirmala Sitharaman Union Budget 2019
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy