ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার মেঘ। আর মাটিতে দেশপ্রেমের নতুন চাষ। নতুন এই অর্থে যে এ দেশপ্রেমে দেশের চেয়ে দ্বেষ বেশি। এই দ্বেষী দেশপ্রেমের দেশজোড়া চাষে জলসিঞ্চন সাভারকর, গোলওয়ালকর, হেডগারীয় হিন্দুত্ব— যা উগ্র, একরৈখিক।
একটু ভেঙেই লিখি। গত লোকসভা নির্বাচনের পর এই ভারত প্রথম অবাক হয়ে দেখল রীতিমতো সংসদে দাঁড়িয়ে কোনও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি (সাংসদ প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর) গাঁধী হন্তারক গডসেকে দিচ্ছেন দেশপ্রেমিকের তকমা।
জানুয়ারি ৩০, ২০২০। খোদ রাজধানী দিল্লির জামিয়া মিলিয়া। নয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও অন্য ইস্যুতে ছাত্রদের মিছিল আটকাতে পুলিশি ব্যারিকেড। তার মধ্যেই হঠাৎ সাদা প্যান্ট, কালো জ্যাকেট পরিহিত স্বঘোষিত হিন্দুত্ববাদী রামভক্ত গোপাল। লক্ষ্য আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রী, যাদের মুখে আজাদির স্লোগান। রামভক্ত গোপালের পিস্তল গর্জে উঠে বল— ‘ইয়ে লো আজাদি’।
না, কোনও বলিউডি থ্রিলারের চিত্রনাট্য নয়। একেবারেই বাস্তব। কিন্তু মাটির বাস্তব কী? বিশেষ করে আমাদের এত কালের চেনা ভারতের মাটির বাস্তব কী এমন? ফিকশনের চেয়েও অবিশ্বাস্য এ বাস্তব ঠিক মাটির বাস্তব নয়, এ বাস্তব পরিকল্পিত, রীতিমতো চাষ করা।
এই চাষের শুরু অবশ্য খুব কম দিনের নয়। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকেই। সাভারকরের হাতে। হালে তার ফসল প্রায় গোলা ভরা। এই দ্বেষী দেশপ্রেমের দেশজোড়া চাষের আবহেও দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ (যাদের সিংহভাগই অমুসলিম) এখনও এই চাষের ফসলকে ভারতাত্মার পক্ষে বিষ মনে করে। এটাই আশার। এটাই ভরসার। সেই হতাশা থেকেই হিন্দু মহাসভার মতো সংগঠন জামিয়া মিলিয়ার এই দৃশ্যপট তৈরির বন্দুকবাজকে দিতে চায় দেশপ্রেমিকের তকমা। কানে আসে সংগঠনের তরফে তাকে পুরস্কৃত করার সগর্ব ঘোষণা। বলে দেওয়া হয় সে নাকি গাঁধী হন্তারক নাথুরাম গডসের মতো সত্যিকার দেশপ্রেমিক! তৈরি হয় এক একটা এমন দৃশ্যপট, যা আবহমান ভারতীয় মানসের সঙ্গে আদৌ খাপ খায় না।
আবহমান ভারতীয় সনাতন ভাবাদর্শ কী বলে? বলে সমন্বয় ও সর্বগ্রহিতার কথা। এটাই বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ, গাঁধী, সুভাষের ভারত। তার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে ১৯২৩-এ সাভারকর লিখলেন— ‘Hindutva: Who is a Hindu?’ নামে এক পুস্তিকা। ‘হিন্দু’ শব্দের প্রথম ঐতিহাসিক ব্যবহার ও বুৎপত্তিকে কার্যত নস্যাৎ করে তিনি তৈরি করলেন এক স্বকল্পিত হিন্দুত্বের সংজ্ঞা— “A Hindu means a person who regards this land of BHARATBARSHA, from the Indus to the Seas as his Father-Land as well as Holy-Land that is the cradle land of his religion.” অর্থাৎ, সিন্ধু থেকে সমুদ্র পর্যন্ত এই ভারতভূমি শুধু জন্মসূত্রে ‘পিতৃভূমি’ হলেই চলবে না, তাকে ধর্মাচরণের পরিসরে দিতে হবে ‘পুণ্যভূমি’র মান্যতা। অর্থাৎ এই যুক্তিতে শ্রুতি-স্মৃতি-পুরাণ নির্ভর সনাতন ভাবাদর্শ-অনুসারীরা এবং বড়জোর কিছু শর্তে জৈন, বৌদ্ধ, ও শিখ সম্প্রদায় এই তথাকথিত একরৈখিক ‘হিন্দুরাষ্ট্র’র অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি, পারসিকরা এ দেশে জন্মসূত্রে আবদ্ধ হলেও যেহেতু তারা মক্কা, জেরুজালেম, প্যালেস্টাইন, পারস্যকে দেয় ‘পুণ্যভূমি’র স্বীকৃতি, সেহেতু তাঁরা এই ‘হিন্দুরাষ্ট্র’র অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না।
অথচ, সামান্যতম ইতিহাস জ্ঞান বলে, খোদ ‘হিন্দু’ শব্দটা পর্যন্ত পারসিকদের দেওয়া। শব্দটার প্রথম ব্যবহার করেন পারস্য সম্রাট প্রথম দারায়ুস। ১২০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনশো বছর ধরে মুসলমান শাসকেরা সিন্ধু তীরবর্তী ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বাসিন্দাদের প্রতি এই পারসিক-দারায়ুসি শব্দটা (হিন্দু) এমন ভাবে চাপিয়ে দিল যে ঢেকে গেল বিষ্ণুপুরাণ কথিত ‘ভারতী সন্ততি’— “বর্ষং তদ ভারতং নাম ভারতী যত্র সন্ততিঃ”। আর পরবর্তীতে ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয় জাগরণে যে ‘জয়হিন্দ’ ধ্বনিকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ‘ভারত সন্ততি’ মান্যতা দিল, তারও উদ্গাতা একজন মুসলমান (আবিদ হাসান), যিনি নেতাজির মহানিষ্ক্রমণের পর থেকে তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই ইতিহাস বিস্মৃতি! এ দিকে দেশজুড়ে চলছে গাঁধীর জন্মসার্ধশতবর্ষ নিয়ে হরেক উদ্যাপন। এই আবহের মধ্যেই মাঝে মাঝেই মাথা তুলছে তাঁকে নিয়ে নতুন শতাব্দীর ডিজিটাল ‘স্বচ্ছ ভারত’ নির্মাণের কারিগরদের নানা টানাপড়েন। এ সব দেখেশুনে আমাদের মতো সাধারণ ছাপোষা নাগরিকদের কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কে হন্তারক, কে দেশপ্রেমিক আর কে সন্ত্রাসবাদী— চিরায়ত প্রশ্নে অহিংসা ও সত্যাগ্রহের এই মৃত্যুঞ্জয়ী পুরুষকারকে কেন্দ্র করে আজও আবর্তিত! সময়ের কী পরিহাস!
না, এই মৃত্যুঞ্জয়ীকে শুধু একবার হত্যা করে আশ মেটেনি অনেকের। তাঁর নিহত হওয়ার দিনটিকে (৩০ জানুয়ারি) স্মরণীয় করে রাখতে তাঁর প্রতিকৃতিতে প্রতীকী গুলি ছুঁড়ে তাঁকে হত্যার যে আনুষ্ঠানিক আয়োজন গত বছরের শুরুতেই এই ভারত দেখল, তা নজিরবিহীন। প্রতিদিন তাঁর সত্যাগ্রহ ও অহিংসার অহরহ হত্যা তো হচ্ছেই। জনতার তুমুল হাততালি ও গাঁধী-বিরোধী হর্ষধ্বনি ছাপিয়ে তাঁকে হত্যার প্রতীকী গুলির আওয়াজ এই ডিজিটাল ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর কোণে কোণে পৌঁছে দেওয়ার নজিরবিহীন কৃতিত্ব, সেই সঙ্গে গডসে-বন্দনার বহর দেখে প্রকৃত অর্থেই কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল ‘স্বচ্ছ ভারত’ গাঁধীকে ছেড়ে, শুধু তাঁর রেখে যাওয়া চশমাকে বিজ্ঞাপিত করে হেঁটে চলেছে একরৈখিক উগ্র হিন্দুত্বের দিকে। ভিন্নমত ও ভিন্নপথের সহাবস্থানের সড়কেই নির্মিত প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিসর। জাতির পিতা হাত ধরে তা শিখিয়ে গেলেন কিন্তু জাতি তাঁর জন্ম সার্ধশতবর্ষে দাঁড়িয়ে তা কি শিখল?
গডসে-বন্দনার অতীত ট্র্যাক-রেকর্ড যাঁর ঝুলিতে, ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে যাঁকে সংসদে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাওয়ানো হল, যাঁকে তড়িঘড়ি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের উপদেষ্টা কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হল, যাঁকে প্রধানমন্ত্রী কোনও দিন মন থেকে ক্ষমা করতে পারবেন না বলে ঘোষণা রাখেন, মালেগাঁও বিস্ফোরণ-কাণ্ডে নাম উঠে আসা ওই সাংসদের প্রতিরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটিতে জায়গা হয়েছিল কী ভাবে? আর কী ভাবেই বা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীনস্ত এক ডজন পুলিশ জামিয়া মিলিয়ায় প্রকাশ্যে গুলি চালাতে দেখেও নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল?
২০০১ সালে হলিউড প্রায় দশ হাজার কোটি মার্কিন ডলার খরচ করে তৈরি করেছিল অসাধারণ থ্রিলার ‘The Mummy Returns’। ব্যবসাও খারাপ করেনি। এ বার কি এই আকাশছোঁয়া মন্দার বাজারে নতুন বলিউডি থ্রিলার ‘গডসে রিটার্নস’? উত্তরের জন্য সেই পরিহাসপ্রিয় সময়ের কাছেই অপেক্ষা রইল।
লেখক স্কুল শিক্ষক, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy