Advertisement
E-Paper

জীর্ণদশা ঐতিহ্যময় কাঁটাবেড়িয়া রাজবাড়ির

অধিকাংশ পর্যটক কাঁটাবেড়িয়ার ঐতিহ্যময় রাজবাড়ি বা মঠ দর্শন করেন না। কিন্তু অজয়ের ও পাড়ের জয়দেব মেলার মতোই গুরুত্ব দিয়ে কাঁটাবেড়িয়ার রাজবাড়িকেও সংস্কার করে প্রচারের আলোয় আনা সম্ভব হলে এটিও দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। লিখছেন সুকুমার বর্ধন ১২৬০ বঙ্গাব্দে মোহন্ত রাধারমণ ব্রজবাসী শিষ্যদের নিয়ে অজয় নদের ধারে কেঁদুলি গ্রামে কবির জন্মভিটেতে এসে নিম্বার্ক আশ্রম স্থাপন করেছিলেন।

কাঁটাবেড়িয়া রাজবাড়ি। ছবি লেখক

কাঁটাবেড়িয়া রাজবাড়ি। ছবি লেখক

শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২০ ০৪:৪৮
Share
Save

বৃন্দাবনের নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের মতে কবি জয়দেব ছিলেন তাঁদের ৪৬ তম কুলগুরু। ১২৬০ বঙ্গাব্দে মোহন্ত রাধারমণ ব্রজবাসী শিষ্যদের নিয়ে অজয় নদের ধারে কেঁদুলি গ্রামে কবির জন্মভিটেতে এসে নিম্বার্ক আশ্রম স্থাপন করেছিলেন। মকর সংক্রান্তির মেলার দিন তাঁরা অজয়ে ‘জয়দেব তর্পণ’ শুরু করায় মেলারও শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল। ক্রমে এঁরাই জয়দেব মেলার মূল আয়োজক হয়ে ওঠেন। এই জয়দেব মেলা সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য মোহন্তেরা বর্ধমান রাজের কাছ থেকে বৃত্তি এবং প্রচুর দেবোত্তর সম্পত্তি পেয়েছিলেন। লব্ধ জমির অধিকাংশই ছিল অজয়ের ও পারের বর্ধমানে। তদারকির সুবিধার জন্য মোহন্তরা অজয় নদের থেকে প্রায় আট মাইল দূরে কাঁটাবেড়িয়া গ্রামে একটি মঠ তৈরি করেছিলেন। সেখানে রাধাগোবিন্দের নিত্যপুজোও শুরু হয়। প্রয়োজনে শিষ্যদের নিয়ে তাঁরা সেখানে রাতেও থাকতেন।

কাঁটাবেড়িয়ার মঠ ‘শান্তিমঠ’ নামে পরিচিত ছিল। এই মঠকে কেন্দ্র করে পাশের গ্রামগুলিতে জীবন ও জীবিকার উন্নতিও শুরু হয়েছিল। মোহন্তদের দক্ষ পরিচালনায় চাষবাসের সঙ্গে বনজ সম্পদ আহরণ আর গোপালন শুরু হয়েছিল। দেবোত্তর জমি তো ছিলই, তার উপরে মোহন্তেরা কাঁটাবেড়িয়ার আশাপাশের গ্রামগুলির বেশ কয়েক’শো বিঘা জমি কিনে রীতিমতো জমিদার হয়ে উঠেছিলেন। আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় কেঁদুলির আশ্রম ও জয়দেব মেলারও জৌলুস বেড়েছিল। মোহন্তরা শান্তিমঠে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। এর ফলে মঠের কর্মকাণ্ডও প্রসারিত হয়েছিল। নিয়মিত গীতাপাঠ ও কীর্তনের আসর বসত। হত নানা মেলা আর মহোৎসব। মোহন্তেরা অনেকটা সামন্তের মতো প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন। শান্তিমঠ কাঁটাবেড়িয়ার রাজবাড়ি হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। এক সময় নাকি পাইক, বরকন্দাজও নিযুক্ত হয়েছিল সেখানে। সে কালে কেঁদুলির নিম্বার্ক আশ্রম রাজরাজেশ্বর মঠ হিসেবে গণ্য হত।

কাঁটাবেড়িয়া রাজবাড়ির স্বর্ণযুগের মোহন্তদের মধ্যে রাধারমণ ব্রজবাসী, দামোদরচন্দ্র ব্রজবাসী, রাসবিহারী ব্রজবাসী, হরিকান্ত শরণদেব প্রমুখের নাম প্রবীণ গ্রামবাসীরা এখনও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। সাধনার জন্য মোহান্ত রাসবিহারী ব্রজবাসী কেঁদুলির নিম্বার্ক আশ্রম ত্যাগ করে কাঁটাবেড়িয়ায় শান্তিমঠে দীর্ঘকাল ছিলেন।

কালের নিয়মে কাঁটাবেড়িয়ার মঠের গৌরবময় অধ্যায় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সম্পত্তির লোভ, পাশের জমিদারদের শত্রুতা, প্রজাবিদ্রোহ ইত্যাদি কারণে আশ্রম ও মঠে সঙ্কট ঘনীভূত হয়েছিল। মোহন্ত পদের উত্তরাধিকার নিয়ে শেষ পর্বে মামলা মোকদ্দমাও হয়েছিল। তবে এর মধ্যে দামোদর ব্রজবাসী প্রজাদের প্রতি সহৃদয় ছিলেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধেও প্রজারা বিদ্রোহ করেছিল। অভিযোগ, কাঁটাবেড়িয়া রাজবাড়িতেই ব্রজবাসী খুন হয়েছিলেন। জীর্ণ রাজবাড়ির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে এমন নানা কাহিনি।

নানা দুর্বিপাকের কারণে ১৯৮১ সালে কেঁদুলির নিম্বার্ক আশ্রমের মোহন্তদের থেকে জয়দেব মেলার দায়িত্ব মেলা কমিটির হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে কাঁটাবেড়িয়ার মঠেও পালাবদল ঘটেছে। অনেক দেবোত্তর সম্পত্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। দুর্গাপুর ইস্পাতনগরী থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে কাঁটাবেড়িয়া গ্রামের অবস্থান। শান্তিমঠের কয়েক হাত দূর দিয়ে গিয়েছে জয়দেব মেলামুখী পথ। এ পথে প্রতি বছর মকর সংক্রান্তির দিন শত শত দু’চাকা আর চার চাকার গাড়িতে হাজার হাজার মানুষ জয়দেব মেলা দর্শন করতে যান। কিন্তু অধিকাংশ পর্যটক কাঁটাবেড়িয়ার ঐতিহ্যময় রাজবাড়ি বা মঠ দর্শন করেন না। অথচ সীমিত পরিসরে এখানে এখনও রাসমেলা, দোলযাত্রা, জন্মাষ্টমী ও রাধাষ্টমীর উৎসব পালিত হয়। আয়োজিত হয় দুর্গাপুজোও। গোষ্ঠমেলা বন্ধ হয়ে গেলেও এই দিনটি পালনের জন্য মঠের প্রাঙ্গণে যাত্রাপালার ব্যবস্থা হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে হয় রাধাকৃষ্ণের নিত্যপুজো।

জীর্ণ রাজবাড়ির সামনের দিক এখনও রীতিমতো দর্শনযোগ্য। বাঁ দিকে, রাসমঞ্চের উঁচু পঞ্চরত্ন চূড়া দূর থেকেও দেখা যায়। মঞ্চের দু’দিকের স্তম্ভে রয়েছে কৃষ্ণের লীলা ও সহচরীদের পেলব মুখমণ্ডলের কয়েকটি সুন্দর টেরাকোটার অলঙ্করণ। কিন্তু দায়সারা ভাবে সাদা পেন্ট বুলিয়ে দেওয়ায়, সে সবের নাক, মুখ, চোখ এখন বোঝা মুশকিল। তোরণ দ্বারের উপরে স্থাপিত রয়েছে দু’টি ময়ূর। ডান দিকের, প্রথম মন্দির কক্ষে রয়েছে কৃষ্ণের রাসলীলার সহচরীদের ছোট ছোট মূর্তি।

রাধামাধবের মূল মন্দিরে স্থাপিত হয়েছে রাধাকৃষ্ণের সুন্দর সুসজ্জিত মূর্তি। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায় পুরোহিত পুজো করেন। রাজবাড়ির অন্দর মহলের জীর্ণদশা খুবই প্রকট। যত্রতত্র দালানের ইট ও পলেস্তারা খসে পড়েছে। বড় বড় প্রকোষ্ঠগুলি ভগ্নপ্রায়। ছাউনি নেই। মোটা মোটা গোলাকার স্তম্ভগুলি এখনও অটুট। এগুলিই যেন গৌরবময় অতীতের স্মৃতি বহন করছে। রান্নাঘরটি এখন কেবল প্রাত্যহিক অন্নভোগ রান্নার জন্য ব্যবহৃত হয়। প্রাঙ্গণের মাঝে বাঁধানো কুয়ো। কাছে এখনও রাখা আছে বড় আকারের লোহার কড়াই। এটি অতীতের মোচ্ছবের কথাই স্মরণ করে। অজয়ের ও পারের জয়দেব মেলার মতোই গুরুত্ব দিয়ে কাঁটাবেড়িয়ার রাজবাড়িকেও সংস্কার করে প্রচারের আলোয় আনা সম্ভব হলে আগামী দিনে এটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।

এএসপি-র প্রাক্তন কর্মী

Kantaberia Rajbari Makar Sankranti

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}