‘চিত্রা নদীর পারে’ ছবির একটি দৃশ্য
আপনার ছবিতে প্রায়ই প্রান্তিক মানুষের কথা।
সব দেশের শাসকরাই এমন একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করে থাকে যে, সব কিছু ভালই চলছে, কোথাও কোনও ক্রন্দন নেই। কিন্তু আমাদের শিল্পীদের তো সব স্তরের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয়, সমস্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে হয়, সে-সব অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা বুঝতে পারি সব কিছু ঠিকমত চলছে না। ফলে রাজার গায়ে কাপড় নেই— এ কথাটা তো আমাদেরই বলতে হবে।
বাংলাদেশে প্রান্তিক বা সংখ্যালঘু বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন?
মূলত তিন ধরনের সংখ্যালঘু আমাদের দেশে। এক, বাঙালি হিন্দু। দুই, চাকমা, মার্মা, এই সব পাহাড়ি জনজাতি। তিন, উর্দুভাষী মুসলমান। বাংলাদেশে এই তিন সম্প্রদায়ের কারও অবস্থা তেমন ভাল নয়। আমি আলাদা আলাদা ছবি করেছি এদের নিয়ে। একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা বা তার সরকার দেশটাকে ঠিক মতো চালাচ্ছে কি না, একটা দেশ প্রকৃত গণতান্ত্রিক হতে পেরেছে কি না, সবার প্রতি সমান সুবিচার করছে কি না, সেটা সেখানকার ক্ষমতাশালী সম্প্রদায়ের জীবনযাপন দিয়ে বোঝা যাবে না, বুঝতে হবে প্রান্তিক সংখ্যালঘু বঞ্চিত অংশটার বেঁচে-থাকা দিয়ে, তারাই আসল মাপকাঠি।
আপনার চিত্রা নদীর পারে, জীবনঢুলী, একটি গলির আত্মকাহিনী, এই ছবিগুলি তো বাঙালি হিন্দুদের নিয়ে।
আমি মনে করি সাতচল্লিশের দেশভাগের ফলে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা স্বদেশ ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ পাকিস্তান আমলে হিন্দু পরিবারের পক্ষে পেশা, সম্পত্তি ও সম্মান নিয়ে বসবাস করা ক্রমশই কঠিন হয়ে পড়ছিল। এই নিয়েই চিত্রা নদীর পারে। আর জীবনঢুলী পূর্ববঙ্গের নিম্নবর্গের এক দরিদ্র হিন্দু ঢাকিকে নিয়ে। নিম্নবর্গের দরিদ্র হিন্দুরা তো দ্বৈত ভাবে শোষিত— সংখ্যাগুরু মুসলমানদের দ্বারা, আবার স্বজাতির উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা। এদের কথা কেউ বলে না। একটি গলির আত্মকাহিনী পুরনো ঢাকার শাঁখারীবাজার গলিটা নিয়ে। ওই পরিশ্রমী মানুষেরা হিন্দু বলে পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন দাঙ্গায় শাঁখারীবাজারের উপর হামলা হত, ১৯৭১-এ ২৫ মার্চ রাতে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিকল্পিত ভাবে ওই গলিটার উপর গণহত্যা চালায়।
বাংলাদেশ হওয়ার পরও পরিস্থিতি পালটাল না কেন?
বাংলার মুসলমান, বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ— সকলের দেশ হবে বাংলাদেশ, এমন একটা সমতার বোধ থেকে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর থেকে তো... ক্রমে শাসকগোষ্ঠী ভাবতে শুরু করে, বাংলাদেশ মূলত বাঙালি মুসলমানের রাষ্ট্র। অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব বা কর্তব্য তারা নিশ্চয়ই পালন করে, কিন্তু তাঁদের সমানাধিকার আছে— এটা বোধহয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজন মনে করেন না।
এই বঞ্চনার বোধটা কি পাহাড়ি জনজাতি আর উর্দুভাষী মুসলমানদের মধ্যেও?
পাকিস্তানি আমলে ষাটের দশকে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়, পাহাড়িরা কর্ণফুলী উপত্যকার হাজার হাজার একর উর্বর কৃষিজমি হারিয়ে ফেলেন। পরে, আশির দশকে, সমভূমির প্রায় পাঁচ লক্ষ দরিদ্র ভূমিহীন বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে এসে বাংলাদেশ সরকার সেনাবাহিনীর সহায়তায় কৃত্রিম ভাবে বসতি করায়। পাহাড়িরা অস্ত্র তুলে নেয়, সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটতে থাকে। অনেক জায়গাতেই সেনাবাহিনীর আচরণ মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, পাহাড়িরা নির্যাতিত হতেই থাকেন। ১৯৯৭-এ পাহাড়িদের সঙ্গে সরকারের শান্তি চুক্তি হয়, সশস্ত্র সংঘাত কমে, কিন্তু পাহাড়িদের জমি দখল, পাহাড়ি নারীদের উপর অত্যাচার ও বঞ্চনা-পীড়ন চলতেই থাকে। এই নিয়েই কর্ণফুলীর কান্না। আর স্বপ্নভূমি উর্দুভাষী মুসলমানদের নিয়ে। এদের একটা বড় অংশ বিহার থেকে এলেও অনেকেই এসেছিল উত্তর ভারতের নানা জায়গা থেকে, হায়দরাবাদ থেকে, কলকাতা থেকেও। পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক শাসকচক্র এদের বাঙালিদের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করত, দাঙ্গাও বাধাত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর হিসেবে এরা গণহত্যা, লুটপাঠেও যোগ দেয়। স্বভাবতই বাঙালিরা এদের ঘৃণা করত। সেই ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা স্বাধীন বাংলাদেশেও বজায় থাকে। এদের মধ্যে কিছু পরিবার পাকিস্তানে চলে যেতে পারে, বাকি বিরাট অংশটা বাংলাদেশেই রয়ে যায়, সব রকম অধিকারবঞ্চিত হয়ে। পাকিস্তান আমলে আমরা বাঙালিরা যখন নিপীড়িত জাতিসত্তা ছিলাম তখন জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমরা কত কিছু বলেছি, আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। কিন্তু যখন আমাদের নিজেদের একটা রাষ্ট্রশক্তি হল, তখন দেখা গেল দুর্বল সংখ্যালঘু জাতিসমূহের বিরুদ্ধে সে রাষ্ট্রশক্তির ব্যবহারে বাঙালি শাসকশ্রেণির আগ্রহের কমতি নেই। তারা ভুলে গেল— এক ফুলে কখনও বাগান সুন্দর হয় না।
রাষ্ট্রের তরফ থেকে অবস্থায় উন্নতি সাধনের চেষ্টা আছে নিশ্চয়ই।
আছে। কিন্তু রাষ্ট্র আর সমাজ এক নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখন অনেকটাই অসাম্প্রদায়িক, সমাজ বরং দিনে দিনে চলে যাচ্ছে মোল্লাতন্ত্রের হাতে। পাকিস্তান আমলে উল্টোটা দেখেছি, রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক ছিল, কিন্তু আমাদের বাঙালি সমাজটা অসাম্প্রদায়িক ছিল, সংখ্যালঘুদের প্রতি সহমর্মী ছিল। সম্প্রদায়গত ভাবে শুধু নয়, চিন্তাভাবনায় এগিয়ে থাকলেও এখন সংখ্যালঘু হয়ে পড়তে হচ্ছে, মুক্ত চিন্তার ব্লগারদের তালিকা বানিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। রাষ্ট্র অপরাধীদের ধরতে সচেষ্ট হচ্ছে, ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর তদন্ত করছে, কিন্তু আরও উদ্যোগী হয়ে আগে থেকেই চেষ্টা করা উচিত।
গণতন্ত্রের এই সংকট কি ভারতেও?
ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনেক দিন ধরে সুদৃঢ়। তা ছাড়া আমি এ দেশের অতিথি, তাই বেশি কথা বলা শোভা পায় না। তবুও শুনতে পাই, কাগজপত্রে পড়ি, এখানেও সংখ্যালঘু মানুষজন সব সময় সমান সুযোগ পায় না, তার একটা উদাহরণ সাচার কমিটির রিপোর্ট। সরকারের উচিত আরও গভীরে গিয়ে, ভিতরে ঢুকে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের প্রত্যন্ত মানুষগুলির কাছে পৌঁছনো। সংস্কারমুক্ত ‘সেকুলার’ শিক্ষা-সংস্কৃতির ভিতর দিয়েই সে উন্নয়ন সম্ভব। বুদ্ধির মুক্তি চাই। ধর্মবিশ্বাসী এবং ধর্মবিশ্বাসহীন, দু’ধরনের মানুষেরই নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির, বিচারব্যবস্থা বা সংসদের আরও দৃঢ় হওয়া দরকার। সরকার যদি নিরপেক্ষ না থাকে, উগ্রতার পক্ষ নেয়, খুবই দুঃখজনক। আশা করি ভারতে এটা আর ঘটবে না।
মুক্ত কণ্ঠে কথা বলতে বাধা পান না?
অনেক সময়ই দেখেছি, আমাদের দেশের শিল্পীরা বা সাংবাদিকরা ‘সেল্ফ-সেন্সর’ করেন। এটা একটা জাতির মেধা বা সার্বিক বিকাশের পক্ষে ভাল না, সমাজকে দমিয়ে রাখে, পিছিয়ে দেয়। আমাদের দেশের অনেক এগিয়ে-থাকা মানুষই, যাঁরা রোল-মডেল হতে পারেন সমাজের, তাঁরা হয় রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয় রাষ্ট্রক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ক্ষমতা চাওয়াপাওয়া নিয়েই তাঁরা মাথা ঘামান, সমাজ নিয়ে ঘামান না। দুর্ভাগ্যজনক বাংলাদেশের পক্ষে। মধ্যযুগের পারস্য সুফি সাধক আলেম মাওরি সুফিয়ান বলেছিলেন: ‘রাজাদের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ যিনি শিল্পীর সাহচর্য চান, আর শিল্পীদের মধ্যে তিনিই নিকৃষ্ট যিনি রাজার সাহচর্য চান।’ আমি এটা বিশ্বাস করি, সব সময় মনে মনে আওড়াই।
সাক্ষাৎকার: শিলাদিত্য সেন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy