Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

লজ্জাহীন

সমগ্র ঘটনায় সূর্যালোকবৎ সংশয়াতীত— এ দেশে নাগরিক ব্যক্তি-পরিসরে নিভৃতি বস্তুটির সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটানো হইয়াছে। যে রাষ্ট্র নিজেকে গণতান্ত্রিক বলিয়া দাবি করে, তাহার পক্ষে এই বিলোপসাধন অতীব গর্হিত অপরাধ।

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

নিজের দোষ ঢাকিতে অন্যের দোষ ধরিবার চেষ্টা— মোটামুটি সর্বজনীন অভ্যাস। ইহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই। বিস্ময় এইখানেই যে, নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে যে ‘দোষ’-এর অভিযোগ উঠিয়াছে, তাহা এতই গুরুতর যে এমন পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হইতে প্রধানমন্ত্রী সকলেরই জবাবদিহি করিবার দায় বর্তায়, অথচ তাঁহারা কেবল তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রককে দিয়া সাফাই যুক্তি তথা প্রতিপ্রশ্ন উঠাইতে ব্যস্ত। হোয়াটসঅ্যাপ হইতে অভিযোগ: গত মে মাসের জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্তত দুই ডজন ভারতীয় সাংবাদিক ও সমাজকর্মীর উপর গোপন নজরদারি চালাইবার জন্য এক ইজ়রায়েলি কোম্পানির তৈরি ‘স্পাইওয়্যার’-এর মাধ্যমে সাইবার-গুপ্তচরবৃত্তি চালানো হইয়াছে। হোয়াটসঅ্যাপের ভিডিয়ো কলের মধ্য দিয়া এই হ্যাক-কর্মপদ্ধতি চলিয়াছে। এতই নিশ্চিত সেই পদ্ধতি যে উপভোক্তা ভিডিয়ো কলটি গ্রহণ না করিলেও তাঁহার ফোনের সমস্ত তথ্য গুপ্ত তদন্তকারীদের হাতে চলিয়া গিয়াছে। হোয়াটসঅ্যাপ অভ্যন্তরীণ তদন্ত চালাইয়াছে এই খবরের জেরে, এবং তদন্ত শেষে উদ্দিষ্ট ব্যক্তিদের সাবধান করিয়াছে, কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই তাঁহাদের পূর্ণ পরিচয় প্রকাশ্য করে নাই। তবে কিনা, উদ্দিষ্ট ব্যক্তিদের যেটুকু পরোক্ষ পরিচিতি জানা গিয়াছে, তাহাতেই বোঝা যায়, পূর্বতন মোদী সরকারের দিক হইতে তাঁহাদের লইয়া কেন গোপন ও অবৈধ তদন্ত চালানো সম্ভব। হোয়াটসঅ্যাপের অভিযোগ ভাসিয়া আসিবার পর স্বভাবতই বিজেপি সরকারের উত্তর দিবার দায় জন্মাইয়াছে। উত্তর দিতে এই সরকার অভ্যস্ত নহে। তাই তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী উল্টা প্রশ্ন ছুড়িয়া দিয়াছেন। হোয়াটসঅ্যাপ আরও আগে কেন সক্রিয় হইল না, কেন তাহারা ওই ব্যক্তিদের পরিচয় জানাইতেছে না, ইত্যাদি। সাধারণ মানুষও অনুমান করিয়া লইতে পারেন এই ‘কেন’সমূহের কী জবাব হইতে পারে। কোনও সরকারের বিরুদ্ধে এত গুরুতর অভিযোগ তুলিবার আগে যে মাপের নিশ্চিতকরণ জরুরি, তাহা তদন্তসাপেক্ষ বটেই। এবং ওই ব্যক্তিদের পরিচয় প্রকাশ্য করা অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ হইত। এই মাপের অনৈতিক কাজ করিয়াও যে অন্যের দিকে অনায়াসে আঙুল তুলিয়া পার পাইবার প্রয়াস করা যায়, ২০১৯ সালের ভারতেই তাহা সম্ভব।

সমগ্র ঘটনায় সূর্যালোকবৎ সংশয়াতীত— এ দেশে নাগরিক ব্যক্তি-পরিসরে নিভৃতি বস্তুটির সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটানো হইয়াছে। যে রাষ্ট্র নিজেকে গণতান্ত্রিক বলিয়া দাবি করে, তাহার পক্ষে এই বিলোপসাধন অতীব গর্হিত অপরাধ। গুপ্তচর-প্রকল্পটির নাম ‘গঙ্গা’ দিয়া ‘শোধন’-অনুষঙ্গ তুলিবার মধ্যে যেমন বিকৃত স্পর্ধার পরিচয়, তেমনই নাগরিকের বিরুদ্ধে কোনও বিশেষ অভিযোগ ছাড়াই সন্ত্রাস, রাষ্ট্রদ্রোহ ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণপূর্বক ভীতি উৎপাদন করিয়া এই কাজ করিবার মধ্যে নির্লজ্জতা স্পষ্ট। সাংবাদিক কিংবা সমাজকর্মীরা সরকারের অপছন্দের কাজ করিলেই তো তাহা সন্ত্রাস বা রাষ্ট্রবিরোধিতার সহিত তুলনীয় হইতে পারে না। এই সহজ কথাটি মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বহু বার বলা হইয়াছে, প্রতি বারই সরকার তাহা উপেক্ষা করিয়াছে, কিংবা সন্তোষজনক যুক্তি দিতে পারে নাই। তবুও বলা দরকার যে এই হোয়াটসঅ্যাপ ঘটনাটি ঠিক অন্যান্য ঘটনার মতো নহে। ইহার মধ্যে একটি বিশিষ্টতা আছে। বিদেশি কোম্পানির সহায়তা কিনিয়া নিজের দেশের নাগরিকের ব্যক্তিপরিসর ধ্বস্ত করিবার মধ্যে এক ধরনের নির্ভীক যথেচ্ছাচার আছে। সরকার যখন এই স্তরের যথেচ্ছাচারে নিমজ্জিত হয়, নাগরিক সমাজের পক্ষ হইতে স্পষ্ট ও তীব্র প্রতিবাদ ওঠা জরুরি। না উঠিলে নিশ্চিত বিপদের দিকে অগ্রসর হওয়া ভিন্ন গতি নাই। এবং সেই বিপদ সামগ্রিক ভাবে গণতন্ত্রেরই। স্বৈরতন্ত্রের সহিত গণতন্ত্রের যদি এইটুকু পার্থক্যও অবশিষ্ট না থাকে তাহা হইলে খামকা তন্ত্রনামে প্রভেদ রচনার আর দরকার কী।

অন্য বিষয়গুলি:

WhatsApp Surveillance Israeli Spyware
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy