রামনারায়ণ দেব ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে মসূয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এই গ্রামই সুকুমার রায়ের বাপ-ঠাকুরদাদার আদি নিবাস বলে পরিচিত। কাছাড়ের নীল পাহাড়ের অনতিদূরে, আম-জাম-কাঁঠালের বনে ছাওয়া, বড় বড় পুকুরে ভরা অঞ্চলের নিজস্ব আবহাওয়া ছিল। অন্য দিকের ঘন বন পূর্ববঙ্গের সুন্দরবনের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সুকুমারের পিতামহের আমলেও গ্রামের মধ্যে বড় বড় বাঘ ঘুরে বেড়াত; গরু-বাছুর, ছাগল, হাঁস, কুকুর ধরে নিয়ে যেত, মানুষ নিতেও কসুর করত না। বুনো শুয়োর আর কুমিরের উপদ্রবও ছিল। কিন্তু মাটি ছিল মিষ্টি। সুগন্ধি চাল, লাল গোল আলু, সোনালি সুমিষ্ট আনারসের খ্যাতি কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
সুকুমার (পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ১৯৮৯) বইয়ে লীলা মজুমদার মসূয়া গ্রামের ফল-ফসলের উপযোগী মিষ্টি মাটির কথা বলেছেন; এ মাটি জন্ম দিয়েছে অনেক মহৎ মানুষেরও। সেখানে ছড়িয়ে আছে বাংলা সাহিত্যের সেরা কিছু সৃষ্টির পটভূমি, আছে বঙ্গীয় ক্রিকেটের সোনালি ইতিহাসও। বর্তমানে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলাস্থ ৭নং মসূয়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম মসূয়া। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর জন্মগ্রাম, সুকুমার-সত্যজিতের আদি ভিটে।
সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন শুরু হয়েছে এ বছরের ২ মে। এর মধ্যেই মসূয়া ঘুরে এলাম। ঢাকা থেকে ট্রেনে কিশোরগঞ্জের মানিকখালী স্টেশন, সেখান থেকে অটো-তে মসূয়া।
বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাসের বিছানা যেন ডাকছিল আমাদের, ইতিহাসের জন্ম দেওয়া রায় পরিবারের ভগ্ন ভবনের কাছে। মূল কাঠামোটি অক্ষুণ্ণ, তবে পুরো ভবন জুড়ে গাছপালার জঙ্গল। পিছনের সিঁড়িপথটা এখনও অটুট। উপরে উঠে খোলা জানালায় চোখ রাখলে মনে হয়, যেন পিছনে এসে দাঁড়ালেন উপেন্দ্রকিশোর; যেন বললেন ‘এই আমার জন্মভূমি’। পাশেই যেন টের পাওয়া যায় বঙ্গীয় ক্রিকেটের পথিকৃৎ সারদারঞ্জন, বনের খবর-এর লেখক প্রমদারঞ্জন, এবং সুকুমার, সুখলতা রাও, লীলা মজুমদার আর সত্যজিৎ রায়ের আনাগোনা। যেন আজকের পর্যটককে তাঁরা বলছেন, “দেখো, এই আমাদের শিকড়। এখান থেকেই ডানা ও দিগন্তের বিস্তার।”
দেখলাম, সামনের মাঠে ‘মসূয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিস’-এর সাইনবোর্ড— ‘অস্কার বিজয়ী সত্যজিৎ রায়ের পৈত্রিক বাড়ি’। এখানে প্রতি দিন দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক আসেন। অধিকাংশই ‘সত্যজিৎ রায়ের আদিবাড়ি’ দেখে চলে যান, অজানা রয়ে যায় মসূয়ার সম্পূর্ণ মাহাত্ম্য।
লীলা মজুমদারের লেখা সূত্রে জানা যায়, ১৬০০ সাল নাগাদ রায় পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা রামসুন্দর দেব নদিয়ার চাকদহ থেকে ময়মনসিংহের শেরপুরে আসেন। তাঁর পৌত্র রামনারায়ণ দেবই বসতি স্থাপন করেন মসূয়াতে। ব্রহ্মপুত্র আদি মসূয়া গ্রামকে গ্রাস করলে তাঁর পরিবার উঁচু ডাঙায় এসে বড় মসূয়া নামে নতুন গ্রামে থাকতে শুরু করেন। কালক্রমে ‘দেব’ থেকে তাঁরা ‘রায়’ নামে পরিচিত হন।
রামনারায়ণের দুই পৌত্র, ব্রজরাম ও বিষ্ণুরাম। ব্রজরামের পৌত্র লোকনাথ হলেন উপেন্দ্রকিশোরের ঠাকুরদা। পিতা কালীনাথ (পাণ্ডিত্যের জন্য শ্যামসুন্দর মুনশি নামে পরিচিত), মাতা জয়তারা। বিষ্ণুরামের পুত্র সোনারাম জমিদারি কিনে ‘রায়চৌধুরী’ নাম গ্রহণ করেন। সোনারামের পৌত্র হরিকিশোরের কোনও পুত্রসন্তান না থাকায় তিনি কালীনাথ ওরফে শ্যামসুন্দরের পাঁচ পুত্রের এক জনকে দত্তক নিতে চান। উদারহৃদয় শ্যামসুন্দর চার বছরের প্রিয় পুত্র কামদারঞ্জনকে (১৮৬৩-র ১০ মে মসূয়াতে যাঁর জন্ম) দত্তক দেন। হরিকিশোর তখন তাঁর নামের সঙ্গে মিলিয়ে কামদার নামকরণ করেন উপেন্দ্রকিশোর। যদিও বছর কয়েক পরেই নরেন্দ্রকিশোর নামে তাঁর এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়, তবুও উপেন্দ্র এই পরিবারেই বড় হতে থাকেন আদর-যত্নে। কিছু কাল পর দুরন্ত উপেন্দ্রকে ভর্তি করা হয় ময়মনসিংহের স্কুলে। থাকতেন হরিকিশোরের শহরস্থ বাড়ি ‘দুর্লভ ভবন’-এ। উল্লেখ্য, ময়মনসিংহে এখনও হরিকিশোরের নামে একটি সড়ক রয়েছে। এখানে থাকতেই গগনচন্দ্র হোমের সঙ্গে বন্ধুত্ব; ব্রাহ্মমত, বেহালা ও চিত্রকলায় আগ্রহের সঞ্চার। ময়মনসিংহ থেকেই এন্ট্রান্স-উত্তীর্ণ উপেন্দ্রকিশোরের কলকাতা যাত্রা। তবে হৃদয়ে লেখা ছিল মসূয়া-নাম। লীলা মজুমদারের পর্যবেক্ষণ, উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনির বই-এর ছোট ছোট সরস গল্পগুলো মসূয়ার মাঠে-ঘাটে দিদিমা-ঠাকুমাদের মুখে শোনা উপকথারই অনিন্দ্য উপস্থাপন।
উপেন্দ্রকিশোরের চার ভাই হলেন সারদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন ও প্রমদারঞ্জন। তিন বোন গিরিবালা, ষোড়শী (অকালমৃত) ও মৃণালিনী।
সারদারঞ্জন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় বোরিয়া মজুমদারের ক্রিকেট ইন কলোনিয়াল বেঙ্গল (১৮৮০-১৯৪০): আ লস্ট হিস্ট্রি অব ন্যাশনালিজ়ম, অভিষেক মুখোপাধ্যায়ের সত্যজিৎ রায়: ক্রিকেট কানেকশন অব দ্য লিজেন্ড-সহ ক্রিকেট ইতিহাসের বইপত্রে। ১৮৭৭ সালে মেলবোর্নে টেস্ট ক্রিকেটের সুবিখ্যাত আসরের ৭ বছর আগে ১৮৭০-এ মসূয়াতে সারদারঞ্জনের উদ্যোগে তাঁর ভাইদের মধ্যে তেমনই একটি ক্রিকেট-আসরের প্রচলন ঘটে। (দ্রষ্টব্য: ‘ক্রিকেট যেভাবে আমজনতার হলো’, ইফতেখার মাহমুদ, প্রথম আলো, ৫ জুলাই, ২০১৯)।
উনিশ শতকের শেষে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে ক্রিকেট ক্লাব চালু করা, আন্তঃজেলা প্রতিযোগিতার আয়োজন, ক্রীড়াসামগ্রী উৎপাদন ও বিপণন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাধুলোর বিকাশে ভূমিকা রাখার মধ্য দিয়েই মূলত ক্রিকেট এবং সামগ্রিক ভাবে ক্রীড়াকে অভিজাতদের বৃত্ত ভেঙে উপনিবেশের কালে জাতীয়তাবাদী বিকাশের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে স্মরণীয় হয়ে আছেন সারদারঞ্জন।
সুকুমার (ছবিতে) জন্মেছেন কলকাতায়, তবে বাবার সঙ্গে মসূয়ায় এসেছেন। ১৮৯৮-এ উপেন্দ্রকিশোর সপরিবারে মসূয়া ও ময়মনসিংহ ঘুরে গিয়েছেন, সুকুমারের বয়স তখন ১১। পূর্বপুরুষ লোকনাথ ৩২ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পূর্বে নাকি সন্তানসম্ভবা স্ত্রী কৃষ্ণমণিকে বলেছিলেন, “দুঃখ কোরো না, তোমার এই এক সন্তান থেকেই শতজনকে পাবে।” একে পারিবারিক কিংবদন্তি বলা হলেও সবই সত্যি হল। অকালে স্বামীহারা কৃষ্ণমণির ঘরেই জন্ম নিল কালীনাথ বা শ্যামসুন্দর। শ্যামসুন্দর আর জয়তারার ঘরে সারদারঞ্জন, প্রমদারঞ্জন, উপেন্দ্রকিশোর। তার পর সুকুমার, সত্যজিৎ।
বড় মসূয়া গ্রাম শুধু নামে নয়, সৃষ্টিতেও বহন করে চলেছে বৃহৎ এক ধারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy