Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Krishna Bose

‘সাইকেল চড়ে ফুরফুরে হাওয়ায় কৃষ্ণাদি এগিয়ে যাচ্ছেন দিল্লির পথে’

কৃষ্ণাদি আজীবন, আমৃত্যু এটাই বিশ্বাস করে গেছেন যে, নেতাজির তাহেকুর বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল। কৃষ্ণাদি নানা ভাবে এই তথ্যকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন।

১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট। সাইকেল চড়ে ফুরফুরে হাওয়ায় কৃষ্ণা বসু এগিয়ে যাচ্ছেন দিল্লির পথে।

১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট। সাইকেল চড়ে ফুরফুরে হাওয়ায় কৃষ্ণা বসু এগিয়ে যাচ্ছেন দিল্লির পথে।

শুভাপ্রসন্ন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৭:৪২
Share: Save:

আমার সৌভাগ্য যে, শিশির বসুর পরিবারের সঙ্গে খুব সুন্দর সম্পর্ক হয়েছিল। শিশির বসু আমাকে খুব ভালবাসতেন। ওরকম অমায়িক লোক আমি খুব কম দেখেছি। ওঁর সূত্রেই আমার কৃষ্ণা বসুর সান্নিধ্যে আসা। এঁদের দাম্পত্য অনেকের কাছে আজও ঈর্ষণীয়।

ময়মনসিংহের নীরদ সি চৌধুরীর ভাইয়ের মেয়ে ছিলেন কৃষ্ণা। কলকাতার নেতাজি পরিবারের বধূ হয়ে এলেন। কি অদ্ভুত সংযোগ! একদিকে ময়মনসিংহের মেধাসম্পন্ন বাড়ি, অন্যদিকে নেতাজির পরিবার—এই দুয়ের মিশেলে কৃষ্ণা বসু নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। ফলে, তাঁর মধ্যে আধুনিকতার সূচনা হয়েছিল।

বসু পরিবার কিছুটা রক্ষণশীল ছিল। ওই পরিবারে বিয়ে হয়ে আসার পর তার অনেকটাই ভেঙে ফেলেন কৃষ্ণাদি। সেই সময় অনেক পর্দানসীন মানুষদের পর্দার বাইরে নিয়ে এসেছিলেন তিনি।

১৯৯৩ সাল, শিশির বসুর সঙ্গে ইউরোপে কৃষ্ণা বসু।

আমার মনে পড়ছে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্টের কথা। কৃষ্ণাদি তখন দিল্লিতে। সাইকেল চড়ে ফুরফুরে হাওয়ায় এগিয়ে যাচ্ছেন দিল্লির পথে। কে বলবে এই মহিলাই একদিকে গুণী শিক্ষাবিদ। অত্যন্ত ভাল কথা বলতে পারতেন। ইতিহাসবিদ হিসেবে, অধ্যাপিকা হিসেবে অত্যন্ত সুনামী। আবার সুগৃহিণীও! ভাবা যায়! তার সন্তানরাও প্রত্যেকেই ব্রিলিয়ান্ট। পুত্র সুগত বসু, সুমন্ত্র বসু, কন্যা শর্মিলা বসু। শর্মিলা যে কত বড় গাইয়ে, তার কণ্ঠ, মেধা কল্পনাতীত। সবই মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া। সুগতর গায়নেও নিজস্ব ঘরানা আছে। সেটাও মায়ের জন্যই। আর সুমন্ত্রর কাশ্মীরের ওপর যে গবেষণা, তা আজ বিশ্বময় স্বীকৃত।

কৃষ্ণাদির শ্বশুরমশাই শরৎ বসু ন’বছরের বড় ছিলেন নেতাজির থেকে। সেই সুবাদেই তিনি নেতাজির অবিভাবকের মতো ছিলেন। শরৎ বসুর ছেলে শিশির বসুও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে কৃষ্ণাদিও আসেন। একাধিকবার সাংসদ হয়েছিলেন। শুধু সাংসদই নয়, বিদেশ মন্ত্রকের বিশেষ দায়িত্বও পেয়েছিলেন। ফলে, কোনও অতিথি ভারতে এলে কৃষ্ণাদিই তাঁকে রিসিভ করতেন। বাজপেয়ী থেকে মনমোহন সিংহের মন্ত্রিসভা— সব ক্ষেত্রে কৃষ্ণাদিই এই দায়িত্ব চমৎকার ভাবে পালন করেছেন। পরবর্তীকালে আমরা জানি, তৃণমূলের সাংসদ হিসেবে যাদবপুর কেন্দ্র থেকে লড়াই করে জিতেছিলেন কৃষ্ণাদি।

সুতরাং এক দিকে রাজনীতি অন্য দিকে সমাজনীতি— অসাধারণ বক্তৃতা এবং ক্ষুরধার লেখনি দিয়ে অনেক মানুষকে কাছে টেনে নিতে পারতেন কৃষ্ণাদি। কোনও সম্ভ্রান্ত বংশের রাজনীতিবিদ, বিদূষী অধ্যাপিকা নয় সাধারণ মানুষের হৃদয়ে ছিল ‘প্রিয় মাসিমা’। ওর নেতৃত্বেই শিশিরবাবুর প্রতিষ্ঠিত ‘নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো’ আরও সমৃদ্ধি লাভ করে। কৃষ্ণাদি মনে করতেন, নেতাজি কী ভাবে মারা গিয়েছেন সেই বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ নয়। নেতাজির কাজ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াই তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। রীতিমতো আগলে রেখেছিলেন নেতাজির মিউজিয়াম।

সাহিত্যিক নলিনী বেরাকে আনন্দ পুরস্কার দিচ্ছেন কৃষ্ণা বসু।

শুধু মিউজিয়াম নয়, নেতাজির কন্যা অনিতা পাফ-এর সঙ্গে প্রথম থেকেই কৃষ্ণাদি আর শিশিরবাবু খুব ভাল যোগাযোগ রেখেছিলেন। নেতাজির সহধর্মিনীর জীবিত কালেই জার্মানির অগ্সবুর্গে কৃষ্ণাদি প্রায়ই যেতেন। কৃষ্ণাদির কাছে অনিতা যেমন খুব আদরের ছিল তেমনি অনিতাও কৃষ্ণাদিকে খুব শ্রদ্ধা করতেন।

নেতাজির মৃত্যু রহস্য সবটাই এখনও ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু কৃষ্ণাদি আজীবন, আমৃত্যু এটাই বিশ্বাস করে গেছেন যে, নেতাজির তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল। কৃষ্ণাদি নানা ভাবে এই তথ্যকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। নেতাজি সম্পর্কে ওঁর রচনা চিরকালের ঐতিহাসিক গ্রন্থ হয়ে থেকে যাবে। সেই হিসেবে উনি এমন এক জন বিদূষী যে বিগত শতাব্দীকে ছুঁয়ে আজকের শতাব্দীতে তেজস্বী মাতৃময়ীরূপে এসেছিলেন। সব দিক থেকে ওঁর মৃত্যু একটা বড় ক্ষতি। আমরা আশা করি দেশবাসী, সাধারণ মানুষ এবং বাঙালি জাতি তাঁর উপযুক্ত মর্যাদা দেবে।

আজ খুব মনে পড়ছে সেই দিনটার কথা। কিছুদিন আগে শিশিরবাবুর জন্ম শতবার্ষিকী হয়েছিল। আমরা উপস্থিত ছিলাম। বক্তা হিসেবে খানিক বেদনাতুর গলায় কৃষ্ণাদি বললেন, ‘‘ শিশির চলে গেছে। শিশিরের শতবর্ষে আমি এখনও বেঁচে আছি... হয়তো তার থেকে বেশ কিছুদিনের ছোট তাই বেঁচে আছি...’’

কেন জানি না কৃষ্ণাদির সে দিনের সেই কথাগুলো বারবার ফিরে আসছে।

ছবি:কৃষ্ণা বসুর ওয়েবসাইটের আর্কাইভ এবং আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy