Advertisement
E-Paper

অভিনয় দেখে রেগে এক জন চটি ছুড়ে মারল বিকাশের দিকে

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বিকাশকে এক দিন বললেন, তুমি ফিল্মে যোগ দাও বিকাশ, তোমার হবে। আর তার পর ভাগ্যের চাকা ঘুরল অভিনেতার। ১৬ এপ্রিল নদিয়ার ভূমিপুত্র বিকাশ রায়ের মৃত্যুদিন পেরিয়ে এসে তাঁকে নিয়ে লিখছেন দীপক সাহা মারের পর মার। বীভৎস মার। তার পর, ঘাড় ধরে মেজর ত্রিবেদী স্বদেশি নেতাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল পতাকার কাছে।

শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২০ ০৩:৫৪
Share
Save

পর্দা জুড়ে তেরঙা পতাকা। বুট দিয়ে পতাকা মাড়িয়ে, অসহযোগ আন্দোলনের স্বদেশি নেতা অজয়কে ব্রিটিশ-অনুরক্ত সামরিক অফিসার মেজর ত্রিবেদী দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলছে, “দেখেছ? যাও হেঁটে এসো। Walk on it. হেঁটে এসো, যাও!”

অনড় অজয়। নির্বাক। কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁতে দাঁত চিপে মেজরের দৃঢ় উচ্চারণ, “You won't! Alright! Then take it. Take it....”

মারের পর মার। বীভৎস মার। তার পর, ঘাড় ধরে মেজর ত্রিবেদী স্বদেশি নেতাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল পতাকার কাছে। স্বদেশি আন্দোলনকারীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা মিশিয়ে মেজর দাঁত কিটমিট করে বলে উঠল, "Spit on it. I say, spit!”

ছবির নাম ’৪২’। মুক্তি পেয়েছিল অগস্ট ১৯৫১ সালে। উনিশশো বিয়াল্লিশের 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের পটভূমিকায় এই ছবির পরিচালক ছিলেন হেমেন গুপ্ত, যিনি নিজে ছিলেন জেল-খাটা স্বাধীনতা সংগ্রামী। আর ক্রূর অফিসার মেজর ত্রিবেদীর ভূমিকায় বিকাশ রায়।

ম্যাটিনি শো শেষ। কলেজের এক দঙ্গল ছেলে সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে মারমুখী হয়ে ছুটছে ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োর দিকে। স্টুডিয়োর গেটে দারোয়ান। গেট বন্ধ। গেটের সামনে তুমুল গণ্ডগোল। গালিগালাজের ফোয়ারা ছুটছে। উত্তেজিত ছেলেদের দাবি, বিকাশ রায়কে তাঁদের হাতে তুলে দিতে হবে। তাঁরা বদলা চান। তুমুল চিৎকার, চেঁচামেচি শুনে বিকাশ রায় বাইরে বেরিয়ে এলে এক ছেলে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে বিকাশ রায়কে চটি ছুড়ে মারল। সেই চটি মাথায় নিয়ে বিকাশ বলেছিলেন, "আজ আমার অভিনয় সার্থক হল।"

নদিয়ার প্রিয়নগর গ্রামে কালীগঞ্জ বাজারে নিজের ইলেক্ট্রিক্যালস দোকানে বিকাশ রায়ের ভাইপো সত্তর উত্তীর্ণ সুদিন রায় ডিসেম্বরের প্রথম সকালে মিঠে রোদ গায়ে লেপ্টে অনর্গল বলেছিলেন কাকার নানা জানা-অজানা কথা, গল্প। তখনও করোনা হানা দেয়নি শহরে। কাকার কথা বলতে বলতে আবেগপ্রবণ হয়ে তাঁর চোখ দুটো গর্বে চিকচিক করে উঠছিল, আবেগে গলা জড়িয়ে আসছিল। আবার কখনও কখনও কণ্ঠে অভিমান ঝরে পড়ছিল। কল্যাণীর পরের স্টেশন মদনপুর। মদনপুর থেকে শিমুরালি যাওয়ার পথে অটোয় ৪ কিমি গেলেই বাংলা চলচ্চিত্র ও মঞ্চ জগতের অন্যতম কিংবদন্তি অভিনেতা বিকাশ রায়ের পৈতৃক বসতভিটা। প্রিয়নগর, দুর্লভপাড়া। এক সময়ে প্রাচুর্যে ভরপুর বিশালাকার বনেদি বাবুবাড়ি বাবুয়ানার ঘূর্ণিপাকে এখন নিশ্চিহ্নপ্রায়। অতি অবহেলায় পড়ে থাকা একটি অব্যবহৃত পাতকুয়ো, ইটের ঢিবি আর নীল তৈরির একটি অতিভারী পাথরের নাদা অতীতের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে উঁকি মারছে।

পাশেই নতুন একটি দোতলা বাড়িতে থাকেন ভাইপো সুদিন রায় ও তাঁর পরিবার।

বিকাশ রায় ছিলেন ধনী ও বনেদি পরিবারের সন্তান।পারিবারিক আভিজাত্য যেন চুঁইয়ে পড়ত তাঁর আচার-আচরণ, অভিনয়ে। বড় হয়েছিলেন এক মুক্ত পরিবেশে। সেই প্রভাব বজায় ছিল জীবনচর্চায়।

'আমি' বইয়ে বিকাশ লিখেছেন-- প্রপিতামহ সম্পর্কে শুনেছিলাম নীলকুঠির দেওয়ান, মালিক, জমিদার, দাম্ভিক, স্বেচ্ছাচারী, অত্যাচারী।

পিতামহ সম্পর্কে বিকাশ বলেছেন, তিনি সেই প্রথম যুগের হিন্দু কলেজের ইংরাজি জানা, বড়লোক বাপের উড়নচণ্ডী ছেলে ছিলেন। বিকাশের জন্ম কলকাতার ভবানীপুরে। ১৬ মে, ১৯১৬ সাল। পিতা যুগলকিশোর রায় ছিলেন কলকাতা চিড়িয়াখানার কর্মচারী। ভারতের বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় তাঁর জীবজন্তু সরবরাহের ব্যবসাও ছিল। যুগলকিশোরের দুই ছেলে। বড় ছেলে প্রকাশ বিলেতে গিয়ে এক মেমকে বিয়ে করেন। বিলেত ফেরত তৈরি ছেলে দেড় বছর যক্ষ্মায় ভুগে মারা গেলেন। ছোট ছেলে বিকাশ।

মাত্র দশ বছর বয়সে বিকাশ মাকে হারান। কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউশন থেকে ১৯৩২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন ১৯৩৬ সালে। সিনেমা-থিয়েটারের ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় ‘বেদুইন’ নামে একটা সাহিত্য পত্রিকাও প্রকাশ করতেন।

বি.এল (আইন) পাশ করেন ১৯৪১ সালে। কর্মজীবন শুরু হয় এক ব্যারিস্টারি ফার্মের জুনিয়র হিসাবে। মজার ব্যাপার, অভিনয় জগতে যিনি ব্যারিস্টারের ভূমিকায় বিভিন্ন চরিত্রে তুখোড় অভিনয় করে দর্শকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন, সেই বিকাশ রায় বাস্তবে ওকালতি পেশায় ব্যর্থ হয়েছিলেন। বিয়ে হয়েছিল মাত্র ২২ বছর বয়সে। এই সময় খুবই দুরবস্থার মধ্যে ভবানীপুরের ভাড়া বাড়িতে স্ত্রী কমলা ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে অতি কষ্টে দিনযাপন করছিলেন। ওকালতি ছেড়ে চাকরি নিলেন সরকারি সিভিল ডিফেন্স বিভাগে, হেড ক্লার্কের। সেখানেও থাকলেন না। মাত্র আশি টাকার মাস মাইনেতে চাকুরি নিলেন রেডিয়োর ঘোষকের।

সময়টা ১৯৪৬। অল ইন্ডিয়া রেডিয়োয় সামান্য প্রেজেন্টার-অ্যানাউন্সারের চাকরি করছেন বিকাশ রায়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রায়ই মতভেদ লেগে থাকত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বিকাশকে এক দিন বললেন, তুমি ফিল্মে যোগ দাও বিকাশ, তোমার হবে।

হঠাৎই সু্যোগ এল সিনেমায় অভিনয় করার। সেই সময় চিত্রনাট্যকার জ্যোতির্ময় রায়, বছর তিরিশের যুবক বিকাশ রায়কে নিয়ে গেলেন পরিচালক হেমেন গুপ্তের কাছে।

১৯৪৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। মুক্তি পেল হেমেন গুপ্তের পরিচালিত ছবি ‘অভিযাত্রী’। রাধামোহন ভট্টাচার্য, নির্মলেন্দু লাহিড়ি, কমল মিত্র, শম্ভু মিত্র, বিনতা রায়ের মতো বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে বাংলার দর্শক প্রথম পরিচয় পেল অভিনেতা বিকাশ রায়ের। (চলবে)

(উদ্ধৃতির বানান অপরিবর্তিত)

শিক্ষক, শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা:
edit.nadia@abp.in
যে কোনও ইউনিকোড ফন্ট-এ টাইপ করে পাঠাবেন। অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

Bikash Roy Tollywood Cinema

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।