প্রার্থী: চাকরির জন্য দরখাস্তের ফর্ম ভরতে ‘কর্মসংস্থান মেলা’য়। চিনচুয়াড়, পুণে, মহারাষ্ট্র। ফেব্রুয়ারি ২০১৯। রয়টার্স
ভারতীয় শ্রমিকদের সম্পর্কে, বিশেষত তাঁদের কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব নিয়ে, যে রিপোর্টটি নির্বাচনের আগে বিজেপি সরকার প্রকাশ করতে দেয়নি, সেই পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (২০১৭-১৮) রিপোর্ট নির্বাচন মিটে যাওয়ার পর প্রকাশ পেয়েছে। সরকার প্রকাশ করতে না দিলেও রিপোর্টের আসল জায়গাটা ভোটের আগেই সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। জানা গিয়েছিল ২০১৭-১৮’র সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে বেকারত্বের হার অকল্পনীয় বেড়ে গিয়েছে। এখন সরকারি ভাবে রিপোর্ট প্রকাশ পাওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, ফাঁস হওয়া তথ্য অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।
বেকারত্ব বাড়া-কমা নির্ভর করে আগে কী ছিল আর পরে কী হয়েছে, তার ওপর। এর আগে ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে কর্মসংস্থান নিয়ে সমীক্ষা করে ২০১১-১২ সালে। সেটির পাশাপাশি ২০১৭-১৮’র সমীক্ষাকে রেখে দু’টি থেকে আলাদা আলাদা বেকারত্বের যে ধারণা পাওয়া যায় সেগুলি সারণি ১-এ দেওয়া হয়েছে। এই দুই সমীক্ষার মধ্যে তুলনা করাটা যদি বৈধ হয়, তবে এটা পরিষ্কার যে সম্প্রতি গ্রামে ও শহরে পুরুষ এবং মহিলাদের বেকারত্ব ভয়াবহ ভাবে বেড়ে গিয়েছে।
সরকার অবশ্য বলছে, সমীক্ষা দু’টির মধ্যে কিছু পদ্ধতিগত তফাত আছে, তাই তারা আদৌ তুলনীয় নয়। কথাটা ২০১৭-১৮’র রিপোর্টেও পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হয়েছে। এই কথার অনেক রকম মানে করা চলে। একটা সম্ভাব্য মানে হল, সমীক্ষা দু’টি সরাসরি তুলনা করলে যতটা মনে হয়, আসলে দেশে কর্মহীনদের সংখ্যা ততটা বাড়েনি।
২০১৭-১৮’র সমীক্ষা পদ্ধতিগত দিক থেকে কী অর্থে ২০১১-১২’র সমীক্ষার থেকে আলাদা, সেটা বোঝার আগে ভারতীয় বেকারত্বের দু’টি স্থায়ী প্রবণতার কথা বলা দরকার। আজ অবধি কর্মহীনতা-কর্মসংস্থানের যত রিপোর্ট বেরিয়েছে তার প্রত্যেকটিতে দু’টি জিনিস লক্ষণীয়। এক, গ্রামে বেকারত্বের হার শহরের চেয়ে কম। দুই, অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিতদের তুলনায় বেশি শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। এই দু’টি স্থায়ী প্রবণতার প্রধান কারণ, গরিব মানুষ কর্মহীন অবস্থায় থাকতে পারেন না। বেঁচে থাকার তাগিদে কিছু না কিছু কাজ তাঁকে করতেই হয়। সে কাজ মনের মতো না-ও হতে পারে, কিন্তু কর্মহীন থেকে মনের মতো কাজ খোঁজার বিলাসিতা তাঁর কপালে নেই। পক্ষান্তরে, যাঁরা তুলনায় সচ্ছল ঘরে জন্মেছেন, যত দিন না তাঁরা পছন্দমতো কাজ খুঁজে পাচ্ছেন, তত দিন সচরাচর পরিবার তাঁদের প্রতিপালন করে। কাজেই তাঁদের পক্ষে কিছু দিন কর্মহীন থেকে উপযুক্ত কাজ খোঁজা শক্ত নয়। যে হেতু আমাদের দেশে শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি গরিব মানুষ বাস করেন, তাই গ্রামে কর্মহীনতার হার অপেক্ষাকৃত কম। আবার এ দেশে শিক্ষার সঙ্গে পারিবারিক বিত্তের একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে, তাই মোটের ওপর অল্প-শিক্ষিতরা গরিব ঘর থেকে আসেন, অধিক-শিক্ষিতরা অবস্থাপন্ন ঘরের। গরিব ঘরের অল্প-শিক্ষিত মানুষ কর্মহীন হয়ে থাকতে পারেন না।
শ্রমজীবীদের মধ্যে কর্মরত-কর্মহীন অনুপাত আন্দাজ করার জন্য যে সমীক্ষা করা হয়, তাতে নমুনা সংগ্রহের নিয়ম মেনে কিছু পরিবারকে বেছে নিয়ে দেখা হয়, এক একটি পরিবারে কত জন কর্মরত এবং কত জন কর্মহীন রয়েছেন। আমাদের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট— পদ্ধতিগত কোনও পরিবর্তনের ফলে সংগৃহীত নমুনায় অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন পরিবারের অনুপাত বেড়ে গেলে বেকারত্বের হার সামগ্রিক ভাবে বেশি দেখাবে। ২০১১-১২’র সমীক্ষা অবধি পরিবারগুলিকে বেছে নেওয়া হত মাথাপিছু মাসিক খরচের ভিত্তিতে। এমন ভাবে নমুনা সংগ্রহ করা হত, যাতে শহরে বেছে নেওয়া পরিবারগুলির ৭৫ শতাংশ সার্বিক আয় বণ্টনের উপরের অর্ধেক অংশ থেকে আসে। ২০১৭-১৮’র সমীক্ষায় এই পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটেছে। নতুন সমীক্ষায় এমন ভাবে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, যাতে বেছে নেওয়া ৭৫ শতাংশ গেরস্থালির প্রত্যেকটিতে অন্তত এক জন সদস্য থাকেন যিনি মাধ্যমিক বা তার ওপরের কোনও স্তরের পরীক্ষায় পাশ করেছেন। প্রশ্ন হল, এই পদ্ধতিগত পরিবর্তনের ফলে সংগৃহীত নমুনায় বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে কি?
২০১৭-১৮’র রিপোর্টেই দেখতে পাচ্ছি সারা ভারতে নারী-পুরুষ মিলিয়ে ৫১.৬ শতাংশ শহরের মানুষ মাধ্যমিক বা তার থেকে বেশি কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করেছেন। আমাদের দেশে বিদ্যার্জনের স্তরের সঙ্গে পারিবারিক বিত্তের একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে। কাজেই যে ৫১.৬ শতাংশের মাধ্যমিক বা তার বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে, তাঁরা মোটের ওপর সার্বিক আয় বণ্টনের উপরের অর্ধেক থেকেই আসছেন। অর্থাৎ ২০১৭-১৮’র নমুনায় অপেক্ষাকৃত বিত্তবান পরিবারদের অনুপাত বেড়ে গিয়েছে, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই।
কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ হচ্ছে না। আমাদের দেশে যে হেতু শিক্ষার আলো একটু একটু করে সমাজের নীচের তলাতেও পৌঁছে যাচ্ছে, তাই গরিব ঘরেও আজকাল দু’এক জন মাধ্যমিক পাশ সদস্য থাকা আশ্চর্যের নয়। ফলে পুরনো পদ্ধতিতে যে ৭৫ শতাংশ নমুনায় শুধু আয় বণ্টনের ওপরের অর্ধেক থেকে পরিবাররা নির্বাচিত হত, নতুন পদ্ধতিতে সেখানে কিছু কিছু গরিব পরিবারও ঢুকে পড়ছে। ফলে নতুন পদ্ধতিতে বেকারত্বের হার কম দেখানোর একটা প্রবণতা থাকছে। অর্থাৎ পদ্ধতিগত পরিবর্তনের ফলে বেকারত্বের হার বেশি দেখানো দূরের কথা, খানিক কম দেখানোটাই স্বাভাবিক।
ব্যাপারটা আর একটু পরিষ্কার করে দেখা যেতে পারে। সারণি ২-তে পুরনো এবং নতুন সমীক্ষা অনুযায়ী মাধ্যমিক বা উচ্চতর শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার পাশাপাশি রাখা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, এই শিক্ষিতদের মধ্যে সন্দেহাতীত ভাবে বেকারত্ব বেড়েছে। এখন, ২০১৭-১৮’র সমীক্ষায় যে হেতু এই শিক্ষিতদের নমুনায় আয় বণ্টনের নিম্নার্ধের কিছু পরিবারও ঢুকে পড়ছে, তাই, অনুমান করা যায়, এই সমীক্ষায় বেকারত্বের হার বাস্তবের তুলনায় কিছুটা কমই দেখাবে। প্রকৃত বেকারত্বের হার আসলে আরও বেশি।
ভোটের ফল কি তবে একটা ধাঁধা? বেকারত্ব বেড়েছে, ক্ষমতাসীন দলের ভোটও বেড়েছে! আমরা বলব, এটা ধাঁধা নয়, একটা আসন্ন সঙ্কটের অশনিসঙ্কেত। ২০১৬-র নভেম্বরে আকস্মিক নোটবন্দি অর্থনীতির স্বাভাবিক লেনদেনগুলোকে গভীর ভাবে ব্যাহত করল, বহু মানুষ রুটি-রুজি হারালেন। পুরনো বাতিল নোটের পরিপূরক নতুন নোট বাজারে আসতে আসতে বেশ কিছু দিন লাগল। যত দিন না নগদের জোগান স্বাভাবিক হল, তত দিন ভারতীয় অর্থনীতিও ছন্দে ফিরতে পারল না। এই অবস্থায় কর্মহীনতা বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। অনুমান করাই যায়, ২০১৭-১৮’র সমীক্ষায় এই হঠাৎ বেড়ে যাওয়া কর্মহীনতার চিত্রটাই ধরা পড়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নোটবন্দি বা অন্যান্য সরকারি নীতির ফলে যাঁরা কর্মহীন হয়ে গেলেন, তাঁরা তাঁদের ক্ষোভটা ইভিএম-এ প্রকাশ করলেন না কেন? বিজেপি চিরকালই বড় ব্যবসায়ীদের সমর্থন পেয়েছে। কিন্তু ছোট ব্যবসায়ী? দিন-আনা-দিন-খাওয়া শ্রমিক? ফসলের উপযুক্ত দাম না পাওয়া কৃষক? বেকার যুবক-যুবতী? এঁরা কেন বিজেপিকে ভোট দিলেন?
অতীতে বার বার দেখা গিয়েছে, ধর্মীয় উন্মাদনা বা উগ্র জাতীয়তাবাদ মানুষের শুভবুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞানকে নষ্ট করে দেয়। তার স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধিকে ধ্বংস করে দেয়। এই কাজটা নাৎসিরা করেছিল, সাম্প্রতিক কালে আইসিস করেছে। কিন্তু, ইতিহাস সাক্ষী, এর ভবিষ্যৎ ফল কখনও ভাল হয় না। আমাদের উদ্বেগ এই জন্যই।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা’য় অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy