Advertisement
E-Paper

কৃষ্ণকলিদের কদর কাব্যে, বাস্তবে বরাদ্দ অপমান

কালো মানেই কেমন যেন। অসহ্য লাগার কারণে দৃষ্টিও সরিয়ে নেন কেউ কেউ। কালো মেয়ে স্ত্রী হন, মা হন। কিন্তু কালোর কালিমা কিছুতেই সরে না! লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলামসভ্য সমাজের শিক্ষিতরাও বলেন, ‘‘ওই যে, কালো মেয়েটার বিয়ে হল!’’ কখনও উড়ে আসে, ‘‘ওই যে, কালো করে মেয়েটা। চিনতে পারছিস না?

প্রতীকী চিত্র।

প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৯ ০২:১৯
Share
Save

কালী মায়ের উপাসনায় পায়ে লুটিয়ে পড়ে দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুলিশ, এমনকি ডাকাতও। শক্তিলাভের করুণ আকুতিতেই চলে একনিষ্ঠ আরাধনা। অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার আশাতেই এত বাজি, আলোর রোশনাই। অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা পেতেই পুজো। কিন্তু বছরভর মা কালীর নামে হেনস্থা হতে থাকেন কৃষ্ণকলিরা। পথে ঘাটে কটাক্ষ। বাড়ির লোকজনের আফসোস। বিয়ের পিঁড়ি পার করে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির কটূক্তি। কালী মায়ের বন্দনায় এত আয়োজন। কিন্তু চলমান কৃষ্ণবর্ণের মেয়েদের প্রতি এত বিদ্বেষ কেন? মা কালীর লক্ষ কোটি উপাসক। আর পাশের কালো মেয়েটিকে শক্তিহীন করে নুইয়ে দেওয়া থেকে রেহাই দিতে কেউ নেই।

‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’ গান শুনে বাহবা দিলেও শব্দে ও বাক্যে তেমন আস্থা রাখতে পারেননি কেউই। ফস করে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘‘কালো, কিন্তু দেখতে খারাপ নয়।’’ অনেকে আবার বলেন, ‘‘কালোতে নেই আপত্তি।’’ মানে তিনি যেন বিরাট উদারতার পরিচয় দিতে পেরে ব্যতিক্রমী। গাত্রবর্ণ নিয়ে কৃষ্ণকলিদের কপালে লেখা অন্তহীন লাঞ্ছনা। তবুও তাঁদের হরিণ চোখের আবেদন নিয়ে টানা-হেঁচড়া চলে যুগে যুগে। কাব্য ও সঙ্গীতে কৃষ্ণা ও শ্যামলীদের সামান্য ছাড় দিলেও বাস্তবে বেশিরভাগ মানুষের মনে শুধু গৌরীদেরই জয়। কালো মানেই যেন আপত্তিকর। দেখে গা গুলিয়ে যায় অনেকের। অসহ্য লাগার কারণে দৃষ্টিও সরিয়ে ফেলেন কেউ কেউ। কালো মেয়ে স্ত্রী হয়, মা হয়। কিন্তু ‘কালো’ বিশেষণ কিছুতেই সরে না।

সভ্য সমাজের শিক্ষিতরাও বলেন, ‘‘ওই যে, কালো মেয়েটার বিয়ে হল!’’ কখনও উড়ে আসে, ‘‘ওই যে, কালো করে মেয়েটা। চিনতে পারছিস না? একদম কালো কুচকুচে! এক্কেবারে আলকাতরা!’’ কেউ বলেন, ‘‘মানুষ কী করে এত কালো হয়? ঠিক যেন দাঁড়কাক! বাপরে কালো!’’ বাড়িতে সকলেই উপদেশ দেন, ‘‘তুই কালো তো কী হল? পড়াশোনা করে দেখিয়ে দে! কালো জগতের আলো।’’ আবার কখনও বলেন ‘‘অনেক কালো মেয়েদের ভাল বিয়ে হয়, জানিস?’’ কিন্তু ওই অপমানটা? সেটা কি হজম করে নিতে শিখতে হবে? তখন শুনতে হয়, ‘‘লোকের মুখে কি আর হাত দেওয়া যায়? কালোকে কালো বললে রাগ কেন?’’ এক ধাপ এগিয়ে কেউ বলে ফেলেন, ‘‘গুগ্্ল সার্চ করে দেখ! কত কালো মেয়ে সেরা মডেল। তারা দুনিয়া কাঁপাচ্ছে।’’ কিন্তু কালো বলে অস্তিত্বের অপমান হবে কেন? মনোবল হারিয়ে কুঁকড়ে জীবন যাপন কেন? অপ্রিয় প্রশ্নের সামনে সব কণ্ঠই রুদ্ধ।

কালো মেয়ের জন্য রং বেঁধে দেওয়া হয়। অফ হোয়াইট, হালকা গোলাপি, হালকা বেগুনি। লিপস্টিক দিলে নাকি ‘মা কালী’-র মতো লাগে। আর কালো জামা পরলে ভূতের মতো। কালোদের কুঁকড়ে থাকতে দেখলেই খুশি সবাই। রুখে দাঁড়ালেই শুনতে হয়, ‘তেজ কত! কালো না হলে যে কী করত!’ কালোদের দুখি দেখতে চায় সমাজ। খুব বেশি প্রাণবন্ত হলে নজর কাড়ে সকলের! অনেকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করে বলেন, ‘‘কই, তুমি তো তেমন কালো নও! আমি তো জীবনে তোমার চেয়ে অনেক কালো মেয়ে দেখেছি।’’ স্মরণে আনার জন্য পাশের কাউকে সাক্ষী মেনে বলেন, ‘‘ওই যে মনে আছে, সেই কালো মেয়েটা! অবিকল কেসি পালের কালো ছাতার মতো রং।’’

কালো মেয়ের অভিযোগ, পুজোর সময় প্যান্ডেল থেকে তাঁদের দেখলে আওয়াজ তোলে ইভটিজ়ারেরা। এমনকি খোদ বিষ্ণুপুর কালীবাড়িতেই পুজো দিতে মন্দিরে ঢোকার পথেই কালো মেয়েদের শুনতে হয়েছে, ‘‘যতই পাউডার ঘষো, কাক কোনও দিন ময়ূর হবে না!’’ কখনও শুনতে হয়, ‘‘আজ বুঝি সাউথ আফ্রিকার ম্যাচ আছে।’’ দশম শ্রেণির মিলি খাতুন হেসে বলে, “আমি জানি, ওরা আমাকে বলছে! কিন্তু কিছু মনে করি না! আগে খুব কষ্ট পেতাম, কাঁদতাম। এখন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে!’’ তার পরে খুব নির্বিকার গলায় সে বলে, ‘‘আমার মা বলে, আমাকে বিয়েই করবে না কেউ। আগের জন্মের কোনও পাপেই নাকি আমার এমন অবস্থা। আমার জন্য নাকি মা-ও মুখ দেখাতে পারে না! আমার মতোই আমার এক দিদি আছে। ভাল নাচে। কিন্তু স্যর–ম্যাডামেরা ওকে কোনও অনুষ্ঠানে নেয় না। নিলেও সামনের সারিতে দাঁড়াতে বারণ করে। আমি জানি, কালো বলেই ওকে এ ভাবে ভুগতে হয়।’’

জঙ্গিপুর এলাকার চরকা গ্রামে তিন বোনের মধ্যে যিনি বড় তাঁর বয়স ৩৫। বিয়ে হচ্ছে না। কালো বলে বেশি টাকার চাপ আসছে। পরিবার সেই টাকা দিতে পারছে না। পরিবারের ভাষায়, মেয়ে একদম ‘খাম’। আবার পয়সার জোরও নেই! অন্য একটি পরিবারে বহু চেষ্টার পরে কালো মেয়ের বিয়ে হল। কিন্তু কালো হওয়ার ‘অপরাধেই’ সন্তান কোলে তাঁকে ফিরতে হল সেই বাপের বাড়িতেই।

কান্দির মানসী পরিবারের বড় বৌ। কিন্তু কালো। ছোটো বৌ ফর্সা। মানসীর দাবি, ‘‘কালো বলেই আমার পছন্দ ও আবেগের কোনও মুল্য দেওয়া হয় না। এমনকি স্বামীও বলে, ‘তুমি কালো। তাই তোমায় কেউ ভালবাসে না। এটা মেনে নাও না কেন?’ দেখি আমার মেয়েটা কেমন হয়? সবাই সেই দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়ে যদি কালো হয় তা হলে আমি হেরে যাব শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছে।’’

ডোমকলের এক কৃষক পরিবারের মেয়ে। গায়ের রং কালো। পাত্র পক্ষ দেখতে এলেই অনেক পণ চায়। বোনের বিয়ে না দিতে পেরে অসহায় দাদা একটি ঘোষণা করলেন। যে পরিবারেরর ছেলে তাঁর বোনকে বিয়ে করতে রাজি হবেন সেই পরিবারের মেয়েকে বিনা পণে তিনি বিয়ে করবেন। এতেই কাজ হল। পাত্রী বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে সে যাত্রায় সমস্যার সমাধান হল। বর্তমানে প্রধান শিক্ষক সেই বিনিময়ের বৌ নিয়ে আর পারছেন না। লেখাপড়ার বিরাট ফারাকের কারণে সমস্যা হচ্ছে প্রবল। চশমা খুলে মাথা নিচু করে বলেন, ‘‘কাকে বলি বলুন তো! নিজের কালো বোনের জন্যই এই স্যাক্রিফাইস করলাম। বোনও সুখী হতে পারল না, আমিও না। শুধু বিয়েটাই হয়ে গেল।’’

এমনকি ১০ লক্ষ পর্যন্ত পণ দিতে চান সচ্ছল পরিবারের কালো মেয়ের বাবা। তার পরেও সেই মেয়েকে আজীবন খোঁটা সহ্য করে যেতে হয়। শ্বশুরবাড়ি ক্ষতিপূরণ পেয়েও ভাবে, লাভ হল না। আর একটু দর হাঁকা যেতেই পারত।

শহুরে, শিক্ষিত মহলে সেই একই গুঞ্জন। ছেলে শিক্ষিত। এমএসসি, ফার্স্ট ক্লাস। পাত্রী দেখার পরে প্রায় সব ঠিকঠাক। তার পরেও বিয়ে ভেঙে গেল। কারণ পাত্রীর রং কালো। তার পরে ফোনে সেই পাত্রীকে পাত্র পক্ষের তরফে জানিয়ে দেওয়া হল, ‘‘আপনি কালো এবং আমাদের ছেলেও কালো। সন্তানও কালো হবে। তাই বিয়ে বাতিল করা হল।’’

লালগোলার এক স্বাস্থ্যকর্মীকে শ্বশুরবাড়িতে পা রাখতেই দেওয়া হয়নি। বিয়ে রেজেস্ট্রি করে বাসে তুলে দেওয়া হয়। কেউ যেন জানতে না পারে, বাড়ির বৌ এত কালো। নিজের বাড়িতে বসে সেই স্বাস্থ্যকর্মী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘‘শুধু রঙের কারণে স্বামী কোনও দিন ট্রেনে, বাসে পাশে বসতে দেয়নি। ২৬ বছরের অবহেলিত দাম্পত্য জীবনের ঘাতক এই কালো রং।’’

(চলবে)

শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

Blackish Literature Girls Dark Compexion

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।