কাপড় বোনার আগে মেলা হয়েছে সুতোর লাছি। ছবি: কল্যাণ আচার্য
দেশ ছেড়ে চলে আসা ছিন্নমূল মানুষেরা এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন বীরভূমের সাঁইথিয়ার পূর্ব প্রান্তের ফাঁকা জায়গায় ময়ূরাক্ষী নদীর আশপাশে। কিছু মানুষ এসেছিলেন দেশভাগের পরে। তারও পরে আরও অনেকে এসেছিলেন বাংলাদেশ নামে দেশের জন্মের প্রাক্কালে। তবে প্রথম বারের তুলনায় দ্বিতীয়বার বেশি পরিবার চলে এসেছিল নিজেদের দেশ ছেড়ে। খেয়েপরে বেঁচে থাকতে রুটিরুজির প্রয়োজনে এই সব মানুষ আঁকড়ে ধরেছিলেন তাঁতশিল্পকে। প্রায় এক হাজার পরিবার এখন সাঁইথিয়া সংলগ্ন এই মুড়াডিহি কলোনিতে। ছিন্নমূল মানুষের এই বসতি এলাকা এখন মুড়াডিহি কলোনি নামে পরিচিত হয়েছে। সাঁইথিয়া পুরসভার অধীন এই এলাকাকে তাঁতিপাড়া নামেই সবাই চেনে। অধিকাংশ ঘরেই হস্তচালিত তাঁতে তৈরি হচ্ছে তাঁতের শাড়ি, হ্যান্ডলুম শাড়ি। প্রতিটি পরিবারের সব সদস্যই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁতের কাজে লেগে থাকেন। এমনকি পরিবারের মহিলারাও এই কাজে দক্ষ।
এখন মুড়াডিহি কলোনিতে অনেকেরই চোখে পড়ার মতো ঘরবাড়ি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাঁত বুনে রোজগার করে আজ তাঁদের অনেকেই স্বয়ম্ভর। আবার অনেক পরিবারেই ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত হয়েছে। শুধু ছেলেরা নয়, মেয়েরাও শিক্ষার আলোয় আলোকিত। পড়ার সময় ছাড়া বাকি সময়টুকু তারা মা, বাবা, দাদার সঙ্গে তাঁতের কাজে জোগান দেয়। এখানকার সব পরিবারেই কেউ তাঁত চালিয়ে কাপড় তৈরি করেন, কেউ তাঁতের শাড়ি ফেরি করার জন্য চলে যান জেলার বিভিন্ন এলাকায়। শান্তিনিকেতন, রামপুরহাট, সিউড়ি আমোদপুরে ঘরে ঘরে গিয়ে শাড়ি বিক্রি করেন। এ ছাড়াও এখানে তৈরি হওয়া শাড়ি চলে যায় কলকাতার বড়বাজারে কিংবা বিহারের ভাগলপুরে। সে-সব জায়গাতেও মুড়াডিহি কলোনির তাঁতের শাড়ির চাহিদা আছে।
তবে কলকাতার বড়বাজারই এখানকার শাড়ির বড় বাজার।
এখানে তাঁতিরা ছাড়াও আছেন মহাজন। বেশ কয়েক জন মহাজন এখানকার তাঁত ব্যবসায়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অনিল বসাক, বৃন্দাবন বসাক, খগেন বসাক, রবীন্দ্র বসাক, মহাদেব বসাক, বিকাশ বসাক প্রমুখ। এলাকায় মহাজন হিসাবে পরিচিত হলেও তাঁরা সাধারণ তাঁতিদের সুখদুঃখের সঙ্গী। তাঁতের শাড়ি তৈরি করতে যে-সব উপাদান লাগে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: সুতো, গুটিসুতো, রেশম, তসর, জরি ইত্যাদি। মহাজনেরাই তাঁতিদের এগুলি সরবরাহ করেন। তাঁতিরা শাড়ি বুনে মহাজনদের গদিতে দিয়ে যান। বিনিময়ে মজুরি পান শাড়ি বোনার জন্য তাঁতিরা। মহাজনদের অধীনে থেকেই তাঁতিরা তাঁত বোনেন। এমনকি হস্তচালিত তাঁতযন্ত্রও মহাজনেরা তাঁতিদের সরবরাহ করেন।
সন্ধ্যার দিকে মহাজনদের গদিতে তাঁতিদের ভিড় জমে। নানা রকমের শাড়ি বুনে তাঁতিরা তাঁদের কাছে দিয়ে যান। মহাজনদের মাধ্যমে সেই সব শাড়ি চলে যায় নদিয়ার শান্তিপুর, পূর্ব বর্ধমানের সমুদ্রগড়, কলকাতার বড়বাজারে। বহির্বঙ্গেও এখানকার তাঁতিদের বোনা শাড়ির চাহিদা আছে। বংশপরম্পরায় বেশ কিছু শিক্ষিত যুবক এই কলোনিতে তাঁত ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে। মহাজনদের গদিতে এসেও প্রতিদিন বহু মানুষ এবং তাঁতের শাড়ির ব্যবসায়ীরা শাড়ি কিনে নিয়ে যান। সব মিলিয়ে সারা বছরই মুড়াডিহি কলোনিতে তাঁতের শাড়ির বাজার আছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে মহাজনদের গদি। ক্রেতাদের মধ্যে আছেন শান্তিনিকেতনের শিল্পী থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, সাধারণ গৃহবধূর পাশাপাশি বেশ কিছু জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী, চিত্রাভিনেত্রী। বেশ কয়েক বছর আগে এখানে তাঁতের শাড়ির এক প্রদর্শনীতে এসে সংগীতশিল্পী কণিকা মজুমদার, বাংলাদেশের শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা প্রমুখ মুড়াডিহির কলোনির তাঁতের শাড়ির প্রভূত প্রশংসা করে গিয়েছেন।
এখন প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতি হলেও মুড়াডিহি কলোনিতে হস্তচালিত তাঁতের দ্বারাই তৈরি হচ্ছে নানা রকম শাড়ি। শাড়ির নকশার অবশ্য উন্নতি হয়েছে আগের চেয়ে অনেকটাই। মহাজনেরাই মূলত কম্পিউটারের মাধ্যমে ডিজাইন সংগ্রহ করে তাঁতিদের দিচ্ছেন। সেই ডিজাইন অনুসারেও এখানে তৈরি হচ্ছে সুতোর বালুচরী, রেশম ঢাকাই, জামদানি, তসর, গরদ, নরম সুতোর শাড়ি। জ্যাকেট মেশিন-সহ প্রায় দেড় হাজার হস্তচালিত তাঁত আছে এই কলোনিতে। স্থানীয় তরুণ মহাজন বিকাশ বসাক বললেন, ‘‘এখানকার তাঁতিরা গুণী শিল্পী। যে কোনও রকম নকশা দিলেই তাঁরা শাড়ি বুনে দিতে পারেন। তবে তরুণ প্রজন্ম আরও বেশি করে এগিয়ে না এলে আগামী দিনে তাঁতশিল্পে সঙ্কট দেখা দিতে পারে।’’
বেশ কয়েক জন তাঁতি জানালেন, শাড়ি তৈরির উপাদান অর্থাৎ সুতো, রেশম, জরি ইত্যাদির দাম বাড়ছে। তাই শাড়িরও দাম বাড়ছে। তবে মুড়াডিহি কলোনির শাড়ির গুণমান নিয়ে কোনও কথা হবে না। সমুদ্রগড়, শান্তিপুর থেকে উপাদান আনতে হয়। মুড়াডিহি কলোনি থেকে শান্তিপুর, সমুদ্রগড়ের দূরত্ব যেমন অনেক, তেমনই যোগাযোগ ব্যবস্থাও সহজ নয়। ওই সব উপাদান আনতে খরচ হয়ে যায় অনেকটাই। তাই উপাদানের উচ্চমূল্য এখানকার তাঁতিদের ভাবাচ্ছে।
ছোট্ট একটি ঘরে বসে হস্তচালিত তাঁতে শাড়ি বুনতে বুনতে যুবক অরিজিৎ বসাক বললেন, ‘‘আমাদের কোনও জীবন নেই। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত এই তাঁতে বসে শাড়ি বুনি। তবে নতুন প্রযুক্তির যন্ত্রচালিত তাঁতের (পাওয়ারলুম) শাড়ি চিরাচরিত তাঁতেক শাড়ির বাজার নষ্ট করে দিতে পারে। ওই আধুনিক তাঁতে কম সময়ে বেশি শাড়ি তৈরি হয়।’’ অবশ্য মুড়াডিহি কলোনিতে সেই আধুনিক মেশিন এখনও থাবা বসাতে পারেনি। এই কলোনিতেই সরকারী উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে তাঁতের হাট। বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠী সেই হাটে শাড়ি নিয়ে বসলেও সেখানে ক্রেতা তেমন নেই। সরকারী উদ্যোগে তাঁতঘর বানানোর জন্য অর্থ অনুদান যেমন দেওয়ার পাশাপাশি তাঁত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়।
এখন শিক্ষিতের সংখ্যা বেড়েছে কলোনিতে। এই কলোনি থেকেই ঢিল ছোড়া দূরত্বে সাঁইথিয়া শহরের কলেজটির অবস্থান। কলোনির প্রায় সব ঘরেই শিক্ষিত যুবক-যুবতী। অনেকেই স্কুল, কলেজ, সরকারি দফতরে কর্মরত। অনেকেরই তাঁত বোনার কাজে আগ্রহ নেই। ফলে বোনার লোক কমে যাচ্ছে। শাড়ি বোনার কাজে যেমন সময় দিতে হয়, তেমনই অসীম ধৈর্য দরকার। তবু মুড়াডিহি কলোনির তাঁতিরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার।
লেখক সাহিত্যকর্মী, মতামত ব্যক্তিগত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy