এ বছর প্রায় ছ’শো মুসলমান ছেলেমেয়ে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হবে। জেলার আরও কয়েকশো ছেলে গাঁটের টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়েছে, ডাক্তারি পড়তে। উচ্চ শিক্ষার অন্যান্য শাখাতেও আনুপাতিক উপস্থিতি তাদের। পাশ করছে, কিছু চাকরিও পাচ্ছে। ওই সব গ্রামের কত মানুষ ভিন্রাজ্যে খেটে রোজগারের টাকা নিয়ে গ্রামে ফিরে জমি কিনছে, তিনতলা বাড়ির ভিত দিচ্ছে পোক্ত করে। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম সমাজের হয়তো খণ্ড-ছবি এটা। কিন্তু এ ছবি দৈর্ঘ্যে প্রস্থে গভীরতায় বাড়ছে, এটুকু বলা যায়। ব্যক্তি ও সমাজের নিশ্চিন্ততা আর নিরুপদ্রব নিরাপত্তাই পারে সংখ্যালঘুর অগ্রগমনের পথ মসৃণ করতে। গত কয়েক বছরে কিছু সাম্প্রদায়িক অশান্তি বাদ দিলে এ রাজ্যে সংখ্যালঘুরা মোটামুটি নিরাপদই থেকেছে।
কিন্তু সেই নিরাপত্তা আর ততটা নিশ্চিত থাকছে না। সম্প্রতি ক্যানিং লোকালে এক মাদ্রাসা শিক্ষক ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে অস্বীকার করায় তাকে মারধর করে ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলে দেয় ‘হিন্দু সংহতি’র কয়েক জন সদস্য। সহযাত্রীকে চিহ্নিত করে সাম্প্রদায়িক ঘৃণ্য-কথা শোনানো লোকাল ট্রেনে অনেক দিনই শুরু হয়েছে, কিন্তু এমন ঘটনা রাজ্যে এই প্রথম। পশ্চিমবঙ্গে এখন থেকে এই ধরনের কাণ্ড আরও ঘটতে থাকবে, এই সংশয় পিছু ছাড়ছে না।
আসলে সংখ্যালঘু মানুষকে এই ভাবে ত্রাসের মধ্যে ঠেলে দিলে তার যাবতীয় দাবি-দাওয়া হয়তো এর পর বেঁচেবর্তে থাকার ন্যূনতম দাবিগুলোর মধ্যেই আটকে যাবে। শঙ্কাটা আরও বাড়ছে, কেননা সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মুখে অনেক বার এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজ়েনশিপ)-র বার্তা শোনা গিয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের আগে যত বার বিজেপির নেতারা দিল্লি থেকে এ রাজ্যে এসেছেন, এনআরসি-র হুমকি দিতে ভোলেননি। এমন ভাবে তাঁরা কথা বলেছেন যেন এ রাজ্যে সব মুসলমানই বহিরাগত। উত্তরে চা-বাগান থেকে দক্ষিণে জঙ্গলমহল পর্যন্ত বর্ণহিন্দু, দলিত, আদিবাসী সবাই উজাড় করে যে ভাবে সমর্থন করেছে বিজেপিকে, তাতে সন্দেহ জাগে, অনেক দিনের সুপ্ত মুসলিমবিরোধিতাই কি এ বার ব্যালটে প্রতিফলিত হল? তবে, হিন্দুত্ববাদীদের এই উত্থানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়ও কম নয়!
ঘটনা হল, অসমের এনআরসি-র ক্যাম্পগুলিতে যে ভাবে বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলমানকে কোণঠাসা করে, বিদেশি ঘোষণা করে একের পর এক ডিটেনশন ক্যাম্পে ভরা হয়েছে, তাতে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ অাছে। ওই সব ক্যাম্পে দিনে মাথাপিছু খাইখরচা ৪৫ টাকা। আহার ও চিকিৎসার অভাবে ক্যাম্পে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৫০ জনের। নাগরিক পঞ্জির প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরে ২০১৮ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে ৩২ জন আত্মহত্যা করেছেন (তথ্য: বরাক মানবাধিকার রক্ষা কমিটি)।
এনআরসি সংক্রান্ত এই সব খবর বাংলার গ্রামগুলোকেও ঘিরে ফেলছে। বিজেপি, আরএসএস সমেত দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো এটাই চেয়েছে। আতঙ্কের মধ্যে রেখে আরও কোণঠাসা করে দাও মুসলমানদের। কোচবিহার থেকে নদিয়া— গ্রামে গ্রামে সামাজিক মেলামেশায়, চায়ের দোকানে কিংবা আড্ডায়-আলোচনায় ঘুরে ফিরে চলে আসছে এনআরসি প্রসঙ্গ। শুক্রবারে জুম্মার নামাজের পরে মসজিদের চাতালে বসে যেমন গল্পগাছা হয়, হয় প্রতিবেশীর ভাল-মন্দ নিয়ে দুটো কথা— সেই সব আলাপচারী এখন দখল করেছে এনআরসি-র শঙ্কা। কেউ হয়তো প্রত্যয়ী যে, তাঁর হাতে জমি-বাড়ির পুরনো দলিল মজুত। কিন্তু, তার পরেও তিনি জানেন না, ওইটুকুতেই মিটবে কি না। চোদ্দো পুরুষ ধরে যে দেশে বসত, দেশভাগের পরেও যিনি ভিটে আঁকড়ে থেকেছেন, সেখানেই কী ভাবে হবেন অনাগরিক— এই প্রশ্নেও দীর্ণ হচ্ছেন কেউ।
প্রশ্ন অনেক। অসমের মতো ১৯৭১ সালের আগের জমির দলিল দেখালেই হবে কি? না কি আবেদনকারীর জমির দলিল, পাসপোর্ট, জীবনবিমা, ব্যাঙ্ক বা পোস্ট-অফিস অ্যাকাউন্ট, জন্মের নথি, শিক্ষাগত নথি, আদালতের কাগজপত্র, সরকারি চাকরির প্রমাণপত্র বা যে কোনও সরকারি লাইসেন্স দেখিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা বা তাঁদের পূর্বপুরুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার আগে থেকেই, অর্থাৎ ২৪ মার্চ ১৯৭১ সালের আগে থেকে ভারতে বসবাস করছেন? অসমে এই সব নথির যে কোনও একটা জমা দেওয়ার পরেও আবার বাপ-ঠাকুর্দার নাগরিকত্ব প্রমাণ চাওয়া হয়। তৈরি করতে হয় বংশবৃক্ষ। এনআরসি কর্তারা কোন নথি চাইবেন, কেন চাইবেন, মানুষ প্রায়শই বুঝে উঠতে পারেন না।
অসমে প্রথম খসড়ায় নাম তোলার জন্য নথি হিসেবে ১৯৫১ সালের এনআরসি, ১৯৬৬ ও ১৯৭১ সালের ভোটার তালিকা, নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র, শরণার্থী প্রমাণপত্র ও রেশন কার্ড অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে ওই পাঁচটি নথি সুপ্রিম কোর্ট বাদ দেয়। ওই সব নথি দিয়ে যাঁরা নাগরিকত্বের দাবি জানিয়েছিলেন, তাঁরা আতান্তরে পড়েন। তবে নেতারাও নিশ্চিত করে জানেন না যে, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের নথি জমা দিলেই হবে, না কি ১৯৫১ সালের নথি হাতড়াতে হবে! মুসলমানদের মধ্যে (অবশ্যই হিন্দুদের মধ্যেও) একটা বিশাল অংশ আছেন, যাঁরা বংশপরম্পরায় যে ভিটেতে বাস করছেন, প্রয়োজনে তার দলিল দেখাতে পারবেন না— পাসপোর্ট, জীবনবিমা, জন্মের নথি, শিক্ষাগত নথি, আদালতের কাগজপত্রের তো প্রশ্নই নেই।
এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রচার: বাংলাদেশ থেকে প্রতি দিন শয়ে শয়ে মুসলিম অনুপ্রবেশকারী রাজ্যে ঢুকছে, স্থায়ী বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় নথি বানিয়ে নিচ্ছে। এ রাজ্যে এনআরসি শেষ পর্যন্ত হোক বা না হোক, আতঙ্ক যদি ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাতে বিজেপিরই লাভ।
তবে একটা কথা। বিজেপিরও অজানা নয় যে, এ রাজ্যে বাংলাদেশ থেকে আসা, নাগরিকত্বের প্রমাণহীন, হিন্দুর সংখ্যা বিপুল। তারাই তো বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy