পরুলিয়ার জন্মদিনে শহরে শোভাযাত্রা লোকসেবক সঙ্ঘের কর্মীদের। ছবি: সুজিত মাহাতো
এ সবের ফলে মানভূমের কংগ্রেসের নেতৃত্বের মধ্যে ভাঙন শুরু হয়, যা পূর্ণতা পায় লোকসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠায়। ১৯৪৮ সালের ৩০ এপ্রিল বান্দোয়ান থানার জিতান গ্রামে জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে অধিবেশন শুরু হয়। সেখানে উত্থাপিত আটটি প্রস্তাবের মধ্যে অন্যতম ছিল ভাষা সমস্যা। মাতৃভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ পুনর্গঠনের প্রশ্নে কমিটি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।
এর পরে বাংলাভাষী ও হিন্দিভাষীদের মধ্যে বিরোধ চরমে ওঠে এবং ১৯৪৮-এরই ৩০ ও ৩১মে পুরুলিয়ার শিল্পাশ্রমে প্রদেশ কংগ্রেস ভেঙে যায়। সভাপতি অতুলচন্দ্র ঘোষ, সম্পাদক বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত-সহ ৩৪ জন ইস্তফা দেন। যদিও ওই অধিবেশনে পদত্যাগপত্রগুলি গৃহীত হয়নি। এর পরে অতুলবাবুরা পুরোপুরি ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মাতৃভাষা রক্ষাই যে তাঁদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য, তা ব্যাখ্যা করে ‘মুক্তি’ পত্রিকায় (৭ জুন, ১৯৪৮) অতুলবাবুর একটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়।
তবে সব বাংলাভাষীই যে এঁদের পক্ষে ছিলেন, এমনটা নয়। সূক্ষ্ম ভাবে গোষ্ঠী বা জাতিভিত্তিক বিভাজনের রাজনীতিও শুরু হয়। কুড়মি সমাজকেও কৌশলে বিভক্ত করতে সক্ষম হন হিন্দিভাষী বিহার প্রদেশের নেতারা। ফলে স্কুল থেকে শুরু করে সর্বত্র হিন্দি ভাষা ব্যবহার করার জন্য বহু বাংলাভাষী নেতারাও বিভিন্ন থানায় থানায় দায়িত্ব নিতে শুরু করেন। কিন্তু এ ভাবে ছোটখাটো কাজেও হিন্দি ভাষা ব্যবহারে বাধ্য করার ফলে এঁরা সাধারণ মানুষের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। ফলে মাতৃভাষা বাংলার পক্ষে একটা বিপুল জনসমর্থন অতুলবাবুদের দিকে চলে আসে। অন্য দিকে, সরকারি দমনপীড়নও আরও তীব্র হতে থাকে।
এই পরিস্থিতিতে ১৯৪৮ সালের ১৩ জুন ‘লোকসেবক সঙ্ঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন অতুলচন্দ্র ঘোষ, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, সত্যকিঙ্কর মাহাতো, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, ভজহরি মাহাতো, জগবন্ধু ঘোষ,ভীমচন্দ্র মাহাতো, অরুণচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ নেতারা জোরদার আন্দোলন শুরু করেন। ৫০ জনের একটি জনসংযোগ দল তৈরি হয়। এঁরা সকলেই গাঁধীর আদর্শ মেনে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যদিও তাঁদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বরকে বিহার প্রদেশ কংগ্রেস বা সরকার, কেউই সে সময়ে গুরুত্ব দেননি।
এ বার শুরু হল ভাষা সত্যাগ্রহ। ‘ভাষাগুলির পূর্ণ উৎকর্ষ লাভ করতে হলে ভাষা অনুসারে প্রদেশগুলির পূর্ণ ব্যবস্থা করা প্রয়োজন’— গাঁধীর এই কথাগুলিকে মানভূমের ভাষা আন্দোলনকারীরা অন্তর থেকে গ্রহণ করেছিলেন এবং সেই পথেই আন্দোলন পরিচালিত করেন। সত্যাগ্রহীদের উপরে প্রশাসনের অত্যাচার শুরু হয়। লোকসেবক সঙ্ঘের ভাষা সত্যাগ্রহের যুক্তিকে স্বীকার করে কিশোরলাল মশরুওয়ালা ‘হরিজন’ পত্রিকায় বিহার সরকারের তীব্র সমালোচনা করে ‘কুৎসিত পদ্ধতি’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এতে আন্দোলনকারীরা আরও উৎসাহ পান। কারখানার মালিকদের সরকার পক্ষ হুমকি দেন যে, সমস্ত কর্মীদের বিহারী বলে চিহ্নিত করে হিন্দিতে সই বাধ্যতামূলক করতে হবে। ভজহরি দাসের নেতৃত্বে এর বিরুদ্ধে ভাষা সত্যাগ্রহ বিপুল আকার নেয়। সংস্কৃতির ধারা ও লোকায়ত মানুষের ভাবনা এই সত্যাগ্রহে মিশে যায়। বহু মানুষ টুসু গান গেয়ে পথে নামেন ভাষা সত্যাগ্রহের পক্ষে। নামই হয়ে যায় ‘টুসু সত্যাগ্রহ’।
সত্যাগ্রহের স্থান নির্বাচন করে প্রতিটি থানার একাধিক জায়গায় ১৯৪৯-এর এপ্রিল প্রথম পর্যায় ভাষা সত্যাগ্রহ চলে। স্বভাবতই বিহার সরকার তা মেনে নেয়নি। গ্রেফতার না করে বিশাল জন সত্যাগ্রহে বর্বর পুলিশি আক্রমণ চালানো হয়। লোকসেবক সঙ্ঘের পরিচালনায় প্রথম পর্বে ৩৬টি জায়গায় সত্যাগ্রহের পরে ১৯৫১ সালের মার্চে দ্বিতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে বিপুল সংখ্যক মানুষের যোগদানে সত্যাগ্রহের শক্তি আরও বাড়ে। ভজহরি মাহাতো, মধুসূদন মাহাতো, বৈদ্যনাথ মাহাতোদের লেখা ‘টুসু গানে মানভূম’ অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়। লোকের মুখে মুখে ফিরতে থাকে, ‘সবাই মোরা চাইরে মন/ বাংলা ভাষায় কাজ চলে।/ কত সুখে দিন কাটাবো/ মাতৃভাষায় গান বলে।/ সুখের আইন গড়ে দিবো/ বাংলাভাষায় রাজ পেলে।/ ভজহরির মনের আশা/ পুরে যাবে সেই কালে।’
বিশেষ ভাবে ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত মানভূম ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে টুসু সত্যাগ্রহ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। ভয়ঙ্কর দমন-পীড়ন, ভয় দেখানো, জেলে ঢোকানো সত্ত্বেও আন্দোলনকারীদের মনোবল কমেনি। এ ভাবেই নিয়ত সংগ্রাম ও সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় পুরুলিয়া জেলা। যুক্ত হয় মাতৃভাষা বাংলার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। এখানেও ঘটে সীমানা বিভেদ। মানভূমও বঙ্গভঙ্গের মতো ভাগ হয়ে যায়। পুরুলিয়া জেলা পশ্চিমবঙ্গে আসে অল্প আয়তন (৬২৫৯ বর্গকিলোমিটার) নিয়ে। বাকি বিপুল অংশটাই থেকে যায় বিহার, বর্তমান ঝাড়খণ্ডে।
এ ইতিহাস আমাদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কথা মনে করায়। ভাষা, কেবল মাতৃভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের। এ ইতিহাস বিশ্বের দরবারে বহু আলোচিত হলেও এমন অনেক ইতিহাস রয়েছে, যা অনালোচিত। তেমনই একটি এই মানভূমের ভাষা আন্দোলন। স্বল্প ভূভাগ নিয়ে হলেও ১৯৫৬-এর পয়লা নভেম্বর স্বাধীন হয় পুরুলিয়া জেলা। এও এক স্বাধীনতার গল্প। অন্য স্বাধীনতা। ভাষার স্বাধীনতা, আত্মিক স্বাধীনতা।
(শেষ)
লেখক কাশীপুর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy