Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

হোক বাঙালি, ইংরেজি বাক্যালাপ না হলে জমে!

বিজ্ঞাপনের দাপটে, বিজাতীয় ভাষার অনুকরণে আমাদের শ্বাসবায়ুর মতো সহজ যে মাতৃভাষা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে তারই কারণ খোঁজ করলেন আবু তাহের ইংরেজি শিখতে হবে বলে যে মাতৃভাষাকে জলাঞ্জলি দিতে হবে এমন কোনও মানে নেই। বরং মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা যার যত গভীর সে তত সহজে অন্যের ভাষা শিখতে পারবে। এটাই নিয়ম। এটাই বিজ্ঞান।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাঙা মূর্তি। ফাইল  চিত্র

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাঙা মূর্তি। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৯ ০৩:০১
Share: Save:

বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি, মাতৃভাষা, বর্ণ পরিচয় এইসব শব্দগুলো আজকে বড্ড গুলিয়ে যায়। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের নীচে নিভু নিভু প্রদীপের মত ধুঁকছে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি। অভিভাবকদের নির্লিপ্ততা দেখে অবাক হতে হয়। সঙ্গে আরও আশ্চর্যজনক ভাবে বাংলা ভাষা নিয়ে কিছু অভিভাবকের অকারণ নিস্পৃহতা আমাদের দুঃখ দেয়।

আমরা বাঙালিরা যে গর্ব করে বলি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’, কতটুকু ভালবাসতে পারছি আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাকে? বাংলা ভাষা তার আপন মর্যাদায় বিশ্বের দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। বাংলার বীর সন্তানদের রক্তের বিনিময়ে এই ভাষার সুবাদে বিশ্বের দরবারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি হয়েছে।

আর, আজ আমরা বাঙালি হিসেবে লজ্জা বোধ করছি। শুধু নিজেদের কারণেই নয়, ভিন রাজ্যে থেকে আগত লুম্পেন বাহিনীর কারণে। কিছু দিন আগেই খোদ কলকাতার বুকে আমাদের বর্ণপরিচয়ের বিদ্যাসাগর আক্রান্ত হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা মানে শুধু একটা শ্বেত পাথরের আবয়ব ভাঙা নয়। এর শিকড় অনেক গভীরে ছড়িয়ে রয়েছে। এর অর্থ বাঙালিকে বিপন্ন করে তোলা। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান যাদের শ্লোগান তাদের কাছে বাঙালি জাতির আবেগের কোনও মূল্য নেই। কিন্তু একটি জাতির অস্তিত্ব ভাষার সাথে কী ভাবে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে তা আমরা বিপন্ন ও বিলীন কিছু ভাষা গোষ্ঠীর মানুষকে দেখে সহজেই অনুমান করতে পারি। আমরা বাংলা ভাষায় বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষ কথা বলি। অথচ আজকে বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের বিপন্নতার এত কাছাকাছি এসে পৌঁছল কেন, বুঝি না।

ইংরেজি শিখতে হবে বলে যে মাতৃভাষাকে জলাঞ্জলি দিতে হবে এমন কোনও মানে নেই। বরং মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা যার যত গভীর সে তত সহজে অন্যের ভাষা শিখতে পারবে। এটাই নিয়ম। এটাই বিজ্ঞান। একাধিক ভাষা শিক্ষার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। নেই কোনও বৈরিতা। বরং আমাদের বাংলা ভাষার যাঁরা মহান মনীষী ছিলেন তাঁদের প্রত্যেকের একাধিক ভাষায় গভীরতা ছিল। তাই তাঁরা নিজেদের মাতৃভাষার প্রতিও সমান ভালবাসা আর মমত্ববোধ অনুভব করতেন। বিশ্বায়নের প্রকোপে পড়ে আজ আমরা নিজেদের ভাষায় কথা বলতে গেলে নিজেদের অপারগতা ফুটে উঠবে তাই ভেবে বসি। দু’জন বাঙালির মধ্যে তাই হিন্দি বা ইংরেজিতে কথা চালাচালি দেখে মনে হয় বাংলা ভাষার কী দুর্দিন এল যে বাঙালি আজ নিজেদের মধ্যে বাংলা ভাষায় কথা বলতে লজ্জা পায়, বাঙালি হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে বাধাগ্রস্ত হয় নিজের মনের কাছে। এই হীনম্মন্যতা কাটানোর এক মাত্র অবলম্বন নিজের শিরদাঁড়া সোজা রেখে কাজের প্রতি আনুগত্য। অলস জীবন আর কাজে ফাঁকি দেওয়ার মধ্যে কোথাও কোথাও লুকিয়ে থাকে হীনম্মন্যতা। সেখান থেকেই বাঙালি বিশ্বায়নের জোয়ারে গা ভাসাচ্ছে না তো? রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথ মতো বাঙালির গর্ব হ‌ওয়া উচিত যে, তাঁরা বাংলা ভাষাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরে ছিলেন। সাহিত্য চর্চা থেকে রাজনীতি আর আধ্যাত্মিকতা সব দিক থেকেই বাংলা ভাষা জয় করেছিল বিশ্বের মানুষের মন। সেই জায়গা থেকে বাঙালি আজ সরে আসতে চাইছে। এর কারণ এক হতে পারে ক্রমাগত প্রচার মাধ্যমে বিজায়ীয় ভাষায় বিজ্ঞাপনের দাপট, প্রকারন্তরে যা বাংলা বলতেই বুঝি বাধা দিচ্ছে। আর এই না বলতে পারার মধ্যে একধরনের পুলক অনুভব করছি বুঝি আমরা।

দেখো আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না— এমন বলতে পারলে যেন তৃপ্তি। বিজ্ঞাপনে ইচ্ছাকৃত ভুল বানান ভুল উচ্চারণ ক্রমাগত আমাদের মাথা খেয়ে বসছে। কেননা আমাদের অবচেতনে এক ধরনের বদ্ধমূল ধারণা জন্মে যাচ্ছে যে, বাংলা বলতে না পারা লোকগুলো তো বেশ চকচকে! এদের বিলাসবহুল জীবন যাপন আছে, ঐশ্বর্য আছে, বৈভব টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি সব আছে।

বড় প্রয়োজন এর প্রতিবাদ করাটা। কোথাও কোথাও ব্যক্তিগত স্তরে আমাদের প্রতিবাদ হয়তো হচ্ছে, কিন্তু বৃহত্তর স্তরে এই আন্দোলনের একটা রূপ দেওয়ার মত আমাদের না আছে নেতৃত্ব না আছে সময় আর না আছে ইচ্ছে। এই অনিচ্ছায়ই বাঙালিকে গ্রাস করেছে। কিন্তু সেই চুলোর আগুন যে এক দিন এসে আমাদের ঘর বাড়ি সব পুড়িয়ে দেবে সেই ভাবনা ভাবতে শিখছি না বা পারছি না।

আর সেই কারণেই বর্তমানে বড় বড় বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং সাইনবোর্ড রেস্টুরেন্ট, স্টেশনের টিকিট কাউন্টারে, মেট্রো রেলের ভেতরে ভুলভাল বাংলা বাক্য এবং বানান লক্ষ করা যাচ্ছে। বিহারে গিয়ে তো কেউ আর বাংলা ভাষায় বিজ্ঞাপন দেবে না। তা হলে বিজ্ঞাপনগুলো যখন আমাদের বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রচার করা হচ্ছে তখন কেন এক যোগে প্রতিবাদ করছি না?

টিভিতে, মোবাইলে, কম্পিউটারে আসতে থাকে মাঝে মাঝেই এই ধরনের বিজ্ঞাপন। সেগুলো দেখে বাচ্চাদের মধ্যে ভুল বানানের প্রবণতা যেমন বাড়বে তেমনি একাধিক জায়গায় একাধিক বানান বা বাক্য গঠন দেখে তারা বিভ্রান্ত হবে। এই বিভ্রান্তি থেকে তৈরি হবে ভয়। ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও টান অনুভব না করে বাচ্চারা লেখ্য ও কথ্য ভাষায় এক ধরনের ভীতি অনুভব করবে। সেখান থেকে তৈরি হবে ভাষার সঙ্গে মানসিক দূরত্ব আর দ্বন্দ্ব। এই মানসিক দ্বন্দ্ব নিয়েই আজকের প্রজন্মের বাচ্চারা ভাষার প্রতি সেই আজন্ম লালিত মমত্ববোধ আর অনুভব করছে না। আর তার সঙ্গে আছে অভিভাবকদের মাতৃভাষার প্রতি করুণার দৃষ্টি। বাংলা ভাষাকে আজ অনেক ব্রাত্য ভাবতে শুরু করেছে। অফিস আদালতে চাকরি ক্ষেত্রে ইংরেজি শিক্ষিত এবং ঝরঝরে ইংরেজি বলতে পারা প্রার্থীদের বেশি সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়।

স্বভাবতই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তাপ্রবণ বাবা-মায়ের মধ্যে বাংলা ভাষা আর ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। মাঝখান থেকে পুঁজিবাদী সংগঠনের ঢালাও বিনিয়োগ চলছে চকচকে সব প্রতিষ্ঠান খোলার। প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে নিজেদের সন্তানদের সামিল করতে গিয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে মিশিয়ে দিচ্ছেন বাবা-মায়েরা। সন্তান কী চায় সেই প্রশ্ন আজ আর বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে না। গুরুত্ব পাচ্ছে বাবা-মা কী চান।

নিজেদের অপূরণীয় ইচ্ছে পূরণ করতে গিয়ে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে পড়াশুনার বোঝা আর টিউশনির পর টিউশনি। এক দিকে খেলাধুলার সময় কেটে পড়াশোনা আর অন্য দিকে আড্ডার মত সহজ স্বাভাবিক বাঙালিয়ানাকে ব্যাহত করে বাঙালি আজ অনেকাংশে নিজের জীবন বিপন্ন করছে। শুধু বাঙালি কেন, একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পৌঁছনোর এই দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে অধিকাংশ শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের এই করুণ দশা লক্ষ করা যাচ্ছে। যারা প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া বা নিম্নবিত্ত পরিবারে এই জিনিসগুলো এখনও ততটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তাই ভাষাটা আজ‌ও তাদের মধ্যে বেঁচে। মাতৃভাষার আসল রূপ সেখানে খুব সাবলীল ভাবে লক্ষ করা যায়। কথার মারপ্যাঁচে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে না তারা ভাষার সৌন্দর্যকে। ছড়িয়ে দিতে চায় ভাষার আদি ও অকৃত্রিম রূপ।

এ বার তাই ভাবার সময় হয়েছে। নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো সহজ প্রাণের ভাষাটিকে বাঁচাতে না পারলে বড় কঠিন দিন অপেক্ষা করছে।

(লেখক সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক, মতামত নিজস্ব)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy