Advertisement
E-Paper

ধুতি, শার্ট আর রসায়ন

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে শুয়ে সন্ধ্যার মেঘমালায় সুর খুঁজে পাওয়ার ব্যারামের জেরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া হল না ধুতি-শার্টের!

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৯ ০০:৪২
Share
Save

ঘর অন্ধকার করার চেষ্টা হয়েছে। বাইরে গনগনে দুপুর। সছিদ্র জানালা-দরজা বন্ধ করে ভিজে গামছা টাঙানো। রোদের আভা লাল গামছা ভেদ করে ঢুকছে ঈষৎ। তাতেই গাঢ় গোধূলি ঘরে। মাটিতে জলে মোছা মাদুরে শুয়ে বাঙালি শিশু। আসছে না ঘুম! কিন্তু আসতে বাধ্যও! কখন যেন ঘরের মধ্যে ঢুকে ঘাপটি মেরে বসে আছেন সাদা ধুতি-শার্টের একটা বাঙালি সুর। হাতপাখা দোলাতে থাকা মায়ের গলা দিয়ে তিনি বেরিয়ে আসছেন। বেরিয়ে আসছেন প্রশান্তির অবসাদ নিয়ে! ঘরে নামছে নিঝুম সন্ধ্যা! ক্লান্ত পাখিরা পথ ভুলে গিয়ে কী করবে শেষ পর্যন্ত, সে প্রশ্ন একটু-সামান্য জাগছেও মনে। যদিও কথা বোঝার কথা নয় সে বয়সে। কিন্তু পাখি তো খুবই চেনা লোক! বাতাবি গাছে থাকে। রোজ উঠোনে জিরোতে আসে। কেন জানা নেই, ওদের জন্য মন কেমন করছে! সুরটা ক্রমশ ঘুম বুনছে। ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। ঘুমোতে যাচ্ছে সুরটা।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে শুয়ে সন্ধ্যার মেঘমালায় সুর খুঁজে পাওয়ার ব্যারামের জেরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া হল না ধুতি-শার্টের! তবে, ইঞ্জিনিয়ারিং শেখেননি তিনি, বলা যায় না! সঙ্গীতের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, রসায়নে দীক্ষিত হলেন কার্যত আত্মশিক্ষায়। গাইতে শুরু করেই সুর তৈরির নেশায় পড়লেন। এখানেই ইঞ্জিনিয়ারিং।

এখানেই প্রশ্ন। সুর কি সৃষ্টি করা যায়? না কি, সব সুর হয়েই আছে? শুধু খুঁজে নিয়ে নতুন চেহারা দেওয়া! শিশু যেমন বিল্ডিং ব্লক্‌স খেলে! এ দিক থেকে দেখলে সুরসৃষ্টি ‘ইনভেনশন’ নয়, ‘ডিসকভারি’। নদী, ফুল, বিদ্রোহ, প্রার্থনা, প্রেম, যন্ত্রণা, শীৎকার, শেক্সপিয়র, রাত্রি, রবীন্দ্রনাথ— সব রয়েছে। সুর, স্বর, উপসুর, কম্পাঙ্ক— সবই। ‘পারমুটেশন-কম্বিনেশন’-এর রসায়ন জানা ইঞ্জিনিয়ার তা থেকেই ইতিহাস গড়েন! ধুতি-শার্ট তাই ইঞ্জিনিয়ার, রসায়নবিদ। এবং তাঁর রসায়নাগারের ভিয়েনে উপচে পড়ছে মেলডির রস।

‘নিঝুম সন্ধ্যায়’ শোনা শিশু বড় হয়ে ‘মেলডি’ শব্দটা শুনেছিল। কিন্তু প্রচলিত অর্থের সঙ্গে আভিধানিক ব্যাখ্যার মিল পায়নি। ‘নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিরা’ তাকে শুনিয়েছে ‘চলো মন গঙ্গাযমুনাতীর’! বলেছে ‘প্রভু আমার প্রিয় আমার’। কার দুর্গা, কোন পাহাড়ি, কোথাকার তিলক-কামোদ কিংবা কেদার— সে সব জানেন সঙ্গীতবেত্তারা! কিন্তু আভিধানিক আমগাছের খবর না রেখেও মেলডির আম খেতে অসুবিধা হয়নি। সে সুযোগ করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল, হিমাংশু দত্ত, অনুপম ঘটকেরা। এবং ধুতি-শার্ট।

কী ভাবে বাঙালি মনে রেখেছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে? হেমন্ত বিষয়ে নানা বয়ান বাঙালির। তিনি নাকি ‘কলসিতে গলা ঢুকিয়ে’ গাইতেন। ব্যঙ্গাত্মক এই বয়ানেরই ভিন্নভাষ ‘গলায় কাজ ছিল না’। আসলে, মন খুলে গ্রহণ করার বদলে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, উত্তম-সৌমিত্র, লতা-আশা, হেমন্ত-মান্না গোছের প্রতিতুলনাতেই স্বচ্ছন্দ কিছু মন। অর্বাচীনতার সেই প্রাবল্যেই সুমন বনাম নচিকেতা স্তরেও পৌঁছনো গিয়েছিল! হেমন্তকেও প্রতিতুলনায় পড়তে হয়েছিল। মজার বিষয়, যাঁদের সঙ্গে প্রতিতুলনা, তাঁদের বিচারে তিনি ব্যতিক্রমী বৈদূর্যকণ্ঠই! যে কণ্ঠে মোহিত উস্তাদ আমির খান, মেহেদি হাসানেরাও।

প্রথম পাবলিক ফাংশনে গাইতে পারেননি পঙ্কজ মল্লিক এসে যাওয়ায়। কিন্তু মনখারাপ উবে গিয়েছিল ‘পঙ্কজবাবু’কে শোনা যাবে বলে! তাঁর গায়ে ‘ছোট পঙ্কজ’ তকমা সাঁটা ছিল শুরুতে। বিষয়টিতে নকলনবিশির সাক্ষ্য পান অনেকেই। কিন্তু ‘পঙ্কজকণ্ঠী’ না বলে ‘ছোট পঙ্কজ’ বলা কেন? ভাবার বিষয়।

বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের চেষ্টায় গানের দরজা খুলেছিল। নবম শ্রেণিতে আকাশবাণী দিয়ে শুরু। অন্যদের সুরে কিছু গানের পর নিজের সুরে ‘কথা কোয়ো না কো, শুধু শোনো’। তারও পরে বন্ধু অমিয় বাগচীর কথা আর নিজের সুরে ‘আজ কোনও কথা নয়’। সুরের চলনে রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু মধ্যপথে ‘উধাও হয়ে যে চলে যাব দোঁহে’ অংশে কেমন যেন বদলে যায় সুরটা। ‘সিগনেচার’ তৈরির শুরু?

হেমন্ত-উত্তম বা হেমন্ত-দেব জুটির রসায়নে বা বাংলা-হিন্দি ছবিতে তাঁর অমোঘ কণ্ঠটি ছিল যেমন, তেমনই ছিল রোমান্টিকতার ব্ল্যাঙ্ক-চেক এবং ‘সিগনেচার’। অনেকের অনেক সুরকেই অনেকের এক রকম লাগে। কিন্তু তা যদি বহু দিন বেঁচে থাকে, তখন বিশ্বাস করতে বিশ্বাস হয়, বিষয়টার মধ্যে কিছু একটা আছে! এবং বোঝা যায়, ‘প্রোডাক্ট’ এক নয়, একই কারখানার। যেমন, রবীন্দ্রনাথ শুনলে বোঝা যায়, কারখানার নাম রবীন্দ্রনাথ। নজরুল-রজনীকান্তেও যেমন। বা সলিল-সুমনে। ‘সিগনেচার’ এটাই। এবং ‘সিগনেচার’ তৈরি করা সহজ নয়।

ধুতি-শার্ট মেলডির বৈজয়ন্তী উড়েছে দশকের পর দশক। বেসিক রেকর্ড থেকে রুপোলি পর্দা। পুরুষকণ্ঠে, নারীকণ্ঠে। এবং-এবং সঙ্গীতায়োজনে। ‘কতদিন পরে এলে’ গানে প্রথম পঙ্‌ক্তি উচ্চারণের পরেই যে কয়েক ফোঁটা বাদ্যবিন্দু ঝরে পড়ে, তা বিচ্ছিন্ন তো নয়ই, বরং মনে হয়, ওই ‘টুং-টুং টুং-টুং’টা বাদ দিলে গানটা সম্পূর্ণ নয়! কিংবা ‘নাগিন’ ছবিতে সাপুড়ে বিনটা! সে সুরে কে কে বাজিয়েছিলেন, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সুর-সঙ্গীতায়োজনের ভাবনাটা হেমন্তেরই। তার জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, গুজব ছড়ায়, সে গানে নাকি প্রেক্ষাগৃহে সর্পাগমন ঘটত! আসলে, সাপ শুনতে না পেলেও সাপুড়ে তো পান! তাই উপমহাদেশ জুড়ে আজও সাপুড়ের বিনে হৈমন্তী ধুন! ‘সিগনেচার’!

মোটরবাইকে সওয়ার সুচিত্রা-উত্তম। দর্শক-শ্রোতার সামনে গুপ্ত শরীরী টান। ছুঁয়ে থাকতে দেখার কাঁপুনি এবং হিংসাও। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, নিশ্চিত ভাল হয়! কত বার যে উত্তমের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে সুচিত্রার স্পর্শ চাওয়া! কত বার যে সুচিত্রাকে বাইক থেকে ফেলে দিয়ে উত্তমের বাহুলগ্ন বাঙালি মেয়ের মন! আসলে, ম্যাজিকটা সুরের রোমান্টিকতায়, যা নিখাদ বাঙালির। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ পর্যন্ত গেয়েই কৃষ্ণচন্দ্র দে গীত ‘অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে’ গাইলে যে কারণে উত্তম-সুচিত্রা মনের মোটরবাইক থেকে নামেন না!

বাংলার মাঠনদীর সুরের স্নাতক হেমন্ত।

উদাহরণ অজস্র। যেমন, কিশোরকুমার আর সুধা মলহোত্রের গাওয়া ‘কস্তি কা খামোশ সফর’ গানটা। এ সুরের সাম্পান একান্ত ভাবে বঙ্গীয়। সুরে দাঁড় উঠছে, দাঁড় পড়ছে।

‘বন্ধু তোমার পথের সাথিকে চিনে নিয়ো’, ‘কোয়েল পুকারে’, ‘এই রাত তোমার-আমার’, ‘ও রাতকে মুসাফির’, ‘বসে আছি পথ চেয়ে’, ‘এই তো হেথায় কুঞ্জছায়ায়’— দীর্ঘ মেলডিপথের পাশাপাশি হেমন্ত আরও অনেক কিছু করেছিলেন। অর্থহীন সমালোচনাকে গুরুত্ব না দিয়ে বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন রবীন্দ্রগান, সলিল-জাদুতে গেয়েছেন ইতিহাসপ্রতিম গণগান। এবং বাংলা উচ্চারণ শিখিয়েছেন বাঙালিকে।

কিন্তু বাঙালিয়ানার রোল-মডেল, বহির্বঙ্গের কাছে কার্যত প্রথম ‘দাদা’কে বাঙালি নেবে না ফেলে দেবে, বুঝতে পারে না আজও। ধরা যাক, কোনও এক বাঙালির এক চনমনে বিকেলে মনে হল, ‘অলির কথা শুনে বকুল হাসে’ গানটার সুরে গদগদ প্রেম আছে এবং সেটা তাঁর আপন আদরকাঠামোর প্রতিনিধিত্ব করে না। আবার বিরহলাঞ্ছিত রাতে একা ছাদে দাঁড়িয়ে তাঁরই ওই সুরটিকে প্রার্থনার শান্তির মতো আপন মনে হল! এই ভাবেই সমস্যা বাড়িয়েছেন হেমন্ত! দেখনদারি বাদ দিয়ে, অসাধারণত্বকে আত্মস্থ করে আপাত-সাধারণ করে তোলার জাদুতে! তিনি রবীন্দ্র-প্রভাবিত, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাতে কী এল গেল! রসের ভিয়েনে তো খামতি পড়েনি! আসলে, কোন বন্ধনীতে রাখা যাবে হেমন্ত মুখুজ্জে নামের জীবটিকে, গণগানের বয়ানে, প্রাণের আরামের রবীন্দ্রগেহে, না কি রোমান্টিক গোত্রে— সিদ্ধান্ত করে ওঠা যায়নি! হেমন্তকে ইন্টেলেকচুয়াল বাঙালি না পেরেছে গিলতে, না পেরেছে ওগরাতে। তা ছাড়া বর্জনের অভিপ্রায়ে গ্রহণ করাও তো সুস্থ রেচনতন্ত্রের সহায়ক নয়! তাই বাংলা গান শোনার অভ্যাস ক্রমশ ধূসর হয়েছে। কবীর সুমন নামের আর এক সিগনেচার-অলা সঙ্গীতকার না এলে হয়তো সেই ধূসরিমাই দীর্ঘায়িত হত!

‘নিঝুম সন্ধ্যা’র পাখিরা মেনকা সিনেমার উল্টো দিকের বাড়ির পাশের গাছগুলোয় আজও ফিরে আসে, থাকে। ভোরে মানুষজন লেক থেকে বাড়িটার তলার চায়ের দোকানে জড়ো হবেন আজও নিশ্চিত। দোকান চালাবেন সুকুমার ভুঁইয়া, যাঁকে পড়াশোনা আর ফুটবল খেলার জন্য টাকা-পোশাক দিতেন ধুতি-শার্ট। তিনি গানের স্বরলিপি ফেলে চলে যাওয়ার দিন সুকুমার লেক মার্কেট থেকে বরফ এনেছিলেন তাঁর মরদেহের জন্য। দোকানে ভিড় জমবে ইন্দ্র শীটেরও, যাঁর দাদু পরেশের দোকানে তিনতলা থেকে নেমে চা খেতেন ধুতি-শার্ট। ধুতি-শার্টের দরজার সামনে একই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে পুরসভার বাতিল বাতিস্তম্ভটা। আজকের কচুরির দোকানের ভরত পাল যার তলায় ছোটবেলায় পড়তেন আর বাবা বিশ্বনাথ মশলামুড়ির দোকান চালাতেন। মশলামুড়ি তিনতলায় উঠত লতা মহড়ায় এলে, কিশোর এলে, দেশের তাবড় শিল্পী বা আত্মীয়বন্ধু এলে। তাঁর দেওয়া নতুন শার্ট বড় হয়েছিল বলে কী লজ্জা পেয়েছিলেন ধুতি-শার্ট আর মাপসই নতুন জামা কিনে এনে দিয়েছিলেন, তা মনে আছে উল্টো-ফুটের চা-দোকানের তারাপদ দে’র। এঁদের সবারই ধুতি-শার্টের কথা মনে আছে। মনে আছে খুব কাছের এক জন ‘ভালমানুষ’কে।

শুধু আমবাঙালির, দেশের আর উপমহাদেশের সম্ভবত তেমন মনে নেই আদ্যন্ত গানমানুষটিকে, শততম জন্মদিন আজ যাঁর।

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

Hemanta Mukherjee হেমন্ত মুখোপাধ্যায় Bengali Singers

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}