স্টেশনের নামেও বৈচিত্রের ছোঁয়া। নিজস্ব চিত্র
অনেক লেনদেন আর সংমিশ্রণকে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে বাঙালির জাতিসত্তা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নীহাররঞ্জন রায়ের মতো ব্যক্তিরা বাঙালির জাতিসত্তা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, আমাদের দেশে যখনই কোনও নতুনের স্রোত এসেছে বাঙালি চিরকালই তাকে সর্বাগ্রে গ্রহণ করেছে। এই কারণেই বাঙালির জাতিসত্তায় ‘নানা জাতি নানা মত’-এর মিলন ঘটেছে। বাঙালি সংস্কৃতির মতোই বাংলা ভাষাও একাধিক জাতির ভাষা ও সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে নিজের রূপটি গঠন করেছে। এই কারণে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেই ঋণের ছাপ।
বাংলা ভাষার উপরে যে ভাষাগুলির প্রভাব সবথেকে বেশি তার একটি হল অস্ট্রিক ভাষা। অস্ট্রিক ভাষাজাত সাঁওতালি, মুন্ডারি, শবর, হো-সহ প্রায় ১৮টি ভাষা ভারতের নানা প্রান্তে প্রচলিত। এই ভাষার দু’-চারটি শাখার অস্তিত্ব দুই বর্ধমানে আজও রয়েছে। অস্ট্রিকের পরে যে ভাষাটি বাঙালির সংস্কৃতিকে সব থেকে বেশি প্রভাবিত করেছে সেটি হল দ্রাবিড়। পশ্চিমবঙ্গে দ্রাবিড় ভাষী কোরাঙ্গা (দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের জেলা), গণ্ড বা গোঁড় ও খণ্ড বা খোঁড় (পুরুলিয়া জেলা), পাখমারা (বর্ধমান, মেদিনীপুর ইত্যাদি জেলা) ইত্যাদি জাতির অস্তিত্ব এখনও পাওয়া যায়। রাজমহল পাহাড় ঘেঁষা পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি স্থানে ‘দ্রাবিড় জাত’ মালতো ভাষা এখনও কথিত রয়েছে। ইতিহাস গবেষকদের অনুমান, আর্যভাষা গোষ্ঠীর মানুষেরা আসার আগে অখণ্ড বর্ধমানে কিছু দ্রাবিড়ভাষী মানুষের বসবাস ছিল। ‘কাকমার’ বা ‘পাখমার’দের মতো কিছু জাতির মানুষ এখন দু’ই বর্ধমানের স্থায়ী বাসিন্দায় রূপান্তরিত হয়েছেন।
দ্রাবিড়-অস্ট্রিক ইত্যাদি অনার্য সম্প্রদায়ের সহাবস্থান বর্ধমানের ভাষা এবং স্থান-নামের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ‘‘বাঙলা ভাষা আর বাঙালী জা’তের গোড়ার কথা’’ প্রবন্ধে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, পুরনো অনুশাসনে পাওয়া পোল/বোল, জোডী/জোলী, জোটী, হিট্টা/ভিট্টা, গড্ড/গড্ডী ইত্যাদি স্থান-নামবাচক শব্দ হল দ্রাবিড় ভাষা থেকে উদ্ভূত।
অনেক সময়েই আলাদা ভাবে নয়, এই বর্ধমানের মাটিতে দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠী ভুক্ত মানুষ এই এলাকায় এক সঙ্গে বসবাস করতেন। অনেকে বলেন, নাগ ও কোন্দা জাতির মানুষ এক সঙ্গে বসবাস করার ফলে ‘নাগরাকোন্দা’ গ্রাম নামের সৃষ্টি হতে পারে। অনেকের মতে, ভাতারের মাহাতা গ্রামে সম্ভবত ‘মহতরী’ সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস ছিল।
পশ্চিম বর্ধমানে আজও তুরি সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন। কোল ভাষায় ‘তুরে’ শব্দের অর্থ শুয়োর। আবার নুনিয়া উপসম্প্রদায়ের মানুষও এই জেলায় বসবাস করেন। কোল ভাষার ‘নুনে’ শব্দের অর্থ ‘তৈল’। সেই সুবাদে অনেকে এই সম্প্রদায়কে তৈল উৎপাদনকারী বলে মনে করেন। আবার দ্রাবিড় ভাষায় ‘গণ’ শব্দের অর্থ তেল ব্যবসায়ী। সেই সুবাদে এদের জনপদের নাম ‘গণপুর’ হয়ে থাকতে পারে এমন মতও শোনা যায়।
সমালোচকদের একাংশের মতে, আদিম জাতিরা জলের স্থান খুঁজতো। ‘দা’, ‘দহ্’ ইত্যাদি শব্দের দ্বারা ‘জল’কে বোঝানো হত। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় ভাষার ‘দা’ মানে জল। জলযুক্ত স্থান হিসেবে হয়তো ‘নওদা’, ‘বসুদা’ ইত্যাদি নাম এসেছে বলে অনেকে মনে করেন। অস্ট্রিক ভাষার ‘বাঁধ’ শব্দ জলাধার বা জলাশয় বোঝাতে ব্যবহার হত। এই কারণে জলযুক্ত স্থান হিসেবে ‘বাঁধমুড়া’, ‘বাঁধগাছি’, ‘বাঁদরা’ ইত্যাদি স্থান-নামের উদ্ভব হয়ে থাকতে পরে বলে অনেকে মনে করেন।
বর্ধমানের জনপদ কোলকোল সম্ভবত কোল ভাষার প্রভাবে সৃষ্ট। অস্ট্রিক ‘কোল’, ‘কোলা’, ‘কুলি’ শব্দ প্রযুক্ত হত নদী, খাল, জল ইত্যাদিকে বোঝাতে। সেই থেকে ‘ধাওয়াকোল’ নামের উদ্ভব হয়ে থাকতে পারে বলে অনুমান করা হয়। মুন্ডা ভাষার ‘মুড়া’ বা ‘মুড়ি’ স্থান নামের শেষে থাকে। বারমুড়ি, বাঁধমুড়া, চকমুড়ি, নরসমুড়া ইত্যাদি নামের শেষে ‘মুড়ি’ বা মুড়া শব্দের উপস্থিতি এই জনপদগুলির সঙ্গে অস্ট্রিক ভাষার যোগের পরিচয়বাহী। অস্ট্রিক ভাষার শব্দ ‘ডোবা’, ‘ডুবি’ ইত্যাদিও নিচু জলাজমিকে বোঝাতো। তা থেকে মনে করা যেতে পারে, কুমারডুবি, ভুইডোবা ইত্যাদি নামের উদ্ভব।
স্থান নামের পাশাপাশি, বাংলায় সংখ্যা গোনার রীতিতেও অস্ট্রিক রীতির প্রভাব রয়েছে। অনেকে মনে করেন, ‘কোডা’ শব্দের অর্থ দেহ ও কোমর বাঁকিয়ে মাটি ছোঁয়া। সেই কাজ হাত ও পায়ের কুড়ি আঙুল মিলিয়ে করতে হয়। এই কোডা থেকেই ‘কুড়ি’ শব্দটি এসেছে। পরে কুড়ি সংখ্যার একটি পরিমাপ হিসেবে কাজ করে এসেছে। গ্রামীণ অঞ্চলে আজও চল্লিশ বা ষাটকে বোঝাতে দু’কুড়ি, ‘তিনকুড়ি’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
মান্য বাংলা ভাষার কথ্য রূপেও অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় ভাষার প্রভাব চলছে। ‘ছোঁড়া’ (ছেলে), ‘ছুঁড়ি’, ‘খোকা’, ‘খুকি’ ইত্যাদি। কোল ভাষার ‘পিল্লে’ বা ‘দ্রাবিড়’ ভাষার ‘পিল্লৈ’ (তেলুগু পিল্লা) শব্দ থেকে বাংলায় ‘পিলে’ শব্দের উদ্ভব বলে মনে করা হয়। দেশিয় শব্দ হিসেবে ‘ডাঙ্গা’ বা ‘ডাঙা’ শব্দের উল্লেখ বাংলা অভিধানে পাওয়া যায়। সাঁওতালি ভাষার ‘ডাঙ্গা’, ‘ডাঙ্গাল’ প্রভৃতি শব্দের অর্থ ‘বসবাসের জায়গা’। ‘ডাইঙ্গ’, ‘ডুঙ্গুরি’ ইত্যাদির অর্থ উচ্চভূমি। এ থেকে বর্ধমানের কুলডাঙা, বরাডাঙা, মাঝিডাঙা প্রভৃতি স্থানের নামের উদ্ভব বলে মনে করা হয়ে থাকে। অনেকে আবার ‘ডাঙা’-শব্দযুক্ত স্থানের নামের সঙ্গে ‘ডিঙা’ শব্দের যোগও খুঁজতে চান। তাঁদের মতে এর সঙ্গে যোগ রয়েছে অতীত কালের মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের। দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক— দুই ভাষাতেই রয়েছে ‘আড়া’ বা ‘আরা’ শব্দ। এটির দ্বারা কিনারা, ডাঙা, শুকনো জমি ইত্যাদিতে বোঝায়। দুই বর্ধমানের বামুনাড়া, মালিয়ারা, সুন্দিয়ারা ইত্যাদি স্থান-নামের সঙ্গে এই শব্দের যোগ থাকতে পারে বলে অনুমান করা হয়।
দ্রাবিড় ভাষার একটি স্থান-নাম বিভক্তি হল ‘ওনা’। বর্ধমান জেলায় ইরকোনা, করকোনা, রায়কোনা ইত্যাদি স্থান-নামে এই বিভক্তির ব্যবহার লক্ষ করা যায়। স্থান-নামের শেষে প্রযুক্ত দ্রাবিড় ভাষার -অন, -আন, -অন্দা প্রত্যয়ের দ্বারা সেখানকার অবস্থান ও নৈকট্য বোঝায়। রায়ান, গোতান, কোন্দা, খাটুন্দি, বেলেন্দা ইত্যাদি স্থান নামে এই বিভক্তির ব্যবহার এই স্থানগুলির অবস্থান ও স্থলভাগের সঙ্গে নৈকট্যকে প্রকাশ করে। একই ভাবে সাঁওতালি ভাষার ‘বির’ বা ‘বীর’ শব্দের অর্থ জঙ্গল বা বন। দুই বর্ধমানের বিরপুর, বিরুডি, বিরডিহা, বীরটিকুরি ইত্যাদি নামে এই বীর বা বির শব্দের ব্যবহার দ্বারা এই অঞ্চলগুলিতে জঙ্গলের অবস্থানকে বোঝানো হয় বলে মনে করেন সমালোচকদের একাংশ।
সমালোচকেরা মনে করেন, দুই বর্ধমানের অতীতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে অনার্য গোষ্ঠীর ভাষাসংস্কৃতি। সেই সময়ে পাহাড়, নদী, গ্রাম ইত্যাদির নামকরণ হয়েছিল আর্যেতর এই মানুষদের ভাষা অনুসারে। ক্রমে ভাষা-পরিস্থিতি বদলানোর ফলে জেলার স্থান নামগুলির সঙ্গে অতীতের যোগসূত্র খুঁজে পেতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন অনেকে। দেশি ভাষা-সংস্কৃতির অন্তরালে অনার্য ভাষা-সংস্কৃতির নেপথ্য ভূমিকা অনেকটাই। সেই প্রেক্ষিতকে চিনতে দরকার আরও বিস্তৃত গবেষণা এবং ক্ষেত্রসমীক্ষার।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy