Advertisement
E-Paper

জেতা যায় সৌরশক্তির অস্ত্রে

ঝড়ের ফলেই অকালমৃত্যু, ক্ষয়ক্ষতি, বিদ্যুৎহীনতা। বিকল বিদ্যুৎচালিত সব যন্ত্র: আলো, পাখা, পাম্প, জল-শোধক।

পার্থসারথি মজুমদার ও মানবী মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২০ ০০:০১
Share
Save

আমপানের তাণ্ডব থেমে যাওয়ার দু’দিন পরে গভীর উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করা একটা ফোন পেলাম। উত্তর ২৪ পরগনার এক বন্ধুর কাছ থেকে। পাঁচ টাকা দিয়ে কাছের একটা দোকানের ইনভার্টারে মোবাইলটা চার্জ দিয়ে ফোন করছে। টেলি যোগাযোগ এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক দেখে কয়েকটা কথা মনে হল।

ঝড়ের ফলেই অকালমৃত্যু, ক্ষয়ক্ষতি, বিদ্যুৎহীনতা। বিকল বিদ্যুৎচালিত সব যন্ত্র: আলো, পাখা, পাম্প, জল-শোধক। পানীয় জলের অভাব, দৈনন্দিন জীবনে গভীর সঙ্কট, দিকে দিকে হাহাকার। ও দিকে, সরকার নানা সমস্যা মোকাবিলায় ব্যস্ত। কত বাড়ির ছাদ উড়ে গিয়েছে, এখনই মেরামত দরকার। কত জায়গায় রাস্তা এবং সেতুর ক্ষতি হয়েছে, সেগুলি ঠিক না করলেই নয়। কত গাছ পড়েছে কলকাতা এবং আশেপাশের জেলায়। এ সব ঠিক করতে দেরি হলে গোটা শহর স্তব্ধ হয়ে যাবে, অর্থনীতির আরও ক্ষতি হবে। এ সবই সরকারকে দেখতে হয়। কোভিড-১৯’এর পরীক্ষাও থমকে গিয়েছে। বিদ্যুৎ নেই, ল্যাব বন্ধ। ডিজ়েল জেনারেটর না থাকলে হাসপাতালই বা চলবে কী করে?

এ সময় আমরা— জনসাধারণ— কি কেবল অসহায় দর্শক? সরকার বা বিদ্যুৎ কোম্পানি কখন কাজ করবে, মোবাইল টাওয়ার কখন ঠিক হবে, গালে হাত দিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করব আর দুশ্চিন্তা করব? আয়লা, বুলবুল, আমপান— ঝড় একের পর এক আসবেই। প্রত্যেক বারই কি এমন হবে? ব্যাপারটা বোধ হয় এতটা নৈরাশ্যজনক নয়। বরং ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিকল্প প্রস্তাব করা যায়— সৌরবিদ্যুৎ। সমস্ত কিছু না হলেও সৌরবিদ্যুৎকে কাজে লাগিয়ে অনেক দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান বাড়িতে বসে নিজেই করে নেওয়া যায়। সামর্থ্য ও রুচি অনুসারে স্বাধীন ভাবে ন্যূনতম খরচে সে কাজ হয়। দরকার শুধু খানিকটা রোদ, যা অনেক বাড়িতেই অফুরন্ত।

কী রকম সমাধান? প্রথমেই আসে ঝড়ের পরে পানীয় জলের সঙ্কটের কথা। আমপানের বৃষ্টিতে সর্বত্র জল জমে গিয়েছে, অথচ খাওয়ার জলের অভাব। পানীয় জল থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা দূষিত হয়ে গিয়েছে। জীবাণু ভর্তি সেই জল খাওয়া যায় না। সৌরশক্তির সাহায্যে কিন্তু এই জলকে পানযোগ্য করে তোলা যায়। সহজলভ্য ফিল্টারের ছাঁকনি দিয়ে কাদা-সহ দূষিত পদার্থগুলোকে মোটামুটি বাদ দিয়ে দেওয়া দেওয়া যায়। কিন্তু জীবাণু ছাঁকনিতে আটকায় না। ঘরে ব্যবহারযোগ্য ৫০ ওয়াটের সৌর প্যানেলের সাহায্যে ১২ ভোল্ট ব্যাটারি চার্জ করে তা দিয়ে ডজনখানেক ছোট অতি-বেগুনি বা আলট্রা ভায়োলেট এলইডি জ্বালানো সম্ভব। সেই আলোয় জল ছেঁকে ৯০ শতাংশ জীবাণু নির্মূল করা যেতে পারে। প্রত্যন্ত এলাকাতেও যে কেউ অল্প খরচে এটা ব্যবহার করতে পারেন। কেবল ছোটখাটো যন্ত্রটা আর সস্তার সৌর প্যানেল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। যন্ত্রটা সহজে তৈরি করার কাজে শহর ও গ্রামের যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। তাতে কর্মসংস্থানও হয়।

এই প্যানেলের সাহায্যেই অতি সস্তার সৌর চার্জার দিয়ে বাড়িতে নিখরচায় মোবাইল ফোন চার্জ দেওয়া যায়। প্রচলিত বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছাড়াই। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্ন হলেও দোকানে ছুটতে হবে না। সৌরশক্তির সাহায্যে ১২ ভোল্টের ব্যাটারি চালিত এলইডি আলো-পাখা এখন গ্রাম ও শহরতলির নানা এলাকায় ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে যেখানে প্রচলিত বিদ্যুতের ঘাটতি। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এর প্রসার ঘটছে বটে, কিন্তু এই রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ বুঝিয়ে দেয় যে তা আরও ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষত, সৌরবিদ্যুৎ-চালিত জলের পাম্প যা সম্প্রতি বাজারে এসেছে, তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনো দরকার।

করোনা পরীক্ষার বেশির ভাগ যন্ত্রই ১২ থেকে ২৪ ভোল্ট সৌরবিদ্যুতে চালানো সম্ভব। সে ক্ষেত্রে প্রচলিত বিদ্যুৎব্যবস্থার অভাবে পরীক্ষা থেমে যাবে না। এমনকি, হাসপাতালের অনেক যন্ত্রই কম ভোল্টের সৌরবিদ্যুতে চালানো যায়। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা জোরদার করতে, বিশেষ বর্তমান পরিস্থিতিতে, সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার হওয়া উচিত।

ঝড়ের পর বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে মোবাইল টাওয়ারগুলোও অকেজো হয়ে পড়েছিল। ফলে ফোনে চার্জ থাকা সত্ত্বেও যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। যদি প্রচলিত বিদ্যুৎচালিত একটি বড় টাওয়ারের বদলে একাধিক ছোট ছোট সৌরবিদ্যুৎ চালিত টাওয়ার একযোগে সেই পরিষেবা দিত? মনে পড়ে, ১৮৯৫ সালে টাউন হলে এক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় ৭৫ ফুট দূরে মিলিমিটার মাইক্রোওয়েভ পাঠিয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। এত দিন পরে, প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতি সত্ত্বেও আমরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হব কেন? যেখানে সৌরবিদ্যুতের মতো অপ্রচলিত শক্তির কথা আমাদের জানা, এবং হাতের সামনে এমন এক ঐতিহাসিক উদাহরণও সম্বল?

জীবাশ্ম বা খনিজ জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ তৈরিতে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড আকাশে বাতাসে ছড়ায়, সেটা এখনকার বহু প্রাকৃতিক দুর্যোগেরই উৎস। আমপানও ব্যতিক্রম নয়। সৌরবিদ্যুৎ কিন্তু সেই সমস্যা থেকে একেবারে মুক্ত। শুধু দুর্যোগে নয়, প্রাত্যহিক জীবনেও আজ আমাদের রোদের দিকে তাকানো আশু প্রয়োজন।

পদার্থবিদ্যা বিভাগ, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স; প্রতীচী ইনস্টিটিউট

Solar Energy Cyclone Amphan Fossil Fuel

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy