Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

সিন্ধুকে দেখেই স্বপ্ন বুনছে রেশমা, জেসমিনরা

দেশের মেয়ে-খেলোয়াড়দের পরিবারে এখন নতুন ভগবান পি ভি সিন্ধু। তাঁকে ভরসা করেই হয়তো পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন বারবার ছুঁতে পারবে মেয়েরাও। লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলামবিলকিস নামের সেই মেয়েটি লাজুক হাসে, ‘‘আমি কবাডি খেলি।’’ বাকিরা চেঁচাতে থাকে, ‘‘হ্যাঁ দিদি, ও ভাল জানবে। ও যে খেলে!’’

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০৬
Share: Save:

নেটপাড়ায় বিপুল আলোড়ন, তুমুল সমালোচনা ও নাগাড়ে নিন্দার ঝড়। কেন র‌্যাম্পে হাঁটছেন মেয়ে? কেন কোর্টের বাইরে বিজ্ঞাপনে এত সময় অপচয়? কেন এত ছুটি কাটাচ্ছেন? এই আক্রমণের কেন্দ্রে অন্য কেউ নন, স্বয়ং পুসারলা ভেঙ্কট সিন্ধু। তবে সব সমালোচনার জব্বর জবাব দিলেন এ বার। নিজের র‌্যাকেটেই। বিশ্বের দরবারে চ্যাম্পিয়নের পতাকা উড়িয়ে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, জয়ী হওয়াটাই ছিল তাঁর ব্রত। দেশের গর্বিত পতাকায় তিনিই লিখে দিলেন এক অনন্য সম্মানের ইতিহাস। সোনা জয় করে দেশজুড়ে খুশির হাওয়া বইয়ে দিলেন ঘরের মেয়ে সিন্ধু।

দেশের জন্য সোনা আনতে না পেরে সিন্ধু ভেঙে পড়েননি। শপথের মতো করে বলেছিলেন, ‘‘আমাকে এখনও জয়ের চেষ্টা করতে হবে।’’ শেষ পর্যন্ত হার না মানা পুসারলা ভেঙ্কট সিন্ধু সোনা হাতে নিয়েই দেশের মাটিতে পা রাখলেন। শহরের রাস্তার পাশে সলমন, অনুষ্কা, দীপিকা, বিরাটের পাশে ঝুলছে সিন্ধুর পোস্টারও। সে ছবি কিনছে খুদে খেলোয়াড়েরা। ঘরে টাঙিয়ে রাখছে। ‘পজিটিভ থাকো। নিজের যা পছন্দ তাই করো। জীবন উপভোগ কর।’— এই তিনটি মন্ত্র নিয়েই সিন্ধুর সাফল্যের জীবন। ঘরে ঘরে তাই বিন্দু বিন্দু করে ছড়িয়ে পড়ছে সিন্ধু।

সে দিন শনিবার। সবেমাত্র বিদ্যালয়ে ছুটির ঘণ্টা বেজেছে। পড়ুয়াদের হাতে রঙিন পেপসি। গোলাপি আইসক্রিম। চানাচুর মাখানি। সকলে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। তাদের এক জনের হাত খপ করে ধরে ফেললাম, ‘‘এই মেয়ে, সিন্ধুকে চিনিস?’’ তার হাসিই থামে না! বলে, ‘‘হ্যাঁ দিদি, সিন্ধু সভ্যতা পড়েছি।’’ আর এক জন বলল ‘‘ঘোড়ার নাম সিন্ধু।’’ পাশের জনের জবাব, ‘‘সিন্ধু তো নদীর নাম।’’ এক জন শুধু শান্ত ভাবে বলল, ‘‘আমি চিনি। সিন্ধু ব্যাডমিন্টন খেলে।’’ কী করে জানলে? বিলকিস নামের সেই মেয়েটি লাজুক হাসে, ‘‘আমি কবাডি খেলি।’’ বাকিরা চেঁচাতে থাকে, ‘‘হ্যাঁ দিদি, ও ভাল জানবে। ও যে খেলে!’’

আচ্ছা, যে মেয়ে বিশ্বের দরবারে দেশের পতাকা পতপত করে ওড়ালেন, তাঁকে কেন সবাই চিনতে পারছে না! খেলাটা ব্যাডমিন্টন বলে? সপ্তম শ্রেণির জেসমিন একমুখ হাসি নিয়ে বলছে, ‘‘জানেন, আমি ঘরে সিন্ধুর একটি ছবি লাগিয়েছি।’’ জেসমিন হকি খেলে। তাই সে সিন্ধুর খেলার স্পিরিটটা হয়তো বুঝেছে। মাঠের উত্তাপও সে জানে। কী করে সেই উত্তাপ মাঠ পেরিয়ে পৌঁছয় ঘরে-ঘরে, দেশে-দেশে তার এক-আধটু খবরও হয়তো সে রাখে। খেলা দেখতে দেখতে খেলার সুযোগও পায় মেয়েরা। ছেলেরা ভলি খেলত। পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত রেশমা। তার পরে এক দিন ছেলেরাই তাকে ডেকে বলল, ‘‘খেলবি?’’ এখন রেশমা ইন্টার স্কুল ভলি চ্যাম্পিয়ন টিমের সদস্য। উৎসাহ কখন যে কোথা থেকে আসে কে জানে! শুধু নিজেকে মেলে ধরার জন্য চাই জেদ। চাই সাহস।

সিন্ধুর হিরো তাঁর বাবা। মায়ের হাতের খাবার প্রিয়। আর পাঁচটা মেয়ের মতোই তিনি রেস্তরাঁর খাবার ভালবাসেন। ভালবাসেন রণবীর সিং আর মহেশ বাবুর সিনেমা। পছন্দ টুইটার। একদম পাশের ঘরের মেয়েটিই সিন্ধু। বাড়ি থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরে কোচিং ক্যাম্প। সেখানে প্রতিদিন সময়ের আগেই তিনি হাজির। কোনও অজুহাত নেই। সম্ভবত এক জন ভাল ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হওয়ার প্রয়োজনীয় শর্ত কঠোর পরিশ্রম। প্রতিশ্রুতিতে টিকে থাকার প্রবল ইচ্ছাও দরকার। তারই প্রতিফলন দেখা গিয়েছে সিন্ধুর অনুশীলন ও নিয়মানুবর্তিতায়। দেশের মাটিতে হোক বা দেশের বাইরে খেলাটা খেলাই। তিনি খেলে যান। যতটা তিনি খেলতে পারেন। জেতার চাপ নয়, ম্যাচ শেষ করার তাগিদ থেকেই খেলে সিন্ধু খেলেন। স্ম্যাশ তাঁর বড় প্রিয় শট। শত্রুকে ডিফেন্সের সুযোগ দেন না। সেই জন্যই তো ফাইনালে মাত্র ৩৮ মিনিটে অকুহারাকে ২১-৭ ও ২১-৭ সেটে হারিয়েছেন সিন্ধু।

এক দিন দেশের জন্য সোনা না আনতে পেরে সিন্ধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘‘আমি কঠোর পরিশ্রম করছি, আমি যথেষ্ট ভাগ্যবান ছিলাম না।’’ কিন্তু খেলা নিয়ে তাঁর কৌশল ও ভাবনা ছিল অপরিবর্তিত। কখনও কম র‌্যাঙ্ক করা খেলোয়াড়কে হালকা করে নেননি তিনি। তাঁর সমস্ত ম্যাচগুলির মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর প্রতিপক্ষকে সমান হিসাবে বিবেচনা করেছেন। অন্য খেলোয়াড়দের মতোই সিন্ধুর কেরিয়ারেও টানাপড়েন রয়েছে। আট বছর বয়সেই হাতে তুলে নিয়েছেন র‌্যাকেট। ১৭ বছর বয়সেই সেরা ২০-র মধ্যে জায়গা করে নিলেও পদ্মশ্রী সিন্ধুর লড়াই ছিল কঠিন। সিন্ধু ম্যাচগুলি যতক্ষণ জিতেছেন ততক্ষণ সমাজ-মাধ্যম তাঁকে নিয়ে হইহই করেছে। হেরে গেলে একের পর এক আক্রমণ। সব জেনেও সিন্ধুর একটিই কথা, ‘‘আমি এ সব মাথায় নিই না। মানুষ কী বলছে তা ভাবি না। আমায় এখনও খেলে যেতে হবে।’’

ক্লাস সেভেনে পড়া গ্রামের মেয়ে হকি খেলে। তার বাবাকে নানা বাঁকা কথা শুনতে হয়। সিন্ধুর সাফল্যে সেই বাবাও খুশি। তিনি বলছেন, ‘‘কাগজ খুললেই আগুন লাগার খবর। বাড়ি ভেঙে পড়া, ব্রিজ ভেঙে পড়ার খবর। খেলার পাতা জুড়ে ক্রিকেট। তবে কিছুদিন ধরে সিন্ধু জায়গা কেড়ে নিয়েছে। খুব ভাল লাগছে।’’ সত্যিই তো, সিন্ধু-সৌজন্যে একঘেয়েমির হাওয়াবদল হল যেন। প্রত্যন্ত এলাকায় মেয়েদের মনে নতুন আশার জন্ম নিচ্ছে। হাজার প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এই জাগিয়ে রাখা প্রত্যাশার আড়ালে স্বপ্ন দানা বাঁধছে। এমনটাই হয়তো সিন্ধুর কোচ ভেবেছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন পি টি উষার কোচও। শুধু খেতাব নয়, খেলার ইমেজটাকে বিস্তৃত করা বড্ড দরকার।

মাঝে মাঝে খেলাটাকেও জনপ্রিয় করে তোলার নেপথ্যে থাকে খোলোয়াড়ের ভূমিকা। খেলোয়াড়কে জানতে জানতেই তাঁর খেলাটাকেও ভালবাসতে শুরু করে লোকজন। খেলোয়াড় নিজেই ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন ব্র্যান্ড। সিন্ধু আজকের ভারতের নতুন ব্র্যান্ড। তাঁর হাত ধরেই মেয়েদের সূর্যোদয় দেখার সুযোগ এসেছে। সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত এই খেলোয়াড় জেন্ডার-গ্যাপে এনেছে এক নিঃশব্দ বিপ্লব। পারিশ্রমিকের ফারাক নিয়ে দিকে-দিকে ফিসফাস চলে মেয়েদের।

সিন্ধু কিন্তু প্রথম মেয়ে খেলোয়াড় হিসেবে বিজ্ঞাপণের জগতে দখল করেছেন শীর্ষ স্থান। অলিম্পিকে রুপোর পরে এখন সোনা হাতে তিনি বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। দেশের মেয়ে-খেলোয়াড়দের পরিবারে এখন তিনি নতুন ভগবান। তাঁকে ভরসা করেই হয়তো পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন বারবার ছুঁতে পারবে মেয়েরাও। তাদের সাফল্যের ভিত নির্মাণেই সিন্ধুর প্রকৃত সার্থকতা। খেলোয়াড় আসেন, যান। কিন্তু উত্তরসূরীদের মধ্যে উন্মাদনার স্পিরিটটা ছড়িয়ে দেওয়াই শেষ কথা।

শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

অন্য বিষয়গুলি:

P V Sindhu Badminton
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy