শান্তিনিকেতনের রুখুমাটি সারা বছর মুখিয়ে থাকে কবে পৌষমেলা আসবে, দেশ-বিদেশের মানুষের পায়ের ধুলো পড়বে তার গায়ে। ব্রহ্মডাঙা শান্তিনিকেতনে দুর্গোৎসব নেই। পৌষ-উৎসবই এখানকার মানুষের প্রধান বার্ষিক পার্বণ, প্রাক্তনীদের পুনর্মিলন তিথি। ইন্ডাস্ট্রি-বিরল বীরভূমের স্থানীয় অর্থনীতিতেও পৌষমেলার গুরুত্ব অপরিসীম। এ-হেন পৌষমেলা গত তিন-চার বছর গভীর এক সঙ্কটের মুখোমুখি। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে, বাংলার সাংস্কৃতিক মানচিত্রের অন্যতম এই পার্বণ পরের বছর আর অনুষ্ঠিত হতে পারবে কি না তা বলতে পারছেন না বিশ্বভারতীর উপাচার্যও।
শান্তিনিকেতনে কান পাতলে অবশ্য শোনা যাচ্ছে এ বছর মেলা হয়েছে যথেষ্ট নিয়মানুগ। পরিবেশ আদালতের নির্দেশের মর্যাদা রক্ষা করার জন্যই এ বছর মেলার মেয়াদ ধার্য হয়েছিল চার দিন। অর্থাৎ যাতে দুই দিন মালপত্র গোছানোর সময় দিয়েও সপ্তম দিনে মেলাপ্রাঙ্গণকে তার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া যায়। তাতে ব্যবসায়ীদের যেটুকু আর্থিক ক্ষতি হয়, এ বছর থেকে তা মেনে নিতে হবে জেনেই তাঁরা স্টল দিয়েছিলেন। বিশ্বভারতী এ বার মেলা শেষ হওয়ার দু’দিনের মধ্যে মেলার মাঠকে খেলার মাঠে ফিরিয়ে দিতে পেরেছে। আসলে প্রাকৃতিক পরিবেশ আর মানবিক পরিবেশের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য-সাধন হলে সব পক্ষের মঙ্গল। দেশের পরিবেশবিধি এবং জন-আবেগের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হলে নির্ধারিত দিনের পর মেলা তুলে দেওয়াই একমাত্র পথ। অথচ অনেকেই মেলার অতীত স্মৃতিসুখের পাশে বর্তমানের এই বাস্তবতাকে মেলাতে পারছেন না।
ভবিষ্যতে যদি স্থির হয়, শান্তিনিকেতনের এই আনন্দ-অনুষ্ঠানটি কেবল মহর্ষির দীক্ষার সাংবৎসরিক উৎসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হবে, তা হলেও জনপরিসরে ব্যাপক আলোড়ন হবে নিশ্চয়ই। বাধা আসবে স্থানীয় ব্যবসায়ী মহল থেকে। বোলপুরের অর্থনীতির অন্যতম ক্ষেত্র এই মেলা। বীরভূমের একক-শিল্প ‘বিশ্বভারতী ইন্ডাস্ট্রি’র আকর্ষণে নানা চোরা-অনর্থ তো এত কাল মেলায় ঘটেই এসেছে। ভাবার বিষয় হল, যদি বিশ্বভারতী তার সামর্থ্য-অনুযায়ী শুধু সাংবৎসরিক পৌষ-উৎসবের মধ্যেই গুটিয়ে নেয় ৭ পৌষকে, তা হলে মোটের উপর লাভ না ক্ষতি?
মহর্ষির দলিল অনুযায়ী বিশ্বভারতী কি পৌষমেলা করতে বাধ্য? এ কথা ঠিক যে মহর্ষি তাঁর ১৮৮৮ সালের ৮ মার্চের ‘ডিড’-এ শান্তিনিকেতনে একটি বাৎসরিক মেলা করার জন্য ট্রাস্টির সদস্যদের ‘চেষ্টা ও উদ্যোগ’ করতে বলেছিলেন। এই দলিল যখন রচিত হয় তখন বিশ্বভারতী দূরের কথা, শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আজও কাগজে-কলমে এই মেলা পরিচালনার অধিকারী মহর্ষি-প্রবর্তিত সেই শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট। বিশ্বভারতী যে তার সীমিত পরিকাঠামোয় এই মেলা এত কাল করে আসছে তার কারণ সেটাই কালক্রমে দস্তুর হয়ে উঠেছিল।
মহর্ষির দীক্ষার সাংবৎসরিক উৎসব হয়েছে, কিন্তু মেলা হয়নি, এমন নজিরও উৎসবের ইতিহাসে আছে। ১২৯৮ (ইং ১৮৯১) সালের ৭ পৌষ শান্তিনিকেতন ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠার দিন সাংবৎসরিক উৎসবের সূচনা হলেও সে বছর মেলা বসেনি। পরে ১৯৪৩ এবং ১৯৪৬ সালে, যথাক্রমে মন্বন্তর ও সাম্প্রদায়িক হানাহানির জন্য পৌষমেলা স্থগিত রাখা হয়। কিন্তু মহর্ষির দীক্ষার সাংবৎসরিক অনুষ্ঠান আশ্রম-প্রতিষ্ঠাতার প্রতি আশ্রমিকদের এক রকম তর্পণ বলেই তা অবশ্যকর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হয়। রবীন্দ্রনাথের কাছে ৭ পৌষ একটা তারিখমাত্র ছিল না; এ ছিল তাঁর কাছে একটা আদর্শ, একটা সময়প্রতীক। পরে মেলা হয়ে যায় উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোত; এবং মানুষের কাছে সেটিই হল মুখ্য।
১৯০৪ সালে, বলা যায় রবীন্দ্রপর্বের পৌষমেলার আদিপর্বে, ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র প্রতিবেদনে বলা হয়, এই মেলায় ‘স্থানীয় দ্রব্যাদির বিক্রয়ও যথেষ্ট হয়।’ সে ছিল স্বদেশি-হাওয়ার যুগ। শান্তিনিকতনের পৌষমেলায় যে গ্রামীণ ও কুটির শিল্পের উপর বিশেষ গুরুত্ব ছিল, তার প্রচার ও প্রসারের সচেতন উদ্যোগ সম্ভবত এই সময়েই শুরু হয়। তার আগেও গ্রামীণ পশরা নিশ্চয়ই দেখা যেত মেলায়; কিন্তু তার কারণ নিহিত রয়েছে সেই সময়ের অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে। অর্থাৎ গ্রামীণ কৃষি-অর্থনীতি ছিল সে সময়ের ভিত্তি। মহর্ষির দলিলে কোথাও আলাদা করে সেই অর্থনীতিকে উৎসাহিত করার উল্লেখ নেই। মহর্ষির কাছে ‘ধর্ম্মভাব উদ্দীপন’ ও ব্রাহ্মসম্মিলনই ছিল মেলার মূল লক্ষ্য। কিন্তু ১৯০৪-এ ‘স্থানীয় দ্রব্যাদির বিক্রয়’-এর উল্লেখটি জরুরি মনে হয় কারণ ওই ১৯০৪ সালেই ‘স্বদেশী সমাজের সংবিধান’ প্রণয়ন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই ‘সংবিধান’-এ অন্যান্য অঙ্গীকারের মধ্যে এও বলা হয়েছিল যে ‘স্বদেশী দোকান হইতে আমাদের ব্যবহার্য দ্রব্যাদি ক্রয় করিব।’
স্বদেশি-সংবেদনার তরঙ্গ যে শান্তিনিকেতনের মেলায় পড়বে তা খুবই স্বাভাবিক। ১৯০৪ সালের মেলা সম্পর্কে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা লিখছে, ‘এই উদ্যান-মেলাভূমি শিক্ষা ও দীক্ষাপ্রদ গুরুর ন্যায় জ্ঞানী ও ভক্তের বিশেষ আদরের ও গৌরবের বস্তু। এই মেলার ইহাই বিশেষত্ব।’ মেলা বলতে, আজকে যে ‘কার্নিভাল’ বোঝায়, তার থেকে এই মেলার রুচিস্বাতন্ত্র্য কোথায়— ১৯০৪ সালেই, ‘তত্ত্ববোধিনী’ তা বুঝিয়ে বলেছে! রবীন্দ্রনাথের পৌষ-উৎসবেরই একটি ভাষণেও পড়া গিয়েছিল, ‘সত্য যেখানেই সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায় সেখানেই উৎসব।’ আমোদে নয়, বাণিজ্যিক লাভ-ক্ষতির হিসাবেও নয়।
১৯১০ সালে পৌষ-উৎসবের আর এক রকম ব্যাপ্তি ঘটান রবীন্দ্রনাথ। ১০ কার্তিক পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ আশ্রমের মন্দিরে বুদ্ধ খ্রিস্ট মহম্মদ চৈতন্যদেব প্রমুখ মহামানবের স্মরণোৎসব পালনের নির্দেশ দেন। মনে রাখতে হবে কবি যখন এই নির্দেশ দিচ্ছেন তখন তাঁর জীবনে চলছে ‘গীতাঞ্জলি’র পালা। ‘গোরা’ উপন্যাস প্রকাশিত হয় ওই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে। ‘ভারততীর্থ’ গান-কবিতাটিও লেখা হয় এই সময়েই। শান্তিনিকেতনের পৌষ-উৎসব ও মেলার বিবর্তন বোঝার জন্য কবির ভাবাদর্শগত অভিমুখ তথা শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতীর ইতিহাসকে সমান্তরালে রাখা প্রয়োজন মনে হয় আমাদের। গীতাঞ্জলি-গোরার পর্বে শান্তিনিকেতন মন্দিরের একান্ত ব্রাহ্মীয় চরিত্রটিও যে অনেকটা বদলে গিয়েছিল, তা ‘শান্তিনিকেতন’ ভাষণমালা পড়লেও বোঝা যায়। কবির দৃষ্টি এখন বিশেষ ধর্মবুদ্ধি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আর সীমায়িত হয়ে নেই! পৃথিবীতে আর কোথাও খ্রিস্টোৎসবে বৈদিকমন্ত্র আর বাইবেল একযোগে পাঠ হয় কি না— আমাদের জানা নেই।
এখন পৌষ-উৎসবের আর যে-কৃত্যগুলি অবশ্যপালনীয় হয়ে উঠেছে— যেমন পরলোকগত আশ্রমিকদের স্মৃতিবাসর, পাঠভবন-শিক্ষাসত্রের সমাবর্তন ইত্যাদি— সেগুলি যুক্ত হয়েছে পরবর্তী বিবর্তনের ধারাপথে। ১৯১১ সালে ‘আশ্রমিক সঙ্ঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ১৯১৯ সালে শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠিত হয় তার শাখা। পৌষ-উৎসব ছিল তাঁদের আপন ঘরে-ফেরার মতো। আশ্রমের মধ্যে একটি কৌমচেতনা— বলা যায় ‘রবীন্দ্রকৌম’— গড়ে ওঠে এই সময়।
১৯১৯ সালে পৌষমেলায় বাউলের আখড়ার উল্লেখ আছে। তার চেয়েও বড় কথা হল ওই বছর গো-পালন, কৃষিশিক্ষা ও স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সচেতন করে তোলার উদ্যোগ করা হয়। ওই বছরের ৩ জুলাই (১৮ আষাঢ় ১৩২৬) ‘বিশ্বভারতী সংসদ’ গঠিত হয়; এবং আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন না হলেও বিশ্বভারতীর কাজকর্ম কার্যত ওই সময় থেকেই শুরু হয়ে যায়। এর ঠিক বছর তিনেক বাদে (১৯২২) প্রতিষ্ঠিত হবে ‘শ্রীনিকেতন’।
সুতরাং বিশ্বভারতী পর্বের সূচনালগ্নে সমাজ-সচেতনতামূলক এই দিকগুলির উপর বিশেষ দৃষ্টিপাত যথেষ্ট স্বাভাবিকই মনে হয়। ‘কলা-সঙ্গীতভবন’-ও প্রতিষ্ঠিত হয় ওই বছর। পরের বছর কলাভবনের ছাত্রদের চিত্রপ্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন কর্তৃপক্ষ। এই জন্যই পৌষ-উৎসব ও মেলার বিবর্তনের রূপরেখা বোঝার জন্য তার সমান্তরালে রাখা প্রয়োজন— এক দিকে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনার অভিমুখের রকমফেরের হিসাব, অন্য দিকে এই আশ্রম তথা বিশ্বভারতীর হয়ে-ওঠার নানা পর্ব-পর্বান্তরের নিশানচিহ্নগুলি।
পরিবেশ-সচেতনতা কতটা জরুরি, সে কালে তা রবীন্দ্রনাথের মতো খুব কম মানুষই জানতেন। বিশ্বভারতীও পরিবেশ-সচেতন প্রতিষ্ঠান। পরিবেশ-আইন মেনে চলতেও আমরা সবাই বাধ্য। কিন্তু আইন আর তার প্রয়োগের মধ্যে অন্য মানবিক দিকগুলি কী ভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায়; সেই গঠনমূলক শুভচিন্তার প্রত্যাশা করা ছাড়া আজ আর কোনও দিশাই চোখে পড়ছে না। শান্তিনিকেতনের কোনও রকম অবমাননা যেন আমাদের নিজেদের সঙ্কীর্ণতার কারণে না ঘটে— তা দেখা আমাদের সকলেরই দায়িত্ব।
লেখক বিশ্বভারতী বাংলা বিভাগের অধ্যাপক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy