Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

শতবর্ষেও সমান প্রাসঙ্গিক সঙ্গীতভবন

দুই বাংলার সংস্কৃতির মিলন ক্ষেত্র বিশ্বভারতীর এই সঙ্গীত ভবন। অবিভক্ত বাংলাতেও পূর্ববঙ্গের পড়ুয়ারা এখানে পাঠ নিতেন, আজও ও-পার বাংলার বহু ছাত্রছাত্রী সঙ্গীতভবনে পাঠ গ্রহণ করে থাকেন।

সঙ্গীতভবনে চলছে অনুষ্ঠানের মহড়া। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

সঙ্গীতভবনে চলছে অনুষ্ঠানের মহড়া। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

অনিন্দিতা রাউত
শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:৫৩
Share: Save:

এক ছাদের তলায় বিভিন্ন সঙ্গীত, নৃত্য কলা, নাট্যের মিলনমেলার ভাবনা এসেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে। সমাজ সভ্যতা, সমাজ সচেতনতা, সমাজ গঠন, সমাজ সংস্কৃতির একাধিক নজিরবিহীন ভাবনার অবদান বর্তায় রবীন্দ্রনাথের উপরে। গুরুদেবের এই সকল উৎকৃষ্টের অন্যতম হল সঙ্গীত ভবন প্রতিষ্ঠার চিন্তা। রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে আজও এই ভবন একই ভাবে প্রাসঙ্গিক ও সমাদৃত। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলির অন্যতম এই সঙ্গীত ভবন। এক ছাদের নীচে রবীন্দ্র সঙ্গীত, উচ্চাঙ্গসঙ্গীত, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, রবীন্দ্রনৃত্য, মণিপুরী নৃত্য, নাটক, রায়বেঁশে, কথাকলি, বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে সেতার, তবলা, এস্রাজ প্রভৃতি শেখার, চর্চা করার এবং গবেষণা করার সুযোগ রয়েছে এখানে। যা সত্যিই বিরল।

ইতিহাস বলে, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই সঙ্গীত ভবন। ১৯২১ সালে বিশ্বভারতীর আনুষ্ঠানিক ভাবে পথ চলা শুরু। আর সঙ্গীত ভবন ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। মরাঠি গায়ক ভীমরাও শাস্ত্রী, নকুলেশ্বর গোস্বামী, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত ভবন। প্রথম ৪ জন বালিকা ও ৮ জন বালক সহ মোট ১২ জন পড়ুয়াকে নিয়ে শুরু হয় পাঠদান। ১৯১৯ সালের ৩ জুলাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি ভাষণে বলেছিলেন, ‘‘এই ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানটি অমৃতের ভাণ্ডার থেকে অমৃত নিয়ে এসেছে। এ তাকেও বাঁচিয়ে রাখবে, বাড়াবে। আমাদেরও বাঁচিয়ে রাখবে, বাড়াবে।’’

দূরদর্শী গুরুদেবের এই শব্দগুলির প্রতিটি অক্ষর সঙ্গীত ভবনকে আজও ঋদ্ধ করে। বিশ্বভারতীকে বিশ্বের দরবারে বারবার তুলে ধরেছে এই ভবন।

ভবনের সূচনার সময় থেকে সে কালে এই ভবনকে তুলে ধরেছেন প্রখ্যাত রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাত মুখোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ভীমরাও শাস্ত্রী, শান্তিদেব ঘোষ, সুচিত্রা মিত্র, ইন্দিরাদেবী চৌধুরানী, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, নীলিমা সেন, মমতা শঙ্কর প্রমুখ। তাঁরা তাদের জীবনীতেও সঙ্গীত ভবনের বহু কীর্তি, স্মৃতি তুলে ধরেছেন। বর্তমান পর্যন্ত যাঁরা এই ভবনকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেন বা ধরেছেন, তাঁদের অন্যতম হলেন, মোহন সিংহ খাঙ্গুরা, জিতেন সিংহ, বিক্রম সিংহ, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা প্রমুখ।

সেই সময়েও গুরুদেবের লেখা গান, নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্যগুলিকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হত। বহু বিদেশি পড়ুয়া আকৃষ্ট হয়ে সঙ্গীতভবনে পাঠ নিতেন। বর্তমানেও সেই প্রথা বজায় রেখেই রবীন্দ্রনাথের রচনাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়। এখনও বহু বিদেশি পড়ুয়া রয়েছেন সঙ্গীত ভবনে। সূচনার সময় থেকেই বিশ্বভারতীর বসন্ত উৎসবে সঙ্গীত ভবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। এ ছাড়া, কবিপ্রয়াণ, হলকর্ষণ, বর্ষবরণ, বর্ষামঙ্গল প্রভৃতি অনুষ্ঠানেও অংশ নেন এই ভবনের পড়ুয়ারা। একটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। আরও তাৎপর্যপূর্ণ যেটা, তা হল, সূচনার সময় থেকে গুরুদেবের রচনার ভিত্তিতে যে সমস্ত নৃত্য, সঙ্গীত পরিবেশিত হত, তার পোশাক বৈচিত্র, ধরন, কলাকুশলী যেমন ছিল বর্তমানেও তার বিশেষ কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। এমনকি, সঙ্গীত, নৃত্যের মাধুর্যের ধারাও অব্যাহত।

গুরুদেবের স্নেহভাজন ছাত্রী ছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তীতে তিনি সঙ্গীত জগতে প্রখ্যাত হয়ে ওঠেন। ‘কণিকা’ নামটিও গুরুদেবেরও দেওয়া। একটি লেখায় কণিকা উল্লেখ করেছেন, ‘‘ততদিনে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক যেন কত সহজ। আজ জানি, তখনই তিনি অন্যদের কাছ কত মহান, কত বিরাট, বিশাল।’’

রবীন্দ্রনাথের পাশে থাকা সেই সময়ের পড়ুয়ারা রবীন্দ্র ভবনকে বিশ্বের দরবারে তুলেছেন বারবার— এ কথা অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৃত্যনাট্য শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা, চণ্ডালিকা, শ্রাবণগাথা প্রভৃতিতে মণিপুরী-সহ অন্যান্য নৃত্যের ভঙ্গি সুকৌশলে রোপণ করেছিলেন গুরুদেব স্বয়ং। সেই সৃষ্টি আজও সমান্তরাল।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, দুই বাংলার সংস্কৃতির মিলন ক্ষেত্র বিশ্বভারতীর এই সঙ্গীত ভবন। অবিভক্ত বাংলাতেও পূর্ববঙ্গের পড়ুয়ারা এখানে পাঠ নিতেন, আজও ও-পার বাংলার বহু ছাত্রছাত্রী সঙ্গীতভবনে পাঠ গ্রহণ করে থাকেন। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন, সংস্কৃতির আদান প্রদানের অন্যতম ‘করিডর’ বিশ্বভারতীর সঙ্গীত ভবন। বাংলাদেশ ছাড়াও, শ্রীলঙ্কা, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, চিন, তাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের পড়ুয়ারাও বর্তমানে এখানে পাঠরত।

তবে বিতর্ক ছিল কিছু। যদিও, তা স্বল্প দৈর্ঘ্যের। ১৯৫১ সালে ভারতের কপিরাইট আইন অনুযায়ী ২০০১ সাল পর্যন্ত ভারতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশ করতে গেলে বিশ্বভারতীর সঙ্গীত সমিতির অনুমোদন প্রয়োজন হত। ১৯৫৭ সালে এই সমিতি দেবব্রত বিশ্বাসের ‘তুমি রবে নীরবে’ গানটি অনুমোদনে অস্বীকার করে। পরে কবির স্নেহধন্য শান্তিদেব ঘোষের হস্তক্ষেপে তা প্রকাশিত হয়। একই ভাবে ১৯৬৮, ’৭১ সালে এই গান প্রকাশ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। কিন্তু, পরেই পরেই সেই সব বিতর্কের অবসান ঘটে।

এটাও ঘটনা, ১৯৩৭ সাল থেকে বাংলা চলচ্চিত্রে ব্যবহার হতে শুরু করে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নৃত্য। এই ক্ষেত্রেও সঙ্গীত ভবন ও তৎকালীন শিল্পীরা বড় ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী কালে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁদের বহু চলচ্চিত্রে রবীন্দ্র নৃত্য, সঙ্গীতের ব্যবহার করেছেন। এই সকল বিষয়ে বহু ভাবে সমাদৃত হয়েছে বিশ্বভারতীর সঙ্গীত ভবন। শতবর্ষ পরেও একই ভাবে নিজের ধারা, চর্চা, শৈলী, কীর্তি বজায় রেখে দেশে বিদেশে সমান প্রাসঙ্গিক সঙ্গীত ভবন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু স্মৃতিবিজড়িত, আদর্শ, সংস্পর্শ মিশ্রিত ভবনটি আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বভারতীর ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।

(লেখক বিশ্বভারতীর সঙ্গীত ভবনের ছাত্রী, মতামত নিজস্ব)

অন্য বিষয়গুলি:

Biswa Bharati Sangeet Bhavan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy