Advertisement
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
ফল ফলাবার আশায়
Mukul Roy

জল্পনা উস্কে দেওয়া কি আসলে সুচিন্তিত পদক্ষেপ

সাদা চোখে যেটা দেখা গিয়েছে, আগে সেটুকুই ধরা যাক। বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে দলীয় আলোচনার ডাক পেয়ে মুকুল রায় বিজেপির অন্য রাজ্য নেতাদের মতোই গত সপ্তাহে বুধবার দিল্লি গেলেন।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২০ ০০:৩৮
Share: Save:

আবার গুঞ্জনে মুকুল রায়। তাঁকে নিয়ে এমনটা যে মাঝেমধ্যে হয় না, তা নয়। কিন্তু এ বার চরিত্র একটু ভিন্ন এবং মাত্রাও বহুমুখী। বাস্তবে ফল কতটা কী ফলবে, এখনই বলার সময় আসেনি। তবে মুকুলের এখনকার কিছু কথা ও কার্যকলাপ ঘিরে বিজেপি এবং তৃণমূল দু’পক্ষেই নতুন ভাবনার উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষত, ভোট যখন রাজ্যের দরজায় এসে পড়েছে, তখন মুকুলের মতো দুই শিবিরেই ঘর করা বড় মাপের নেতার নড়াচড়া আলোচনার বিষয় হতে বাধ্য। ফলে তাঁকে ঘিরে এখনকার জল্পনায় রাজনীতি আপাতত খানিক আন্দোলিত।

তবে তার পিছনে মুকুলের একেবারে কোনও ভূমিকা নেই, সেটা বোধ হয় বলা যাবে না। বস্তুত কুশলী রাজনীতিকরা অনেক ক্ষেত্রে যা বলেন, তা বোঝান না! আবার যা করেন, তা বলেন না। রাস্তার নানা দিক খোলা থাকলে ঢোকা-বেরনোর সুবিধা বিস্তর। অনেক সময় সেই পরিসর তাঁদের প্রয়োজন হয়। এটা চিরকালের কৌশল।

সাদা চোখে যেটা দেখা গিয়েছে, আগে সেটুকুই ধরা যাক। বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে দলীয় আলোচনার ডাক পেয়ে মুকুল রায় বিজেপির অন্য রাজ্য নেতাদের মতোই গত সপ্তাহে বুধবার দিল্লি গেলেন। ওই দিনই কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের বাড়িতে বৈঠকে অন্যদের সঙ্গে তিনিও যোগ দিলেন। বৈঠক থেকে বেরিয়ে গেলেন অন্যদের আগে। পর দিন কোনও বৈঠকেই গেলেন না। বরং অবিলম্বে চোখের জরুরি চিকিৎসার দরকার বলে শুক্রবার সকালে ফিরে এলেন কলকাতায়। যদিও চিকিৎসা প্রক্রিয়া শুরু হল সোমবার, অর্থাৎ আরও তিন দিন পরে।

মুকুল অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন, ওখানে জেলাভিত্তিক আলোচনায় তাঁর থাকার প্রয়োজন ছিল বলে তিনি মনে করেন না। কিন্তু ভোট-প্রস্তুতির ক্ষেত্রে কোনও দলের সাংগঠনিক অবস্থা বোঝার জন্য জেলাগুলি সম্পর্কে পর্যালোচনার গুরুত্ব কী, দীর্ঘ দিন তৃণমূলে ভোট সামলে আসা মুকুলের তা না-জানার কথা নয়। তাই যে বৈঠকে কৈলাস, শিবপ্রকাশ, অরবিন্দ মেননের মতো কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থাকেন, সেখানে মুকুলের এই হঠাৎ সিদ্ধান্ত জল্পনায় ইন্ধন দেবেই। মুকুল রায় কি তবে ভেবেচিন্তেই এটা করলেন?

প্রশ্নটা উড়িয়ে দেওয়ার নয়। এ-ও ভাবার বিষয়— তিনি এমন করলেন কেন? সেই আলোচনায় যাওয়ার অবসরে একটু ফিরে দেখা প্রাসঙ্গিক। তৃণমূল ছেড়ে মুকুল বিজেপিতে গিয়েছেন আড়াই বছর আগে। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনেও তিনি তৃণমূলের নেতা ছিলেন, নির্বাচনের কাজকর্ম করেছেন। তার পর কিছু কাল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে থেকে ২০১৭-র শেষ দিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিজেপির পতাকা হাতে নেন তিনি।

‘আনুষ্ঠানিক ভাবে’ কথাটি এ ক্ষেত্রে অর্থবহ। কারণ তার আগে থেকেই মমতার সঙ্গে একদা তাঁর দলের এই অন্যতম শীর্ষনেতার রাজনৈতিক ও মানসিক যোগাযোগ তলানিতে পৌঁছে গিয়েছিল। নেত্রী এবং দলের সঙ্গে তৈরি হয়েছিল যোজন দূরত্ব। পাশাপাশিই তৃণমূলে থাকাকালীন সারদা-তদন্তে সিবিআইয়ের ডাক পেয়ে মুকুল জেরার মুখোমুখি হন। সেখানে তিনি কী বলে এসেছিলেন, সেই ‘রহস্য’ আজও ঢাকা। অনাবৃত হওয়ার কথাও নয়। কিছু অনুমান বা আধা-খবর অবশ্য ঘুরে বেড়ায়, যা তৃণমূলের পক্ষে অস্বস্তিকর। বস্তুত সারদা মামলায় মুকুলের বিরুদ্ধে এখনও কোনও চার্জশিট নেই।

বিজেপিতেই বা মুকুলের অবস্থান কেমন? কাগজে-কলমে তিনি এখন দলের জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য হলেও রাজ্যদলে তাঁর জমি খুব শক্ত নয়। তবে রাজ্যের শাসক তৃণমূলে তাঁর পুরনো প্রতাপ এবং গুরুত্বকে মর্যাদা দিয়ে মুকুলকে অন্তত কেউ মুখের উপর অসম্মান করেন না।

তুলনায় দিল্লিতে বিজেপির শীর্ষনেতাদের সঙ্গে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুলের দহরম মহরম বেশি বলে শোনা যায়। তিনিও অনেকটা সময় দিল্লিতেই থাকতে পছন্দ করেন। রাজ্যসভার সদস্য-পদ (তৃণমূলের) চলে যাওয়ার পরেও সেখানে তাঁর সরকারি ঠিকানা আছে। কেন্দ্রের দেওয়া নিরাপত্তাও পান। শোনা যায়, নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহেরা নাকি মুকুলের সাংগঠনিক দক্ষতা, ভোট পরিচালনায় কুশলতা ইত্যাদির উপর আস্থা রাখেন।

অনেকের দাবি, গত লোকসভা ভোটে রাজ্যে আঠারোটি আসন জেতার পিছনে মুকুলের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বিশেষ অবদান আছে। আড়াল থেকে মুকুলই ছিলেন ওই ভোটের কুশলী। তাঁর পরামর্শে এগিয়েই বিজেপি এই ফল করেছে।

এই দাবি কতটা সঠিক, সেটা বিতর্কের বিষয়। কারণ বিজেপি-তে কান পাতলে এ কথাও শুনতে পাওয়া যায়, দলীয় সমীকরণে মুকুলের অতি ঘনিষ্ঠ কেন্দ্রীয় নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় লোকসভা ভোটে বাংলায় দলের ‘আশাতীত’ সাফল্যের পরে শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে মুকুলের জন্য কোনও বড় দায়িত্বের প্রস্তাব করেও বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। পদ্মের মুকুল এখনও ভাসমান!

তা হলে? তৃণমূল থেকে ঝরেছেন, পদ্মেও সে ভাবে ফুটে উঠতে পারেননি— এমন একটি অবস্থা কি মুকুলের মতো ভোট-পারদর্শী দক্ষ সংগঠকের পক্ষে আদৌ কাঙ্ক্ষিত হতে পারে? তাই মুখে তিনি যত ‘সন্তুষ্টি’র কথাই বলুন, মনে মনে বিজেপি সম্পর্কে ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ার কারণ তৈরি হওয়া মুকুলের মতো অতি সক্রিয় নেতার পক্ষে স্বাভাবিক।

সে ক্ষেত্রে আপাত ভাবে তাঁর সামনে কী কী পথ থাকতে পারে? এক: তাঁকে বিজেপিতেই মানিয়ে নিতে হবে। দুই: তিনি তৃণমূলে ফেরার চেষ্টা করবেন। তিন: নিজের ঘনিষ্ঠদের নিয়ে আলাদা কোনও মঞ্চ বা সংগঠন গড়ার কথা ভাববেন এবং ভোটের সময় অবস্থা বুঝে পদক্ষেপ করবেন।

এক এক করে সম্ভাবনাগুলি খতিয়ে দেখা যাক। শেষ থেকে শুরু করি। প্রথমত, মুকুল যদি মমতার আশ্রয়ে ফিরতেও পারেন, সেখানে রাতারাতি আগের গুরুত্ব ও শীর্ষস্থান পাবেন কি না, ঘোর সন্দেহের। সেটাও তাঁর পক্ষে অস্বস্তির হবে। বিশেষত, তৃণমূলে নবীন যুব প্রজন্ম যে ভাবে নেতৃত্বে উঠে আসছেন, মুকুলের পক্ষে সেটাও বিচার্য। রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। তবু ভুললে চলবে না, মুকুলের তৃণমূল-ত্যাগের পিছনে ‘নবীনের উত্থান’ একটি বড় বিষয় ছিল। সুযোগমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথ খুলে রেখে নিজের কোনও সংগঠন বা মঞ্চ গড়াও মুকুলের পক্ষে খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। আগেও সেই চেষ্টায় তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।

অতএব, বিজেপিতেই থেকে যাওয়া? প্রশ্ন সেখানেও। ধরা যাক, ভোট-দক্ষ মুকুলকে অমিত শাহ নির্বাচনের ভার দিলেন। সেখানে প্রার্থী বাছাইতে মুকুল বড় ভূমিকা নিতে চাইলে পাবেন তো? আর কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পেলেও বাংলার বাইরে বা কেন্দ্রীয় স্তরে তাঁকে কাজে লাগানো হতে পারে। কেন্দ্রে মন্ত্রী করে তাঁকে বাংলায় ছেড়ে দেওয়া হবে বলে তো মনে হয় না।

তা হলে কি তিনি সেটাই মানতে বাধ্য হবেন? বলা কঠিন। তবে মনে হচ্ছে, কুশলী চালে মুকুলও এ বার রাজ্য দলে নিজের ওজন বাড়িয়ে নিতে চাইবেন। তার কিছু আভাস মিলছে। যেমন, তাঁর দিল্লিতে বৈঠক না করে ফিরে আসা এবং তৃণমূলে যাওয়ার সম্ভাবনা হাওয়ায় উড়তেই অমিত শাহ তাঁকে ডেকেছেন। দিল্লিতে শাহের দরবারে মুকুলের পক্ষে সরব হয়েছেন বাংলার এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং রাজ্যসভার এক বাঙালি সাংসদ। এমনকি, দিল্লির বৈঠকে নজিরবিহীন ভাবে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে নিশানা করে গোষ্ঠীবাজির অভিযোগে তাঁকে বিতর্কিত করে তুলেছেন মুকুলের হাত ধরে বিজেপিতে যাওয়া এক সাংসদ।

বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলিকে এক সূত্রে গাঁথলে ভোটের আগে রাজ্য বিজেপিতে মুকুলের ‘অস্তিত্ব’ এ ভাবেই প্রকট হয়ে পড়ছে।

জল যে দিকেই গড়াক, সময়টা মুকুলের পক্ষে এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফল ফলাবার ‘সুযোগ’ও বটে!

অন্য বিষয়গুলি:

Mukul Roy TMC BJP Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy