দুনিয়ার ক্ষুধার্ত মানুষের হিসাব প্রকাশিত হয়েছে। প্রতি বছর হয়, আর প্রতি বার ভারতের স্থান কয়েক ধাপ নেমে যায়। এ বার আমরা ১১৭টি দেশের মধ্যে ১০২ নম্বরে। আমাদের উপরে আছে বাংলাদেশ, নেপাল মায় পাকিস্তান; আছে লাও, মালি, বুরকিনা ফাসো। পঁচিশ থেকে চল্লিশ ধাপ এগিয়ে আছে আমাদের স্মরণকালে বিধ্বস্ত হওয়া ভিয়েতনাম, ইরাক, কম্বোডিয়া। বিশ বছর আগের ‘অত্যন্ত ভয়াবহ’ (এক্সট্রিমলি অ্যালার্মিং) খাদ্যাভাব কমবেশি অর্ধেক কমিয়ে ভারতকে টেক্কা দিয়েছে ইথিয়োপিয়া, রোয়ান্ডা ও আঙ্গোলা; আমরা ঘাটতি কমিয়েছি মাত্র ৮ শতাংশ।
পাঁচ বছরের কমবয়সি ভারতীয় শিশুদের ২১ শতাংশের ওজনে ঘাটতি, ৩৮ শতাংশের উচ্চতায়। উচ্চতার ঘাটতি যদি মাথাপিছু এক ইঞ্চি ধরি, যোগফল হবে মুম্বই-আমদাবাদ বুলেট ট্রেনের যাত্রাপথের আড়াই গুণ। নিছক খাদ্যাভাব এই ঘাটতির একমাত্র কারণ নয়। সচ্ছল ঘরের সন্তানও অনুপযুক্ত খাদ্যের ফলে অপুষ্ট থাকে। রোগের, এবং রোগের হেতু দূষণের ফলে দেহ পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে না। যেমন শিশু-ডায়ারিয়া। তাতে আক্রান্ত হলে বাংলাদেশে ৭৭% শিশু চিনি-লবণজলের চিকিৎসা (ওআরএস) পায়, ভারতে পায় ৫১%।
শেষ পরিসংখ্যানটা আছে বিশ্বের শিশুদের নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের বাৎসরিক সমীক্ষায়। এ বার সেই সমীক্ষার প্রধান বিষয় খাদ্য ও পুষ্টি। ভারতের শিশুদের দুর্দশা সেখানে আরও বিশদ ভাবে ফুটে উঠেছে: সব ক’টি মানদণ্ডে বাংলাদেশ ও নেপাল, ও কয়েকটিতে পাকিস্তান, আমাদের চেয়ে এগিয়ে। ভারতীয় শিশুদের ৮ শতাংশের ওজন গুরুতর ভাবে কম, পাকিস্তানে ২%। ছয় মাস থেকে দু’বছর বয়সের মাত্র ৩৬% ভারতীয় বাচ্চা দিনে যথেষ্ট বার খেতে পায়; নেপালে পায় ৭১%, বাংলাদেশে ৬৪%, পাকিস্তানে ৬৩%। খাদ্যে অত্যাবশ্যক আটটি উপাদানের মধ্যে অন্তত পাঁচটি পায় ভারতে ওই বয়সের ২০% শিশু, নেপালে ৪৫%। ফল বা সবজি খেতে পায় না ভারতে ৫৫%। নোবেলজয়ী কৈলাস সত্যার্থীর একটা কথা মনে পড়ছে। কিছু শিশু দাস-শ্রমিককে তিনি কলা খেতে দেন। চমৎকৃত হয়ে বোঝেন, খাওয়া দূরে থাক, তারা কোনওদিন কলা চোখে দেখেনি, খোসা ছাড়িয়ে খেতে হয় জানে না।
দেশে জাতীয়তাবাদের জোয়ার। নেতা নাগরিক মায় প্রবাসীদের সাফল্যে আমরা উদ্বাহু। সেটা দোষের নয়; কিন্তু সে-ক্ষেত্রে সমান দায় বর্তায় জাতীয় লজ্জা ও ব্যর্থতা নিয়ে সরব উদ্বেগের, সীমান্তযুদ্ধের সমান তৎপরতায় যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে তার প্রতিকারের। অস্ত্রে যাদের পরাস্ত করছি, শিশুকল্যাণে যেন তাদের কাছে হেরে না যাই।
এই লজ্জা ও উদ্বেগের লেশমাত্র সমাজে দেখা যাচ্ছে না, আলোড়ন বা ধিক্কার দূরে থাক। উপরোক্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর আনন্দবাজারের মতো কয়েকটি কাগজে সম্পাদকীয় বেরিয়েছে, একটি ইংরেজি টিভি চ্যানেলে এক ঘণ্টার আলোচনা দেখেছি। কোনও বাংলা চ্যানেলে নিছক হেডলাইন হিসাবেও ঘোষিত হয়েছে কি? চ্যানেলগুলির দোষ নেই। তাদের প্রধান দর্শক ও বিজ্ঞাপনভোক্তা— আমরা, যাদের বাচ্চারা খেতে পায়, নিজেরাও ভালমন্দ চেখে থাকি— চেতনা থেকে খবরটা বেমালুম মুছে দিয়েছি বা ঢুকতেই দিইনি। আমরা বলতে পারতাম, দেশের কয়েক কোটি শিশুর দুর্দশায় আমাদের মনুষ্যত্বহানি হচ্ছে, এই বঞ্চনা আর বৈষম্য সভ্যসমাজের কলঙ্ক। নীতিবাগীশ না হতে চাই, বলতে পারতাম এতে বিশ্বের চোখে আমাদের মাথা হেঁট হচ্ছে। বিদেশি নেতাদের সঙ্গে শত আলিঙ্গনে তা শোধরাবার নয়; পাঁচ-ছয়-সাত শতাংশ বৃদ্ধির হার, বুলেট ট্রেন বা অতিকায় মূর্তি বৈষম্যটাকে আরও অশ্লীল মাত্রা দিচ্ছে। না-হয় আবেগাপ্লুত হয়ে বলতাম, এত অভাবী শিশুর দেশে নিজের সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে হাত সরছে না। যারা পুজো-আর্চা তাগা-তাবিজ মানি, বলতে পারতাম এতে সন্তানদের শাপ লাগছে।
এর কিছুই আমরা বলিনি, কারণ এমনটা ভাবা আমাদের মজ্জায় নেই। দেশের ভার যাদের হাতেই তুলে দিই, এই সব নিয়ে তাদের কাছে আমাদের কোনও প্রত্যাশা থাকে না। যদি তারা অবিশ্বাস্য ভাবে নিজে থেকে কোনও উদ্যোগ করত, আপদ ভেবে শঙ্কিত হতাম, করবৃদ্ধির জুজু দেখতাম। স্বদেশবাসীর খিদে মেটাতে শিক্ষিত শ্রেণি উদাসীন হলে শাসকগোষ্ঠীও নিরুদ্যম হবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই, তাদের রাজনৈতিক হিসাব নির্ভুল।
কিছু সরকারি পদক্ষেপ বরাবর করা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। স্বচ্ছ ভারত অভিযান, বা পরিস্রুত জলের নতুন কেন্দ্রীয় প্রকল্প, নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্য অতএব পুষ্টিগ্রহণে উন্নতি আনবে। সহস্র ছিদ্র সত্ত্বেও এই উদ্যোগগুলির বিপুল গুরুত্ব— শুধু প্রত্যক্ষ উপকারে নয়, সামাজিক তাৎপর্যে। বুভুক্ষু শিশুর পেটের জ্বালা কিন্তু তাতে মিটবে না, সে জন্য চাই সরাসরি ব্যবস্থা। তার দশা কেমন?
‘পোষণ অভিযান’-এর কথা আমরা বড় শুনি না, যদিও তিন বছরের এই প্রকল্পটি তৃতীয় বর্ষে পড়েছে। সর্বভারতীয় বিচারে বড় প্রকল্প নয়, ৯০০০ কোটির। অর্ধেক দেবে বিশ্বব্যাঙ্ক, কিছুটা রাজ্য সরকারগুলি। কেন্দ্রের ভাগ ২,৮৫০ কোটি— সর্দার পটেলের ‘সংহতিমূর্তি’র খরচের চেয়ে ১৪০ কোটি কম। সেটুকু পুষ্টিই না-হয় বাচ্চাগুলোর পেটে যেত। সে গুড়েও কিন্তু বালি, কারণ একটা পয়সাও খাদ্য জোগাতে খরচ হচ্ছে না। খানিক যাচ্ছে কর্মী-প্রশিক্ষণে; বাকিটা সমীক্ষা করে, কম্পিউটার বসিয়ে, সঠিক খাদ্যের মহিমা প্রচারে সভা উৎসব অনুষ্ঠানে।
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন; কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, খাবারটা আসবে কোথা থেকে? উত্তর: প্রচলিত সূত্র থেকে। তার একটা গণবণ্টন অর্থাৎ রেশন ব্যবস্থা। আধার-বিভ্রাটে কিছু শিশু ও বৃদ্ধ রেশনের চালে বঞ্চিত হয়ে অনাহারে মারা গিয়েছে। (সরকারি বয়ানে অবশ্যই অসুখে— অপুষ্ট শরীরে রোগ জেঁকে বসে।) কত জন অর্ধাহারে আছে, সে হিসাবের প্রশ্নই ওঠে না। তবু গণবণ্টন ব্যবস্থার কল্যাণে দেশভর গরিব মানুষ দুটো চাল-গম পাচ্ছেন। এটুকুতে শিশু বা বয়স্ক কারও উপযুক্ত পুষ্টি জুটবে না বলা বাহুল্য। শিশুদের আছে আর দু’টি সহায়: খুব ছোটদের জন্য সংহত শিশুবিকাশ বা অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প, একটু বড়দের জন্য মিড-ডে মিল। সেগুলির অবস্থা কী?
বর্তমান শাসক দল ক্ষমতায় এসে ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে অঙ্গনওয়াড়ির বরাদ্দ অর্ধেক ছাঁটতে চেয়েছিল, সীমিত করতে চেয়েছিল কিছু জেলায়। প্রবল আপত্তিতে পিছু হটলেও বরাদ্দ কমেছিল ৬%, পরের বছর আরও ১০%। তার পর অল্পবিস্তর বেড়েছে, অবশেষে এ বছর ১১%। মোট বরাদ্দের অর্ধেকটাই পুষ্টি বাবদ: সকাল-দুপুরের খাবারে মাথাপিছু ব্যয় এত দিনে বেড়ে ৮ টাকা, বিশেষ অপুষ্টির মোকাবিলায় ১২ টাকা। ২০১৫-১৬ সালে দেখা গেল, মাত্র ৪৮% শিশু অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের খাবার পাচ্ছে; ২০১৪ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে সংখ্যাটা কমেছে ১৭%। স্বাস্থ্য ও দৈহিক বিকাশে শোচনীয় অধোগতির এটা মূল ব্যাখ্যা। জনসংখ্যা-বৃদ্ধির হার কমায় ওই বয়সের শিশুর সংখ্যা কমেছে ঠিকই, কিন্তু তাতে হিসাব মিলবে না।
(চলবে)
লেখক: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের এমেরিটাস অধ্যাপক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy