চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং
গড়পড়তা চিনাদের তুলনায় তাঁর উচ্চতা কয়েক ইঞ্চি বেশিই। তবে তাঁর ছাতির মাপ নিয়ে কোনও চৈনিক লোকগাথা নেই! স্বভাবশান্ত, মিতভাষী। মুখে হাসি আঁকা থাকে। কিন্তু কখনওই আকর্ণ নয়। ওই হাসির পিছনে মাপা অঙ্ক রয়েছে চিনের এই আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট, সে দেশের কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান, চিনা কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি শি চিনফিং-এর।
শুধু শুকনো অঙ্কই নয়। কিছুটা হয়তো ইন্দ্রজালও। যাঁর দ্বৈত প্রভাবে বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তি এখন চিন। ড্রাগনের নিঃশ্বাসে ত্রাহি ত্রাহি করছে দিল্লির সাউথ ব্লক। অথচ, ‘এমন ছিল না আষাঢ় শেষের বেলা’! অন্তত প্রথম বার প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসার সময় নরেন্দ্র মোদী আন্দাজও করতে পারেননি, চিন নিয়ে এহেন কালবেলা ঘনাতে পারে তাঁর সরকারের। সবরমতী নদীর ধারে শি-এর সঙ্গে দোলনমায়ায় তখন আচ্ছন্ন ছিল সাউথ ব্লক। এতটাই যে, শি-র সেই আমদাবাদ সফরের সময়ই (সেপ্টেম্বর, ২০১৪) লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘন করে চিনা আগ্রাসন ঘটলেও শি-র কূটনৈতিক সৌজন্যে মুগ্ধ থেকেছে নয়াদিল্লি। কারণ ওই ঘটনা নিয়ে মোদী শি-কে অনুযোগ জানালে, লজ্জাবনত শি বলেছিলেন, পিপলস লিবারেশন আর্মির কিছু ‘পচা অংশ’ তাঁর সফরকে ভেস্তে দেওয়ার জন্যই এই কাজ করেছে! যেন লালফৌজের কাজকম্মে তিনি ঘোর বিরক্ত!
২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর চিনের ভারতনীতি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন শি। অন্তত এক ডজন বৈঠক করেছেন মোদীর সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। প্রায় প্রতিটি বৈঠকের পর, মাপা হাসি হেসে বলেছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এক ‘ঐতিহাসিক উচ্চতায়’ নিয়ে যাওয়াটাই তাঁর মিশন। তিনি চান, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ‘নতুন অধ্যায়’ গড়তে, ‘অন্য পথ’ খুঁজতে। উহানের মনোরম লেকে নৌকাবিহার বা মমল্লপুরমের যুগবাহিত স্থাপত্যের প্রেক্ষাপটে শি এবং মোদীর ঘরোয়া সংলাপকে তত ক্ষণে সম্পর্কের এক নতুন মডেল হিসাবে আখ্যা দিয়েছে নয়াদিল্লি। ততটা উচ্চকিত না হলেও, বাহ্যত সুর কাটতে দেননি শি। কিন্তু মৈত্রীর এই ছবি-কূটনীতির আড়ালে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মলদ্বীপের মত ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির ভারত-বিরোধিতার সুপ্ত বীজে প্রয়োজনীয় জল ও সারও দিয়ে গিয়েছেন। অভিজাত পরমাণু ক্লাব এনএসজি-তে ভারতের অন্তর্ভুক্তি আটকেছেন বারবার। পাকিস্তানকে তালুবন্দি করে, ভারতের উদ্বেগে কর্ণপাত না করে প্রস্তুতি নিয়েছেন চিন-পাক বাণিজ্যিক করিডর বা সিপিইসি গড়ার। হইহই করে ভারতের বাজারে ঢুকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের দাঁড়িপাল্লায় ক্রমশ নিজেদের বাটখারা ভারী করেছেন। হাজার উপরোধেও ভারতীয় পণ্যের জন্য হাট করে খোলেননি নিজেদের দরজা। আজ জল গলা পর্যন্ত উঠে আসার পর, কূটনীতিকদের একাংশ একান্তে বলছেন, গোড়া থেকেই সম্মোহিত করার জন্য মেড ইন চায়না জাল বিছানো হয়েছিল। গোটাটাই ছিল একটা বুদ্ধিদীপ্ত ফাঁদ।
শি চিনফিং নামক বইটি আসলে প্রথম থেকেই আরও ভাল করে পড়া উচিত ছিল প্রধানমন্ত্রীর কূটনৈতিক পরামর্শদাতাদের। চিনা কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তাঁর বাবা শি ঝংশুন সে দেশের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় মাও জে দং-এর রোষানলে পড়ে গ্রেফতার হন। চিনের উত্তরে লিয়াংঝিহে গ্রামে এক গুহায় কার্যত নির্বাসিত হন টিনএজার চিনফিং। কৃষিকাজ শিখে শহরের মানুষকে প্রশিক্ষিত করার কাজ তাঁর উপরে বর্তায়। সে সময় পার্টিতে কোনও বন্ধু ছিল না তাঁর। কিন্তু বিদ্রোহের পথে না গিয়ে অপেক্ষা করেছেন, ফিরে আসার। পরে শি জানিয়েছেন, খড়ের বিছানায় শুয়ে বছরের পর বছর তিনি রাতে স্বপ্ন দেখতেন আর দিনে প্রাণপণ পার্টির দেওয়া কাজ করতেন মুখ বুজে। যে কমিউনিস্ট পার্টি তাঁর বাবাকে শাস্তি দিয়েছিল, মাথা গুঁজে পড়ে থেকে, নীরবে কাজ করে গিয়ে এক সময় তারই শীর্ষে পৌঁছলেন। এতটাই ক্ষমতার অধীশ্বর হলেন যে তাঁর পিতার সঙ্গে বৈরিতায় জড়িয়ে পড়া পুরনো কমিউনিস্ট নেতৃত্বকে কার্যত পকেটে পুরে ফেললেন। তার পর, চিনের ইতিহাসে কখনও যা ঘটেনি সেটাই ঘটালেন তিনি। চিনের প্রেসিডেন্ট পদের সময়সীমা মুছে দিয়ে আজীবন পদ নিজের দখলে নিয়ে এলেন। গোটা বিশ্বকে পদানত করার বাসনা তাঁর। আমেরিকাকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলে নিজের দেশকেও তুলে নিয়ে গেলেন ঈর্ষণীয় শীর্ষ-মেরুতে। কখন, কী ভাবে করলেন তা সবাই দেখতে পেল, কিন্তু প্রতিরোধ করতে পারল না। বিরাট হাঁকডাক করে নয়। মাপা অঙ্ক, ভিতরে প্রবল আগ্রাসী সত্তাকে পালন করা এবং কূটনৈতিক সম্মোহনী শক্তির মিশেলে কাজটা হল।
এ দিকে, এই ধাঁধার সমাধান করতে অনেকটাই দেরি হয়ে গেল সাউথ ব্লকের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy