২০০৬ সালে ‘মি টু’ আন্দোলন শুরু করেন নারীবাদী তারানা বার্ক। ২০১৭-য় হলিউড প্রযোজক হার্ভি ওয়াইনস্টিনের বিরুদ্ধে একাধিক যৌন হেনস্থার অভিযোগ প্রকাশিত হয়। তার পরই এই আন্দোলন সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘#মিটু’ নামে ভাইরাল হয়ে যায়। পৃথিবী জুড়ে মহিলারা এই হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে চাবুকটা পালটা ছুড়ে মারেন যৌন নির্যাতনকারীর দিকে। নিজেদের হেনস্থার কথা জানান, উগরে দেন রাগ আর যন্ত্রণা। অনেকেই হেনস্থাকারীর নাম প্রকাশ্যে আনেন। সাধারণত, হেনস্থাকারীর নাম বললেই সমাজ নারীকেই নিপীড়ন করে। কিন্তু ‘#মিটু’ আন্দোলনকারীরা সেই পিতৃতান্ত্রিক চোখরাঙানির তোয়াক্কা না করে বহু মুখোশ খুলে দেন।
ওয়াইনস্টিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়েই ‘মি টু’-র পুনরুত্থান। ওয়াইনস্টিন ধনী, বিখ্যাত ও শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। কুকীর্তিতে মদত জোগাবার সব সামাজিক ঢাল তাঁর নাগালে। তাই এই আন্দোলনে জমা হওয়া সব ঘৃণা আছড়ে পড়ে তাঁর উপর, অন্যায়ের প্রতীক রূপে চিহ্নিত হন তিনি। দু’ বছরের আইনি টানাপড়েনের পর গত মাসে ওয়াইনস্টিন দোষী সাব্যস্ত হন। তার পরই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিউ ইয়র্কের নামী হাসপাতালে সামান্য চিকিৎসার পর তাঁর ২৩ বছরের জেল হয়। ওয়াইনস্টিনের বিকৃতির শিকার যাঁরা, এই কারাদণ্ডে কি তাঁরা প্রকৃত ন্যায়বিচার পেলেন?
নারী ও যৌন হেনস্থার ভুক্তভোগী হিসাবে, ‘মি টু’ আন্দোলনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আবেগ জড়িয়ে। তবুও ওয়াইনস্টিনের কারাদণ্ড আমার মনে তেমন দাগ কাটেনি। তাঁর নির্যাতন এই নারীদের জীবনে মানসিক, আর্থিক ও বহুবিধ ক্ষত তৈরি করেছে, কারাদণ্ডে সে সব নিরাময় সম্ভব নয়। নির্যাতনের অন্ধকার যাঁরা সয়েছেন, তাঁদের বিচার দেওয়া, তাঁদের যন্ত্রণার উপশমই এই আন্দোলনের মূল উপজীব্য। এই লোকটিকে ঘৃণ্যতম চরিত্রে পর্যবসিত করে, তাঁর কারাদণ্ড সুনিশ্চিত করে কি ‘মি টু’-র এই উদ্দেশ্য যথাযথ ভাবে পূরণ হয়? না কি, এই শাস্তিও সেই উপশমবোধের, বা এক ধরনের প্রতিশোধপরায়ণ পরিতুষ্টির প্রতীকমাত্র?
১১ মার্চ ওয়াইনস্টিনকে নিউ ইয়র্কের রাইকার্স কারাগারে পাঠানো হয়। তখন আমেরিকা করোনা নিয়ে ভয় পেতে শুরু করেছে। সেই সঙ্কটের অভিঘাতেই হয়তো ওয়াইনস্টিনের রায়ে নির্লিপ্ত ছিলাম। তবে টালমাটাল সময়ই তো সমাজে পরিবর্তনের ঢেউ আনে। দেশ এই রোগে ছেয়ে যাচ্ছে আর শিরোনামে উঠে এসেছে রাইকার্স জেল। বন্দিরা গাদাগাদি করে থাকে। সংক্রমণের আঁতুড়। সামাজিক দূরত্বের উপায় নেই, চিকিৎসা নেই, এক টুকরো সাবানও মেলে না। মৃত্যুদণ্ডবিরোধীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৩ লক্ষ বন্দিরই মুক্তির দাবি করছেন। তাঁরা মার্কিন কারাব্যবস্থার অবলুপ্তি চান। বর্ণবৈষম্যমূলক এই নীতিতে কাঠগড়ায় কৃষ্ণাঙ্গদের অনুপাত আশ্চর্য বেশি। মহামারি পরিস্থিতিতে দাবি প্রবলতর হয়েছে। কারণ, কারাগারের অব্যবস্থার মধ্যে রাখলে, সকলকেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
ওয়াইনস্টিনকে রাইকার্সে পাঠানোর পর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় তিনি কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত (পরে খবরটি ভুয়ো বলে দাবি করা হয়েছে)। তখন অনেকে বলেছিলেন, যেমন কর্ম তেমন ফল। বিরক্ত লেগেছিল।
ওয়াইনস্টিনের এই রোগলক্ষণে মার্কিনি কারাব্যবস্থার ভগ্নস্বাস্থ্য দশাই প্রকট। ওয়াইনস্টিনের থেকে বহু মাত্রায় বঞ্চিত ও প্রান্তিক শ্রেণির মানুষই অবিচারের ফাঁদে পড়েন। ওয়াইনস্টিনকে তো দুঃসময় আসতেই আপ-স্টেট নিউ ইয়র্ক-এর কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাইকার্স দ্বীপের জেলের দু’শোর বেশি বন্দি ও দু’শোর বেশি কারাকর্মী করোনা-আক্রান্ত। শতকরা হিসেবে খাস নিউ ইয়র্ক এবং বিশ্বের যে কোনও দেশের চেয়ে ঢের বেশি। সামাজিক দূরত্ব চাইলে, জেলের ভিড় ডর্মিটরিতে এক জনের পায়ের পাশে অন্য জনের মাথা করে শোওয়ার নিদান দেওয়া হয়েছে। কারাকুঠুরিতে ৪০ জন পর্যন্ত ঠাসাঠাসি করে থাকেন। মৃত্যুদণ্ডবিরোধী নারীবাদী আঞ্জেলা ওয়াই ডেভিসের কথায়, “রাইকার্স বন্ধের উপযুক্ত সময় এখন।” কুখ্যাত এই কারাগারে আমেরিকার ‘প্রিজ়ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স’-এর অমানবিক চেহারাটা স্পষ্ট।
এই ‘প্রিজ়ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স’-এর পরিচালক ঘোর পিতৃতান্ত্রিক এবং পুঁজিবাদী মানসিকতা। এই প্রতিষ্ঠান হিংস্র, নির্মম, লাভের জন্য লালায়িত। অহরহ ‘অভিসন্ধিমূলক’ শাস্তি দেওয়া হয়। অপরাধীকে বন্দিদশায় পিষে মারাই যেন উদ্দেশ্য (ওয়াইনস্টিনের বয়স ৬৮, কারাদণ্ড হয়েছে ২৩ বছরের)। যে হিংসা ও পুরুষকারের অশুভ বাতাবরণ এই নির্যাতনকারীদের লালন করেছে, এই কারাব্যবস্থার প্রতিটি শিকড়ে সেই হিংসার সংস্কৃতিরই নিগড়।
আজ অতিমারির প্রকোপে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। প্রচলিত বিশ্বাস ও স্থিতাবস্থাকে ঘিরে উঠছে প্রশ্ন। যৌন নির্যাতনের ন্যায়বিচারের আদর্শ পরিণাম অপরাধীর কারাদণ্ড— এই কারাদণ্ডপন্থী উদারনৈতিক নারীবাদী ভাবধারাটি নিয়েও আলোচনা প্রয়োজন। মনে পড়ে, সমাজকর্মী সংগঠক মারিয়াম কাবার উক্তি— “কারাগার নারীবাদী নয়।” ওয়াইনস্টিনের জেলে যাওয়ার আগের দিন মিশিগানে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রাথমিক নির্বাচন ছিল। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে মনোনয়নের সেই নির্বাচনে জো বাইডেন বার্নি স্যান্ডার্সকে পিছনে ফেলে প্রার্থী হওয়ার পথে এগিয়ে গেলেন। আমি তো নিজেও নির্যাতনের গহ্বরটা পেরিয়েছি। ঠিক ওয়াইনস্টিনের কারাদণ্ড নিয়ে নয়, আমি সে দিন ভাবছিলাম যৌন হেনস্থা বিষয়ে। বমির উদ্রেক হচ্ছিল। কারণ, নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়বেন দুই ক্ষমতাশালী শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, ট্রাম্প ও বাইডেন। দু’জনের বিরুদ্ধেই যৌন নির্যাতনের অভিযোগের পাহাড়!
আমি ভুক্তভোগী, আমি, যাকে বলে, ‘সারভাইভার’। যে সংস্কৃতি ভুক্তভোগীদের কণ্ঠস্বরকে হেলায় অগ্রাহ্য করে, আমি সেই সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন চাই। ক্ষমতাশালী শ্বেতাঙ্গ পুরুষের কারাবাসে তা হওয়ার নয়।
পদার্থবিদ্যা বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy