ছবি: সংগৃহীত
ভারতে আধুনিক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার প্রবেশ উনিশ শতকের গোড়ায়। সেই ঔপনিবেশিক আধুনিকতার তাৎপর্য অনস্বীকার্য— কেবল সেই ব্যবস্থা যা করেছে তার জন্য নয়, যা করেনি তার জন্যও বটে। কী করেনি ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা? ভারতের সমাজব্যবস্থাকে প্রশ্ন করেনি, তার ভিতরকার বৈষম্যকে দূর করেনি— শ্রেণি, বর্ণ, জাতি, কোনও বিভাজিকাকেই সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি। বরং সেই চূড়ান্ত বৈষম্যমূলক প্রাচীনমুখী কাঠামোর ওপর আধুনিক শিক্ষাকে স্থাপন করেছে। ফলে, সামাজিক পরিসরের ভেদাভেদের প্রকট ছাপ রয়েছে সেই শিক্ষাব্যবস্থার সর্বাঙ্গে।
জাতপাতে বিভক্ত ভারতীয় সমাজে সমান শিক্ষাধিকারের ধারণাটি ছিল অলীক। ফলে, শুরু থেকেই শিক্ষার সমান সুযোগের বিষয়টি কখনও বাস্তব রূপ নেয়নি, যদিও আধুনিক শিক্ষায় সমান সুযোগের দাবিতে অবিভক্ত বাংলার হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুর, বা তৎকালীন বম্বে প্রেসিডেন্সির সাবিত্রী ফুলে, জ্যোতিবা ফুলে বড় আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন পশ্চাৎপদ সমাজের মানুষদের নিয়ে। কিন্তু তার সুফল সামগ্রিক ছিল না। স্বাধীনতার পরেও ইংরেজ-প্রদত্ত শিক্ষাব্যবস্থা আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি একটি ছোট সংশোধনের মধ্য দিয়ে— তার নাম নিপীড়িত জাতির জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা।
সেই সংশোধনও পুনরায় সংশোধিত করার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি আইআইএম-গুলি বার বার সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছে, ‘উৎকর্ষমণ্ডিত সংস্থা’ হিসেবে যেন আসন সংরক্ষণ-নীতি থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। আইআইটি, আইআইএম, এমস— এই সব ভারতীয় ‘আইভি লিগ’ প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই সংরক্ষণবিরোধী। তাদের মতে, সংরক্ষণ পদ্ধতি দক্ষতা ও কার্যকারিতাকে হত্যা করে। তারা বলে যে, আমাদের উন্নয়নশীল দেশে, কেবলমাত্র এই শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলিই ‘তৃতীয় বিশ্বের দরে, প্রথম বিশ্বের পরিষেবা দেয়।’ সেই কারণে, উচ্চ থেকে নিম্ন, সকল জাতির মানুষেরাই এখান থেকে শিক্ষালাভের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। সংরক্ষণ নীতির জন্য এমন প্রতিষ্ঠানেও দক্ষতাকে মূল্য দেওয়া হয় না, ‘অযোগ্য ব্যক্তি’কে সুযোগ করে দেওয়া হয়, এবং ঐতিহাসিক অন্যায়ের নামে বর্তমান অন্যায় ঘটানো হয়, যাকে উল্টো-বৈষম্যও বলেন অনেকে। বলা হয়, মেধা হল দক্ষতার মাপকাঠি এবং এটি সব নাগরিকের ক্ষেত্রে সমান প্রযোজ্য। সংরক্ষণ এই আপাত-নিরপেক্ষ মেধার প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
এই যুক্তি গ্রহণ করব কি না, সেটা বিচার করতে দু’টি প্রশ্ন জরুরি— মেধা কী? এবং, সংরক্ষণ কেন? অভিধান মতে, মেধা মানে ‘প্রশংসনীয় গুণ বা যোগ্যতা’। ভারতীয় সমাজে সকলেই নিজেদের আকাঙ্ক্ষানুসারে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে না। তার জন্য যে কাঠামো দরকার, তা আমাদের নেই। তাই এই উচ্চশিক্ষা সংস্থাগুলি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা নির্ণয় করে এই বৈষম্য বজায় রাখে। আসন সংখ্যার থেকে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার দরুন ‘প্রশংসনীয় গুণ’-এর থেকেও পরীক্ষায় কে কত ভাল স্থান পেয়েছে তাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই পরীক্ষায় ভাল ফল করা এতটাই সামাজিক অবস্থাননির্ভর যে, এখানে সমাজের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ না হয়ে যায় না।
আমাদের বর্তমান সামাজিক সম্পর্কগুলি কিন্তু ‘নিরপেক্ষ’ নয়। আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানের জন্য আমাদের বৌদ্ধিক ও নৈতিক চরিত্র অনেকটাই প্রভাবিত হয়। বৌদ্ধিক উৎকর্ষের জন্য আমাদের তিন ধরনের মৌলিক সহায়তার প্রয়োজন হয়— এক, আর্থিক পুঁজি, যা ঠিক করে আমাদের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ও ভাল মানের নিম্ন-বুনিয়াদি শিক্ষা; দুই, সামাজিক-সাংস্কৃতিক পুঁজি, যেমন সম্মান, আত্মবিশ্বাস, সহায়তা, পরিচিতি; এবং তিন, পরিশ্রম করার অবকাশ। এই সব ক’টি পুঁজির একত্র লভ্যতাই এক জনকে মেধাবী করতে পারে, কেবল কঠোর পরিশ্রমই যথেষ্ট নয়। প্রশ্ন হল, আমাদের সমাজে এই সহায়তা কি যথেষ্ট সমান ভাবে বণ্টিত?
অম্বেডকরের মতে, হিন্দু সমাজকে ‘সমাজ’ বলা যায় না। কারণ, হিন্দু সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য তার জাত-নির্ধারিত ক্রমবিভক্ত শ্রেণিবিন্যাস। ব্রাহ্মণ নিচু নজরে দেখে কায়স্থকে ও তার শ্রমকে। কায়স্থ নিচু চোখে দেখে শূদ্রকে, আর শূদ্র চণ্ডালকে। এ এক অদ্ভুত ‘সমাজ’ যেখানে সবাই সবাইকে ‘সমান ভাবে’ ঘৃণা করে। প্রশ্ন হল, এমন বিচ্ছিন্নপ্রায় সমাজের চোখে কে মেধাবী হওয়ার সুযোগ পেতে সক্ষম?
নিপীড়িত শ্রেণির জন্য সংবিধান-প্রদত্ত আসন সংরক্ষণ কোনও মৌলিক অধিকার নয় বলে সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি রায় দিয়েছে। মৌলিক না হলেও কেবল এই একটি ছোট অধিকারের জোরেই দেশের বিপুল সংখ্যক দলিত আজ শিক্ষা বা চাকরিক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পেরেছে, যা কয়েক দশক আগেও অকল্পনীয় ছিল।
অম্বেডকরেরা ভেবেছিলেন, সংরক্ষণ হবে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, যা নিপীড়িত জাতিবর্গকে হাজার বছরের দাসত্ব থেকে কেবল মুক্তিই দেবে না, সমাজবহির্ভূত জাতিগুলোকে সমাজে নিয়ে আসবে। সংরক্ষণ হবে এক সাম্যের ধারণার ‘শুরু’।
ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, পিছিয়ে পড়া গোত্রের মানুষ তার মেধা দিয়ে কেবল পরীক্ষায় ভাল করবে না, নিজের সমাজকে কিছু ফিরিয়েও দেবে। অথচ আমরা দেখি, ফিরিয়ে দেওয়া দূরের কথা, নিচুজাতের মানুষেরা মূলস্রোতে প্রায়শই প্রাতিষ্ঠানিক নিগ্রহের শিকার হন। চুনি কোটাল থেকে রোহিত ভেমুলা, এঁদের মৃত্যু কেবল ব্যক্তিমৃত্যু নয়, এঁদের নিজেদের সমাজের সত্তার মৃত্যু, তাঁদের মর্যাদার মৃত্যু।
মেধা বস্তুটিকে আমরা সামাজিক ভাবেই নির্ধারণ করি, তবে তা করতে হবে ব্যক্তিবিশেষের সামাজিক অবস্থানের নিরিখে— তার ব্যক্তিগত সাফল্যের ভিত্তিতে নয়। ব্যক্তি-গত সাফল্য এবং নিরপেক্ষ মেধার মতাদর্শ পুঁজিবাদ ও জাতসর্বস্ব সমাজ গঠনে সাহায্য করে, যার ফলে সামাজিক বিভেদ ও বৈষম্য আরও দৃঢ় হয়। আজকের ব্রাহ্মণ্যবাদী কেন্দ্রীয় সরকার সেই কারণেই হয়তো আঘাত হানছে সেই সব উচ্চশিক্ষা সংস্থার ওপর, যেখানে সংরক্ষণ নীতি কিছুটা হলেও সামাজিক সমতার সৃষ্টি করেছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy