ভারতের সাম্প্রতিক রাজনীতির সঙ্গে আমার মতপার্থক্য রয়েছে। আমি বড় হয়েছি কলকাতায়— ছোটবেলাটা কেটেছে উত্তর কলকাতার বাড়িতে, যৌথ পরিবারে। বাঙালি হিন্দু পরিবার, সাধারণ পরিচিত ধাঁচের জীবনযাত্রা। তবে, আমার আত্মীয়স্বজনরা ছিলেন খোলা মনের প্রগতিশীল মানুষ। আমায় ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয়েছিল, কোনও জিনিস চলে আসছে বলেই যেন সেটাকে মেনে না নিই। জাতিভেদপ্রথা খারাপ— সেটা আমাদের ঐতিহ্য হলেও সেই প্রথাকে ভাঙার চেষ্টা করতে হবে। ধর্মীয় সহনশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ— প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের পছন্দ অনুসারে ধর্মাচরণ করার। আমরা যেমন উৎসাহের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পড়তাম, তেমনই নজরুলও পড়তাম। দু’জনই ছিলেন আমাদের সামাজিক অস্তিত্বের অঙ্গ। যখন আমি স্কুলের শেষ দিকে, তখন বুঝলাম, নিজের প্রতি সৎ থেকে প্রচলিত অর্থে ঈশ্বরবিশ্বাসী হওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। পরবর্তী কালে বুঝেছি, চার্বাক, ডেভিড হিউম বা বার্ট্রান্ড রাসেল যে অর্থে সংশয়বাদী, আমিও তা-ই। তখন ঈশ্বর-বিশ্বাসে অপারগতার কথাটা বাড়িতে বলায় কেউ রাগ করেননি। বড় জোর, আমার ছেলেমানুষি নিয়ে একটু হাসাহাসি হল। এক আত্মীয়া বললেন, “কয়েকটা বছর যাক, ও নিজেই বুঝবে।” কথাটা বোধ হয় ঠিক বলেননি। আমার বয়স এখন ৬৯ বছর। আমি বিশ্বাস করি যে, দুনিয়ায় প্রচুর রহস্য রয়েছে, অনেক কিছুই আমাদের বোধ বা যুক্তির অতীত। কিন্তু, যে মৌলিক সংশয়বাদটা আমার ভিতরে ছিল, তা পাল্টায়নি।
আমার বাড়ির কথা বললাম বটে, কিন্তু সেই সময় বাংলার বেশির ভাগ বাড়িই আমাদের বাড়ির মতো ছিল। রামমোহন রায়ের হাত ধরে যে প্রগতিশীল চিন্তার সূচনা হয়েছিল, তা বিদ্যাসাগর, জগদীশচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষদের কথা আর কাজের মাধ্যমে এই অঞ্চলের চেতনা, সংস্কৃতির অন্তর্গত হয়ে গিয়েছিল। এটা নিয়ে আমার যে খানিক গর্ব ছিল, তা অস্বীকার করব না। বাঙালি হিসেবে গর্ব নয়— ভাষাগত পরিচিতির চেয়ে গর্বটা বেশি ছিল আঞ্চলিক পরিচিতি নিয়ে— এই অঞ্চলের সমৃদ্ধি নিয়ে গর্ব। বাংলা ছিল বিভিন্ন অঞ্চলের, ভাষার, সংস্কৃতির, ধর্মের মানুষের মিলনস্থল। তার মাধ্যমেই বাংলা শিল্প থেকে বিজ্ঞান, সবেরই কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। কে জি সুব্রাহ্মণ্যম থেকে সি ভি রমণ, ভিন প্রদেশের কৃতীরা ভিড় করেছিলেন বাংলায়। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলা ছিল প্রগতিশীলতার কেন্দ্রে। এখন দেশ জুড়ে যা হচ্ছে— উত্তরপ্রদেশে ‘লাভ জেহাদ’ নিবারণী আইন, মধ্যপ্রদেশে নারীদের সঙ্গে শিশুদের মতো আচরণ— এগুলো দেখলে বাংলার সেই কৃতী মানুষরা শিউরে উঠতেন।
লেখার শুরুতে যে বলেছিলাম, ভারতের সাম্প্রতিক সঙ্গে আমার মতপার্থক্য আছে— সেটা এই ঘটনাগুলোর কথা মাথায় রেখেই বলেছিলাম। কিন্তু নিজেকেই বলি, এটা গণতন্ত্র। মানুষের পছন্দকে সম্মান করতেই হবে। ভেবেছিলাম, রাজনীতির সঙ্গে যদি সহমত না-ও হতে পারি, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা অন্তত ভাল ভাবে চলবে। ফলে, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা যখন এই প্রবল আর্থিক মন্দার সম্মুখীন হল, খুবই অবাক হয়েছিলাম। কেন এই বিপদ উপস্থিত হল? কোথায় ভুল হয়েছে? এই লেখায় এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর খুঁজতে চাই।
এখন সর্ব ক্ষণ এত ভ্রান্ত তথ্য ঘুরে বেড়ায় চতুর্দিকে যে, কিছু পরিসংখ্যান উল্লেখ করতেই হবে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় মন্দা চলছে। অর্থবর্ষের প্রথম দু’টি ত্রৈমাসিকে, অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন, আর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর, এই মাসগুলোয় ভারতীয় অর্থব্যবস্থার আয়তন হ্রাস পেয়েছে যথাক্রমে ২৩.৯ শতাংশ ও ৭.৫ শতাংশ। মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, অতিমারির কারণেই এই অবস্থা হয়েছে— গোটা দুনিয়ার অর্থব্যবস্থা যখন বিপর্যস্ত, ভারতই বা ব্যতিক্রম হবে কেন? এই মনে হওয়াটা দুটো কারণে ভুল। প্রথমত, অতিমারির সময় ভারতীয় অর্থব্যবস্থা যতখানি ধাক্কা খেয়েছে, দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশই ততখানি বিপর্যস্ত হয়নি। দুনিয়ার সব দেশকে যদি জিডিপি-র বৃদ্ধির হার অনুসারে সাজানো হয়, ভারত একেবারে তলানির কুড়ি শতাংশ দেশের মধ্যে পড়বে। স্তম্ভিত হওয়ার মতোই খবর, কারণ কিছু দিন আগে অবধি ভারতের স্থান হত সেরা এক শতাংশের তালিকায়।
দ্বিতীয়ত, ভারতীয় অর্থব্যবস্থার এই মন্দার সূচনা হয়েছে অতিমারি আরম্ভ হওয়ার ঢের আগেই। সামান্য পরিসংখ্যান দেখলেই একটা আশ্চর্য তথ্য বেরিয়ে আসে— ২০১৬ সাল থেকে প্রতি বছর ভারতীয় অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হার তার আগের বছরের তুলনায় কম হয়েছে। ২০১৬ সালে এই হার ছিল ৮.২%। তার থেকে কমে হল ৭.২%, তার পর ৬.১%, ৪.২%, এবং এই বছর অনুমান করা হচ্ছে, হারটি দাঁড়াবে -৭.৭ শতাংশে। টানা চার বছর ধরে অর্থব্যবস্থা আগের বছরের তুলনায় খারাপ করছে, এই ঘটনা স্বাধীনতার পর কখনও ঘটেনি।
শুধুই জিডিপি-র বৃদ্ধির হার নিম্নমুখী হয়েছে, এবং তার ফলে সাধারণ ভাবে মানুষের ভাল থাকায় যেটুকু আঁচ পড়ার, পড়েছে? দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, না। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে (এনএফএইচএস)-এর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ভারতীয় শিশুদের গড় উচ্চতা ও ওজন কমেছে— আমাদের দেশের বাচ্চারা একটু বেঁটে আর একটু রোগা হয়ে গিয়েছে। লক্ষণ বলছে, ঘটনাটা পুষ্টির অভাবে ঘটেছে। এমন ঘটনা খুবই বিরল। গোটা দুনিয়াতেই।
ধনী, মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারেও বাচ্চারা সচরাচর অপুষ্টিতে ভোগে না। সুতরাং, এনএফএইচএস-এর পরিসংখ্যান থেকে মনে হচ্ছে, দরিদ্র পরিবারগুলির আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। ভারতের উৎসাহ মূলত বড় ব্যবসা, কর্পোরেট, আর রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে— মানবোন্নয়নে তার কুপ্রভাব পড়ছে। ভারতে প্রত্যাশিত গড় আয়ু এখন ৭০ বছর। নেপাল বা বাংলাদেশের মতো দরিদ্রতর দেশেও এই সংখ্যাটি যথাক্রমে ৭২ ও ৭৪ বছর।
ভারতের এই অবস্থার ছবিটা সামনে আসতেই গোটা দুনিয়ায় সাড়া পড়েছে। খোঁজ চলছে, ভারতে হঠাৎ কী হল? এই দেশের বেশ কিছু জোরের জায়গা আছে— ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র এবং ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি দুনিয়ায় অগ্রগণ্য। এ দেশে উচ্চশিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। তা হলে ভারত হঠাৎ কার্যত সব অর্থনৈতিক সূচকে পিছিয়ে পড়ছে কেন?
কিছু কারণ সহজেই বোঝা যায়। যেমন, ভারতে বিনিয়োগের হার (অর্থাৎ, জিডিপি-র যত শতাংশ নতুন মেশিন, কারখানা, রাস্তা, রেললাইন পাতা ও অন্যান্য পরিকাঠামো নির্মাণের কাজে খরচ হয়) সাম্প্রতিক কালে ক্রমেই কমেছে। গোটা দুনিয়ার অভিজ্ঞতা বলছে, বিনিয়োগ হল আর্থিক বৃদ্ধির একটা বড় চালিকাশক্তি। দক্ষতার অভাবও রয়েছে। এ দেশে কথার কথা প্রচুর হয়, কিন্তু খুঁটিনাটির দিকে নজর দেওয়া হয় না। লকডাউনের সময়ও এটা স্পষ্ট চোখে পড়ল। দেশজোড়া লকডাউন ঘোষণার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বোঝা গেল, কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিকের কী হবে, সে বিষয়ে কোনও পরিকল্পনাই করা হয়নি। তার ফলে লকডাউনে তেমন লাভ হল না। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ায় কোভিডে মৃত্যুর হার আমেরিকা বা ইউরোপের চেয়ে অনেক কম। তবে, সেটা কোনও সরকারের কৃতিত্বের কারণে নয়— এই অঞ্চলগুলিতে আগের অসুখবিসুখের কারণে বর্তমানে একটা স্বাভাবিক প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে উঠেছে বলে এখন মনে করা হচ্ছে। ভারতে কোভিড প্রতিরোধে সরকারি নীতি কেমন কাজ করেছে, বুঝতে গেলে এই অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের তুলনা করতে হবে। দেখা যাচ্ছে, অঞ্চলের অন্য দেশগুলির তুলনায় ভারতে প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় বেশি লোক কোভিডে মারা গিয়েছেন। প্রায় নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে, লকডাউন চলাকালীন পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যার প্রতি সরকারের সংবেদনশীলতার অভাবের ফলেই এই ঘটনাটা ঘটল।
কিন্তু, এই কারণগুলোর বাইরে কি আরও কারণ আছে? আর্থিক নীতি নির্ধারণের কাজটা বিলক্ষণ কঠিন, এবং শত সদিচ্ছা সত্ত্বও মাঝেমধ্যে নীতি ভুল পথে চলে যায়— এই কথাগুলি অনস্বীকার্য। ভারতের মুখ্য অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমি এই কথাগুলো প্রত্যক্ষ ভাবে জানি। আমি যে সময় দায়িত্বে ছিলাম, তখন মূল্যস্ফীতির প্রাবল্য চলছি। মানুষ নাজেহাল— ধরেই নিয়েছিলেন যে, আমরা ইচ্ছে করে দাম নিয়ন্ত্রণ করছি না। সাধারণ মানুষের পক্ষে যে কথাটা বোঝা কঠিন, তা হল, এক বার মূল্যস্ফূতি আরম্ভ হলে গোটা অর্থব্যবস্থার যাত্রাভঙ্গ না করে তাতে লাগাম পরানো কঠিন। মূল্যস্ফীতির গল্পটা যে সাধারণ মানুষ একেবারেই বুঝতে পারে না, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। দিল্লিতে আমাদের বাড়িতে রান্না করতেন সুষমা নামে এক ভদ্রমহিলা। খুবই বুদ্ধিমান, কিন্তু নিরক্ষর। আমার এক বন্ধু এক দিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, আমি কী কাজ করি, তিনি জানেন? সুষমা জানিয়েছিলেন, প্রতিবেশীদের রাঁধুনি আর দারোয়ানদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জেনে নিয়েছেন— আমি ভারতে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর দায়িত্বে আছি!
অর্থশাস্ত্রের তর্ক জটিল, বাস্তব দুনিয়ার অর্থনীতি জটিলতর। অনেক অর্থনীতিবিদের সঙ্গে একটা জায়গায় আমার মতপার্থক্য আছে— আমি মনে করি না যে, আর্থিক বৃদ্ধি শুধুমাত্র আর্থিক নীতি দ্বারাই নির্ধারিত হয়। সামাজিক নিয়ম, সংস্কৃতি এবং রাজনীতির উপরও আর্থিক বৃদ্ধি নির্ভর করে। কাজেই, গত পাঁচ বছরে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা এমন বেহাল হয়েছে কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হবে এই লেখার গোড়ার দিকের কথাগুলোর কথা। বিভেদ আর ঘৃণার রাজনীতি যে শুধু আমাদের সমাজেরই ক্ষতি করছে, তা না-ও হতে পারে— তা সম্ভবত অর্থব্যবস্থারও ক্ষতি করছে। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার মতো গবেষকদের কাজ থেকে আমরা আজ সামাজিক বিশ্বাসের মাত্রার সঙ্গে আর্থিক সাফল্যের স্পষ্ট যোগসূত্রের কথা জানি। সমাজে যখন পারস্পরিক বিশ্বাসের পরিমাণ কমে, তখন যে কোনও চুক্তিই কার্যকর করা কঠিনতর হয়; মানুষ আর নিজেদের সমাজের অংশ বলে মনে করে না। ফলে, অর্থব্যবস্থায় মানুষ সর্ব শক্তিতে যোগও দেয় না। তাতে ধাক্কা লাগে বৃদ্ধির হারে।
গত শতকের প্রথমার্ধে ভারতে অর্থব্যবস্থার বার্ষির বৃদ্ধির গড় হার ছিল এক শতাংশের সামান্য বেশি। দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরেই এই হার অনেকখানি বাড়ল। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার তো কড়া হাতে, অত্যন্ত একনায়কোচিত ভঙ্গিতে শাসন করত— তাতে কিন্তু বৃদ্ধির হার বাড়েনি। যত ক্ষণ না মানুষ নিজেদের গোটা সমাজব্যবস্থার অংশ বলে মনে করেছে, যত ক্ষণ সামাজিক বিশ্বাসের পরিমাণ কম থেকেছে, মানুষ খানিক অনিচ্ছা সহকারে যোগ দিয়েছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে, বৃদ্ধির হার মাথা তুলতে পারেনি।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে— বিশেষত উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে— যে ঘটনাগুলি ঘটছে, তাতে মনে হচ্ছে যে ক্রমবর্ধমান সামাজিক বিদ্বেষ, ঘৃণা, অন্তঃগোষ্ঠী স্বার্থপরতা ইত্যাদি অর্থব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলতে আরম্ভ করেছে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, আমরা বাংলাতেও এই প্রবণতার ছায়া দেখতে পাচ্ছি। অমর্ত্যে সেনের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক আক্রমণ তার একটা বড় প্রমাণ। অমর্ত্য সেন আমার শিক্ষক ছিলেন। আমি তাঁকে খুব কাছ থেকে চিনি। সবার মতোই তাঁরও কিছু দোষ-ত্রুটি আছে, কিন্তু তিনি চরিত্রগত ভাবে এক জন সম্মাননীয় ও নৈতিক মানুষ— এমন এক জন, যিনি সবাইকে সম্মান করতে জানেন। তাঁর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক অভিযোগগুলোর মধ্যে কয়েকটা এমনই অলীক এবং অশালীন যে, শুনলে লজ্জা করে। তবু আশার কথা কী, জানেন— আমার এক বাঙালি বন্ধু, বিভিন্ন তাত্ত্বিক প্রশ্নে যিনি একাধিক বা অমর্ত্য সেনের সঙ্গে দ্বিমত হয়েছেন, তিনি বললেন, পশ্চিমবঙ্গের নেতারা যখন অমর্ত্যর বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো করেন, তখন তাঁর নিজেরই লজ্জা লাগে।
এক জন বাঙালি হিসেবে, এক জন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে, এক জন হিন্দু হিসেবে, এই ঘটনাক্রম আমায় উদ্বিগ্ন করছে। যা হচ্ছে, তা বাংলার সংস্কৃতির বিরোধী। সাহিত্য, বিজ্ঞান ও প্রগতিশীল মননে বাংলাকে যা আন্তর্জাতিক স্তরে সর্বাগ্রগণ্য অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল, বর্তমান ঘটনাক্রম সেই চরিত্রের বিরোধী। এক কালে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কৃতিত্বের স্বীকৃতি ছিল দুনিয়া জুড়ে। ভারত তার প্রগতিশীল মতাদর্শের জন্য ব্যতিক্রমী দেশ ছিল। একটা সর্বজনীন, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে— রবীন্দ্রনাথ ও নেহরু, উভয়েই যে ভাবে ভারতকে কল্পনা করেছিলেন— ভারতকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে চেষ্টা ছিল, গোটা উন্নয়নশীল দুনিয়ায় তার কোনও জুড়ি ছিল না।
এই সুবিধাটা হারিয়ে ফেললে মস্ত ভুল হবে। যদি ভারতের খ্রিস্টান, মুসলমান বা অন্যান্য সংখ্যালঘু মানুষরা দেশে নিজেদের বিচ্ছিন্ন বোধ করেন, তবে সেটা এমনিতেই অতি লজ্জার, অতি দুঃখের। কিন্তু, সেই বিষ অর্থব্যবস্থাকেও বিপর্যস্ত করবে— দেশের আর্থিক ও রাজস্ব নীতি নির্ধারণের পিছনে থাকা যাবতীয় সদিচ্ছাকে ব্যর্থ করবে। ভারত যাতে ভাল করতে পারে, তা নিশ্চিত করা আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। অতীতে যে অনেক ক্ষেত্রেই নীতি নির্ধারণে ভুল হয়েছে, সে কথা অনস্বীকার্য। এটাও ঠিক যে, রাজনৈতিক নেতারা কী করছেন, সে দিকে মানুষকে সব সময় সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। কিন্তু, সেই ব্যর্থতার হতাশা যেন আমাদের বিভেদ আর ঘৃণার দিকে না নিয়ে যায়। আমরা যেন নিজেদের বৌদ্ধিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার না করি। যে ব্যর্থ দেশগুলোকে ভারত চিরকাল করুণার চোখে দেখেছে, আমরা যেন ভারতকে তেমনই একটা দেশ বানিয়ে না ফেলি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy