৪ জুন, ২০১৭। তখনও ভারতের মানচিত্র জুড়ে চাপ চাপ রক্তের দাগ সমগ্র দেশের হৃদয়কে এমন করে ক্ষতবিক্ষত করেনি। কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে পৌঁছে যাওয়া উত্তরপ্রদেশের উন্নাও জেলার মেয়েটি অগাধ আশা নিয়ে ছুটে গিয়েছিল স্থানীয় বিধায়কের কাছে চাকরির প্রত্যাশায়। কিন্তু তার পর থেকে আজ অবধি যা যা তাঁর জীবনে ঘটেছে, তাতে হাড় হিম হয়ে গিয়েছে কঙ্কালসার সমাজব্যবস্থার অন্তঃপুরের! উত্তরপ্রদেশের বর্তমান শাসক দলের বিধায়ক কুলদীপ সিংহ সেঙ্গার, তাঁর ভাই অতুল সেঙ্গার এবং তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গরা মিলে সেই সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত কন্যাসম চাকুরিপ্রার্থী মেয়েটিকে নৃশংস ভাবে গণধর্ষণ করেছিল। ক্ষতবিক্ষত দেহ-মন বয়ে নিয়ে বিধ্বস্ত মেয়েটি সে দিন মূক হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির এ হেন পৈশাচিক লালসার প্রতিক্রিয়ায় রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল তাঁর পরিজনেরা। স্থানীয় থানায় ছুটে যায় ন্যায়বিচারের আশায়। কিন্তু প্রতাপশালী রাজনৈতিক সত্ত্বা, তার উপরে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি! স্থানীয় পুলিশের সাধ্য এবং শৌর্য আদৌ ছিল নাকি ক্ষমতাসীন অলিন্দে প্রবল ভাবে বিরাজমান কুলদীপ সিংহ সেঙ্গারের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ করার মতো! বারবার পুলিশের দরজায় করাঘাত করা সত্ত্বেও কুলদীপ সিংহ এবং তাঁর দলবলের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ গ্রহণ করতে পুলিশ অস্বীকার করে। ১১ জুন থেকে নির্যাতিতা মেয়েটি হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। উৎকণ্ঠিত মায়ের মমতা মাখা হাতে পাকানো রুটি ক্রমেই শীতল থেকে শীতলতর হয়ে আসে। পথ চেয়ে বসে থাকা পরিজনদের প্রতীক্ষায় কালবৈশাখীর উথালপাতাল। ঘরময় বাবার অস্থির পায়চারির উৎকণ্ঠিত হা-হুতাশ, মায়ের বুক জুড়ে প্লাবনের জলোচ্ছ্বাস।
সমস্ত দিনের আগুন ঝরা বাতাসে দগ্ধ গাছের পাতাগুলিও নুয়ে পড়ে মেয়ের বাড়ি ফেরার অন্তহীন প্রতীক্ষায়। দিন যায়, সন্ধ্যা ঘনায়, বুক জুড়ে নেমে আসে থোকা থোকা রাত্রির অন্ধকার। তবু মেয়ে ঘরে ফেরে না। এমন ভাবে কেটে যায় আরও কয়েকটা অস্থির দিন, আরও কতগুলো নিদ্রাহীন প্রহর। পরিবারের পক্ষ থেকে স্থানীয় থানায় নিখোঁজের অভিযোগ দায়ের করা হয়।
২০ জুন আউরিয়া গ্রাম থেকে নিখোঁজ মেয়েটিকে পুলিশ উদ্ধার করে। ২২ জুন নির্যাতিতাকে আদালতে তোলা হয়। শরীর-মনে বিধ্বস্ত মেয়েটি কিন্তু নির্ভীক দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আদালতকে জানান যে কুলদীপ, তাঁর ভাই অতুল এবং তাঁদের দলবলের দ্বারা ধর্ষিতা হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ কুলদীপ এবং তাঁর ভাইয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ কোনও মতেই গ্রহণ করছে না। আদালতের নির্দেশে ৩ জুলাই পুলিশ নির্যাতিতা মেয়েটিকে তাঁর পরিবারের হাতে সমর্পণ করে। তার পর থেকে সুবিচারের আশায় লাগাতার ভাবে প্রশাসনের দরজায় ঘুরে ঘুরে মরে নির্যাতিতা তরুণী এবং তাঁর পরিবার। কুলদীপ বাহিনীর রক্তচক্ষু উত্তরোত্তর চরম আতঙ্কে গিলে ফেলতে থাকে নির্যাতিতা এবং তাঁর পরিবারকে। তবু প্রশাসন নির্বিকার। প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ যেন ত্রাস এবং উৎকণ্ঠার আগ্নেয়গিরি বুকে চেপে বেঁচে থাকা। উপায়ান্তর না দেখে, নির্যাতিতা এবং তাঁর পরিবার উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ছুটে যান কুলদীপ এবং তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার অভিপ্রায়ে। কিন্তু ক্ষমতার সূর্যের আলোয় থাকা মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর কি এতটা অসাড় সময় থাকতে পারে যে, তিনি একটি সামান্য মেয়ের ধর্ষিতা হওয়ার কাহিনি শুনতে পারেন!
এত বড় একটা অন্যায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়বিচারের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনও রূপ সহানুভূতি ও সহযোগিতা না পেয়ে, বাধ্য হয়েই ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ তারিখে নির্যাতিতার মা উন্নাওয়ের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে কুলদীপ এবং তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। ৩ এপ্রিল এই মামলার শুনানি শেষে বাড়ি ফেরার পথে বিকেলবেলায় কুলদীপ এবং তাঁর ভাই অতুলের হাতে নির্যাতিতার বাবা চরম ভাবে আক্রান্ত হন। প্রচণ্ড মারধর করার পরে কুলদীপ এবং তাঁর ভাই নির্যাতিতার বাবাকেই মিথ্যা অভিযোগে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পুলিশ প্রকৃত ঘটনার অনুসন্ধান না করেই কুলদীপের নির্দেশ মতো নির্যাতিতার বাবাকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করে। কোথাও কোনও সুবিচার না পেয়ে এবং উল্টে মিথ্যা অভিযোগে তাঁদের পরিবারকে ফাঁসানোর ঘটনার প্রতিবাদে ৮ এপ্রিল, ২০১৮ তারিখে নির্যাতিতা তাঁর পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে নিয়ে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে অবস্থান-বিক্ষোভে শামিল হন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফ থেকে ছিটেফোঁটাও সহমর্মিতা না পেয়ে, সেখানেই নির্যাতিতা গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। গণমাধ্যমের সুবাদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা উন্নাওয়ের গণধর্ষণের ঘটনা জনসমক্ষে চলে আসে। ঠিক তার পরের দিনই রহস্যজনক ভাবে পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন নির্যাতিতার বাবার মৃত্যু হয়। ১০ এপ্রিল ময়নাতদন্ত রিপোর্টে নির্যাতিতার বাবার শরীরে মোট ১৪টি ক্ষতচিহ্নের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এই ঘটনা দেশের নাগরিক সমাজের মননে প্রবল ভাবে আলোড়িত হয়। মোট ছয় জন পুলিশ কর্মীকে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করা হয় এবং এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মোট চার জনকে গ্রেফতার করা হয়। তবু প্রশাসন কুলদীপের কেশাগ্র স্পর্শ করার মতো স্পর্ধা দেখাতে অক্ষমই থেকে যায়। প্রবল জনমত এবং সংবাদমাধ্যমের চাপে অবশেষে ১২ এপ্রিল উন্নাও কাণ্ডের তদন্তভার সিবিআই-এর উপর ন্যস্ত করা হয়। ঠিক পরের দিনই সিবিআই ধর্ষণের অভিযোগে কুলদীপকে গ্রেফতার করে।
২০১৮ সালের এপ্রিল মাস থেকে নির্যাতিতা এবং তাঁর পরিবারের লোকেরা মোট ৩৬টি চিঠি লিখে প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে তাঁদের নিদারুণ অসহায় অবস্থার কথা এবং তাঁদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা প্রদানের জন্যে আবেদন জানান। কিন্তু তাঁদের প্রতি উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনের কোনও মহল থেকেই কোনও সংবেদনশীল হাত এগিয়ে আসেনি। উপায়ান্তর না দেখে গত ১২ জুলাই তাঁরা দেশের শীর্ষ আদালতের মহামান্য প্রধান বিচারপতিকে দীর্ঘ ১২ পাতার চিঠি লিখে গোটা ঘটনার কথা বিশদে জানান। অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ভাবে সেই চিঠিটিও মহামান্য প্রধান বিচারপতির হাতে পৌঁছায় না।
জুলাই ২৮, ২০১৯-এর বৃষ্টিস্নাত সকাল। নির্যাতিতা তরুণী, তাঁর মা, কাকিমা এবং তাঁর আইনজীবীকে নিয়ে গাড়িতে চেপে রায়বরেলির জেলে যাচ্ছিলেন তাঁর জেলবন্দি কাকার সঙ্গে দেখা করতে। রাস্তার উল্টোদিক থেকে ছুটে আসে নম্বর প্লেটে কালি লাগানো ট্রাক। পিষে দিয়ে চলে যায় নির্যাতিতার গাড়ি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় নির্যাতিতার মা ও কাকিমার। গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত নির্যাতিতা মেয়েটি এবং তাঁর আইনজীবীকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি করা হয় লখনউ-এর হাসপাতালে। মেয়েটি এখনও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে যাচ্ছেন দিল্লির এক হাসপাতালে। ঘটনার রহস্য উন্মোচন এবং এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্তকরণের উদ্দেশ্যে দেশের শীর্ষ আদালতের অগ্রণী ভূমিকা ভূয়সী প্রশংসার দাবি রাখে। শীর্ষ আদালতের মহামান্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ সাত দিনের মধ্যে এই জঘন্য ঘটনার তদন্ত সম্পূর্ণ করে আদালতের কাছে রিপোর্ট পেশ করতে সিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছিল। বিচারপ্রার্থী আদৌ ন্যায়বিচার পাবে, তা বলে দেবে অমোঘ সময়। কিন্তু কী অপরাধ ছিল উন্নাওয়ের নির্যাতিতার? চাকরির আশায় তিনি ছুটে গিয়েছিলেন পিতৃসম স্থানীয় বিধায়কের কাছে। আর তাঁর এই সামান্য ভুলের মাসুল তাঁকে কড়ায়-গণ্ডায় গুনে দিতে হয়েছে অপমান ও লাঞ্ছনার বিনিময়ে। তাঁর পরিজনদের মৃত্যু মিছিলের বিনিময়ে। তাঁর নিজের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের মরণপণ লড়াইয়ের বিনিময়ে।
এত অবিচারের পরেও কিন্তু মেয়েটি এখনও লড়াইয়ের ময়দান থেকে পিছপা হয়নি। লড়াই এখনও জারি আছে তাঁর, প্রবল ভাবেই। তবে উন্নাও জেলার এই সামান্য মেয়েটি বিঁধিয়ে দিয়ে গেল কোটি প্রশ্নবাণের শরশয্যায়, আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক চালচিত্রের ভঙ্গুর কাঠামোকে। আরও একবার বেরিয়ে পড়ল সমাজের অন্তঃসারশূন্য নগ্ন কঙ্কাল। দেখা গেল অপরাধ জগৎ ও ক্ষমতার অলিন্দে পাক খাওয়া রাজনীতির কদর্য ইতিবৃত্ত। সংগ্রামের মুষ্টিবদ্ধ হাত যেন কেবলই উঁকি মারে অনাচার অন্তের প্রতীক্ষায়।
রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy